
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করায় রাজনৈতিক অঙ্গণে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীশিবির থেকে আইনজীবীরা ওই ঘটনাকে মোদি সরকার কার্যত বিচারবিভাগের স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকল বলে মনে করছেন।
গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় তাঁকে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেছেন প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ। কার্যত নজিরবিহীনভাবে ওই নিয়োগ করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে আজ (মঙ্গলবার) অসমের গুয়াহাটিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বলেন, ‘আমি সম্ভবত আগামীকাল (বুধবার) দিল্লি যাব। প্রথমে সেখানে গিয়ে শপথ গ্রহণ করি, তারপরে আমি গণমাধ্যমের কাছে কেন আমি এই মনোনয়নে সম্মতি দিয়েছি তা নিয়েও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করব।’
বিচারপতি গগৈ প্রায় ১৩ মাস সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব পালনের পরে গতবছর নভেম্বর মাসে অবসর গ্রহণ করেন। সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুষ্মন্ত দাভে বলেছেন, ‘এটা একেবারেই ন্যক্কারজনক। সরকারকে সুবিধা করে দেওয়ার পুরস্কার দেওয়া হল। বিচারবিভাগের স্বাধীনতার যেটুকু আবরণ ছিল, তাও ধ্বংস হয়ে গেল।’
মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (মিম) প্রধান ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি’র প্রশ্ন, ‘এটা কী দেওয়া-নেওয়ার খেলা? এরপরে আর স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় আমাদের আস্থা কীভাবে থাকবে? অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।’ বিচারপতি রঞ্জন গগৈকে রাজ্যসভায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সূর্যেওয়ালা বলেন, ‘নমো’র (নরেন্দ্র মোদি) বার্তা হল, হয় রাজ্যপাল, নয়তো রাজ্যসভা। না হলে বদলি সহ্য করো বা ইস্তফা দাও।’
সম্প্রতি দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলীধর বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষমূলক বিবৃতির বিরুদ্ধে এফআইআর-এর নির্দেশ দেওয়ার পরে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়।
বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের আমলে বাবরী মসজিদ-রামমন্দির বিতর্ক মামলার রায় বেরিয়েছে। অসমে এনআরসি প্রক্রিয়াও তাঁর নির্দেশে হয়েছে। ফ্রান্সের সঙ্গে রাফায়েল চুক্তি নিয়ে তিনি দু’বার কেন্দ্রীয় নরেন্দ্র মোদি সরকারকে ছাড়পত্র দিয়েছেন। তাঁর মেয়াদের শেষপর্বে গগৈয়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেরই এক নারীকর্মী যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু গগৈয়ের তৈরি করা কমিটিই তাঁকে ছাড় দিয়ে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে এর পিছনে যড়যন্ত্রের তদন্ত করতে বলে।
রাজ্যসভায় তাঁর মনোনয়নকে কটাক্ষ করে তৃণমূল এমপি মহুয়া মৈত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার বার্তায় লেখেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সংসদে মনোনীত হয়েছেন। এতে আমি অবাক হইনি। কারণ, ওঁর নির্দেশেই এনআরসি হয়েছে, তাড়াহুড়ো করে রাম মন্দির রায় দেওয়া হয়েছে, জম্মু কাশ্মীরের এই পরিস্থিতিতে মামলা শোনেননি তিনি। উনি রাজনীতিবিদ নাকি বিচারপতি? নাকি লোভী রাজা?’
আম আদমি পার্টির বিধায়ক রাঘব চাড্ডা বলেছেন, ‘এটা যে শুধু খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে তাই নয়, এরফলে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা অপূরণীয়।’মিজোরামের সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক নিয়োগ, বিচারবিভাগকে স্পষ্ট বার্তা।’
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মদন বি লোকুর বলেন, ‘কিছুদিন ধরেই জল্পনা চলছিল যে, বিচারপতি গগৈ কী সম্মান পাবেন। সুতরাং, সেই অর্থে মনোনয়নটি অবাক হওয়ার মতো নয়। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় যে এটি এত দ্রুত ঘটেছে। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা এবং অখণ্ডতাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করে। শেষ দুর্গটি কী ভেঙে পড়েছে?’
এমএম/পাবলিকভয়েস

