তিনি ছিলেন মুফতী আমিনী রহ.

প্রকাশিত: ১০:৪৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১২, ২০১৯

বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতিতে যতজন উজ্জল নক্ষত্র রয়েছে তাদের মধ্যে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. প্রথম সারীর একজন ব্যাক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তিরুপেই। প্রতিবাদের এক জ্বলন্ত অগ্নীশিখা ছিলেন তিনি। এদেশে সংগঠিত হওয়া প্রতিটি ইসলামবিরোধী কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমিনী রহ. এর “রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিবাদ” ছিলো উল্লেখ করার মত। মুফতি আমিনী রহ. এর রাজনৈতিক জীবনের সামান্য বিশ্লেষন এবং কিছু কথা বলার প্রচেষ্টা করা হবে এই লেখায়। এখানে তথ্যের যে কোন গ্যাপের ব্যাপারে যৌক্তিক মতামত কাম্য।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

মুফতি আমিনী রহ. এর জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৯৪৫ সালে বি-বাড়িয়ার আমীনপুর গ্রামে। বি-বাড়িয়ার বিখ্যাত জামিয়া ইউনুছিয়ায় লেখাপড়া শুরু করে এরপর মুন্সিগঞ্জের এক মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন অতঃপর তিনি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া কোরআনিয়া আরাবিয়্যা লালবাগ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। যেখানে তিনি আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., হাফেজ্জী হুজুর রহ., আরেফ বিল্লাহ মাওলানা সালাহউদ্দিন রহ. এর সহচর্য লাভ করেন এবং উনাদের কাছ থেকেই কওমি শিক্ষা ধারাবাহিকতার সর্বোচ্চ ধাপ দাওরায়ে হাদিসের সনদ অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচি নিউ টাউন মাদ্রাসায় আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী সাহেব রহ. এর কাছ থেকে উলুমুল হাদিস এবং ইলমে ফিকহ অধ্যায়ন করে দেশে ফিরে আসেন।

১৯৭০ সালে ঢাকার কামরাঙ্গীচরের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এদেশের কওমি ধারার ইসলামী রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর জামাতা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।

১৯৭৫ সালে হাফেজ্জি হুজুর রহ. প্রতিষ্ঠিত লালবাগ মাদ্রাসায় অধ্যাপণার দায়িত্ব নিয়ে সেখানের সহকারী মুফতি হিসেবে নিয়োগ পান।

১৯৮৪ সালে তিনি লালবাগ মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক এবং প্রধান মুফতির দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

১৯৮৭ সালে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ইন্তেকালের পর তিনি লালবাগ জামেয়ার পরিচালক এবং শায়খুল হাদিস নিযুক্ত হন।

২০০৩ সালে পান বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব। ইন্তেকালের আগ পর্যন্তই এই দুইটি মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদরাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনৈতিক জীবন

৮০র দশকের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত তিনি রাজনীতির সাথে কেনভাবেই সংযুক্ত ছিলেন না বলেই জানা যায়। স্বাধীনতার সময়ে তিনি হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর বিখ্যাত উক্তি “স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো জালিমের বিরুদ্ধে মজলূমের লড়াই” এর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন অর্থাত স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন আলেম ব্যাক্তিত্ব ছিলেন।

১৯৮৪ সালের দিকে তিনি রাজনৈতিক মতামত প্রদান শুরু করেন এবং ধিরে ধিরে এদেশের একজন প্রভাবশালী ইসলামি রাজনৈতিক ব্যাক্তিরুপে আবির্ভূত হন। তার রাজনীতিতে থিতু হওয়ার পেছনে হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর পূর্ণ প্রভাব এবং অনেকাংশে নির্দেশনা ছিলো বলেও জানা যায়। কারণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি প্রথমেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন

১৯৮৪ সালে ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে হাফেজ্জি হুজুরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শান্তি মিশনের সদস্য হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার মাধ্যমে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ‘খেলাফত আন্দোলন’র মাধ্যমে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। পরে তিনি ‘খেলাফতে ইসলামী’ নামে আলাদা একটি দল গড়েন এবং এর চেয়ারম্যান হন। তবে এ দল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বরং তিনি আলোচিত ছিলেন ‘ইসলামী ঐক্যজোট’র ব্যাণারে রাজনীতি করার মাধ্যমে।

১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর ৯১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি ইসলামী জোট গঠন করা হয়। এবং এই জোটই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ নামে পরিচিত। জোটের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামী দলগুলোকে একত্রিত করে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করা। সে সময়ে রাজনীতিতে থাকা ৭টি কওমি ধারার ইসলামি দল নিয়ে গঠন করা হয় এই জোট। জোটের দলগুলো ছিলো, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ফরায়েজী আন্দোলন ও ওলামা কমিটি। জোট গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ., মাওলানা ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহ., মাওলানা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা আশরাফ আলী ধর্মান্ডুলি, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ও মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ সাহেব।

প্রতিষ্ঠালগ্নে এর চেয়ারম্যান ছিলেন আল্লামা আজীজুল হক রহ. এবং সিনিয়র নায়েবে আমীর ছিলেন চরমোনাইর মরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.। বিএনপির সাথে জোটবেধে নির্বাচনে অংশ করার বিষয়ে রাজনৈতিক কিছু মতপার্থক্যের কারণে পরবর্তিতে তার দল তৎকালীন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন আলোচিত এই জোট ছেড়ে চলে যায়।

এরপর রাজনীতির নানা চড়াই উৎড়াই পার করার পর ১৯৯৭ সালে পুনরায় ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ. এবং মহাসচিব হন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট বেধে নির্বাচনে অংশগ্রহন করে বি-বাড়িয়া ২ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। এরপর ইসলামী ঐক্যজোট দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস রহ. কে বাদ দিয়ে এক অংশে মুফতি আমিনী সাহেব চেয়ারম্যান হন এবং মহাসচিব হন নেজামে ইসলামী পার্টির নির্বাহী সভাপতি মুফতি ইজহার অপর অংশে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক চেয়ারম্যান হন এবং এ আর এম আব্দুল মতিনকে মহাসচিব বানান। শায়খুল হাদিস রহ. এর বার্ধ্যক্য এবং মুফতি আমিনী রহ. এর তারুণ্য নেতৃত্বের কারণে তিনিই তখন জনমনে আস্থা অর্জন করে নেন। এছাড়াও ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সালে মৃত্যূদিন পর্যন্ত উনার কার্যক্রম শেষে উল্যেখ করা হচ্ছে। যে কার্যক্রমগুলোই মূলত মুফতি আমিনীকে এদেশের ইসলামী রাজনীতিতে “প্রতিবাদের প্রবাদ পুরুষ” হিসেবে চিত্রায়িত করেছে।

[এই বিভক্তি নিয়ে আরো কিছু বিশ্লেষণ থাকতে পারে তবে লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে বিধায় সেগুলো বিশ্লেষন করা গেলো না]

৯০র দশকের শুরু থেকে নিয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত মুফতী আমিনী বাংলাদেশের আলোচিত অনেক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সরব অংশ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে দুটি ঘটনা বিশেষ ভাবে উল্যেখযোগ্য।

  • ৯০ এর দশকের শুরুতে ১৯৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় উগ্র হিন্দু কর্তৃক বাবরী মসজিদ ধ্বংশ করার পর বাংলাদেশ থেকে বাবরী মসজিদ অভিমূখে লংমার্চ পালনের ডাক দিয়েছিলেন আল্লামা আজিজুল হক শায়খুল হাদিস রহ.। যে আন্দোলনে মুফতি আমিনী রহ. ছিলেন আজিজুল হক রহ. এর একান্ত সহযোগী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাবরী মসজিদের পক্ষে লংমার্চ কার্যক্রমের জন্য সফর করেছিলেন তিনি।
  • ১৯৯৪ সালে দুজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব শায়খুল হাদীস রহ. এবং মাওলানা ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাইর হাত ধরে ‘নাস্তিক বিরোধী’ আন্দোলনের প্রথম ধাপ “তসলিমা খেদাও” আন্দোলনের তিনি অনেক বড় ভুমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও নব্বইর দশকের আর একটি বৃহত আন্দোলন “কাদীয়ানী বিরোধী আন্দোলনে”ও আমিনী রহ. এর বড় অবদান ছিলো। মুলত এসব কার্যক্রমই একজন কওমী আলেমকে এদেশের রাজনীতিতে অম্লাণ হতে সাহায্য করেছিলো।

২০০১ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হবার পর আমিনী সাহেব ইসলামের পক্ষে জোড়ালো কন্ঠ হিসেবে আরো ব্যাপক পরিচিতি পান। ২০০১ সালের জানুয়ারী মাসে “ফতোয়া বিরোধী রায়” প্রকাশিত হলে ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিপক্ষে মাঠে জোড়ালো ভূমিকা রেখেছিলো চরমোনাই পীর সাহেব রহ. এর সংগঠন ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ এবং দেশের উলামায়ে কেরামরা। তখনকার বিএনপির সাথে নীতিগত জোটে থাকা এক শরিক দল জামায়াতে ইসলামী চুপ করে থাকলেও আর এক শরিক দল আমিনী রহ. এর ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে জোড়ালো কন্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং জামায়াতের চুপ থাকা নিয়েও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।

সে সময় তিনি এই রায় প্রদানকারী গোলাম রাব্বানীকে উদ্দিশ্য করে বলেছিলেন, ‘গোলাম রাব্বানী, তোমার বিরুদ্ধে মুরতাদ হওয়ার ফতোয়া দিয়েছিলাম, এবং মুরতাদ এর শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড” এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তখন চারমাসের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। [সূত্র: মাসিক আল কাউসার, বর্ষ-১ সংখ্যা-৯] এ ব্যাপারে এর বেশি গ্রহণযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

এরপর থেকে তিনি একে একে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জাতিয় পর্যায়ে প্রতিবাদের ধারা অব্যাহত রেখেছেন এবং কঠোর প্রতিবাদ করে গেছেন বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর থেকে তাদের ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমসহ বিএনপির প্রতি বিদ্ধেষমূলক অনেক কার্যক্রমের জোড়ালো প্রতিবাদ করে ‘আওয়ামী বিরোধী’ একটা গ্রহণযোগ্য এবং শক্ত ভূমিকা তৈরি করতে পেরেছিলেন। ২০১০ সাল এবং ২০১১ সাল ছিলো আমিনী রহ. এর জীবনে সবচেয়ে আলোচিত দুটি বছর। এই দুই বছরে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিলেন। অগ্নিঝড়া বক্তব্য এবং রাজনৈতিক আপোষহীনতায় তিনি অনন্য উচ্চতায় পৌছে গিয়েছিলেন, ২০১০ সালে প্রণীত বিতর্কিত ইসলাম বিরোধী শিক্ষানীতি এবং নারীনীতি আইনের বিপরিতে তিনি ছিলেন অগ্নীপুরুষ।

নারী পুরুষ সমানাধিকার আইনের বিপরিতে তিনি বলেছিলেন,

“শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার করে দেবে। কিন্তু কোরআনে বলা আছে, পুরুষ পাবে দুই ভাগ, আর মেয়ে পাবে এক ভাগ। সে (প্রধানমন্ত্রী) কীভাবে সমানাধিকার দেবে?” সরকার নারী-পুরুষের সমানাধিকার দেওয়ার জন্য হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করতে চায় বলেও অভিযোগ করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, ‘হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টকে বলে দিতে চাই। কোরআনের ওপর হাত দিলে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টকে আমরা মানব না।’

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন এবং জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে অস্বীকার করে রিট জারি করার বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁকে গ্রেপ্তার করলেও তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলবেন। তিনি নিজের কানে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা শুনেছেন। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম থাকবে না বলে মন্তব্য করেন আমিনী। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের নাম পরিবর্তন করে তারা (আওয়ামী লীগ) যা শিখিয়ে গেল, ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর নাম এক জায়গাতেও থাকবে না। বঙ্গবন্ধু এভিনিউও থাকবে না” [সূত্র: প্রথম আলো]

সংবিধান থেকে “আল্লাহ তায়ালার উপর পুর্ন আস্থা ও বিশ্বাস” এবং “বিসমিল্লাহ” উঠিয়ে দেয়ার পর তিনি কঠোর প্রতিবাদী হয়েছিলেন। এর বিপক্ষে তিনি ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল সর্বাত্মক হরতাল পালনের ডাক দিয়েছিলেন। যে হরতাল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সফল হরতালের মধ্যে একটি বলে বিবেচিত।

এরপর থেকেই তিনি মূলত আওয়ামীলীগের রোষানলে পড়েছিলেন এবং আওয়ামীলীগ বিভিন্ন উপায়ে মুফতি আমিনীর উপর চড়াও হওয়ার উপায় খুজতেছিলো। কার্যত মুফতি আমিনীর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর এবং আলেম সমাজে তার বিপুল জনপ্রিয়তাকে আওয়ামীলীগ সত্যিকারার্থেই ভয় পেতো।

কিন্তু ২০১১ সালের ১৪ জুলাই মুফতি ফজলুল হক আমিনী লালবাগের জামিয়া আরাবিয়া কোরানিয়া মাদ্রাসায় নিজ দলের এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, (আল্লাহ তায়ালার উপর পুর্ন আস্থা বিশ্বাস ও বিসমিল্লাহ উঠিয়ে দেয়ার মাধ্যমে) বাংলাদেশের সংশোধিত সংবিধানকে কেবল ছুঁড়ে ফেলা নয়, ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।

এই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই ১৫ জুলাই ২০১১ সালে এদেশের চিহ্নিত এক ভারত দালাল শাহরিয়ার কবিরের করা রিটের বিপরিতে মুফতি আমিনীর ব্যাপারে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় কিন্তু পরবর্তিতে সেই পরোয়ানা রহিত করে কার্যত উনাকে গৃহবন্দী করে ফেলা হয়। প্রায় দেড় বছরের গৃহবন্দী জীবন যাপন করেন তিনি। বাসা থেকে মাদ্রাসাতেই উনার জীবন সিমাবদ্ধ ছিলো প্রায় দেড় বছর।

ইন্তেকাল : 

২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর মুফতী আমিনী ঢাকার একটি হাসপাতালে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ মাঠে তার জানাজা শেষে তাকে জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় দাফন করা হয়। মৃত্যূর সময় তিনি পরিবারে এক স্ত্রী, দুই ছেলে ও চার মেয়ে রেখে গেছেন।

তার মৃত্যু নিয়ে “ইসলামী ঐক্যজোট” একাংশের বর্তমান মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের মূল্যায়ন ছিলো এরুপ,

“১১-১২-১২ ইং তিনি রুটিন অনুযায়ী লালবাগ জামেয়ায় আগমন করলেন। ইসলামী আইনবিভাগ (ইফতা বিভাগের) ছাত্রদের ক্লাস করলেন। বাদ আসর সহকর্মীদের সঙ্গে কথাবললেন। নির্দেশনা দিলেন। বাদ মাগরিব তিনি বুখারি শরীফের দরস দিলেন। বাদ এশা একজনের জানাজায় ইমামতি করলেন। ওই ব্যক্তির অসিয়ত ছিল মুফতি আমিনী সাহেব যেন তার জানাজা পড়ান। তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। সামনে-পেছনে পুলিশ বেষ্টনী। স্বয়ং তার গাড়িতে একজন পুলিশ। বাসায় গেলেন। খাওয়া-দাওয়া করলেন। ফ্রেশ হলেন। বললেন, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। মনে হয় গ্যাস জমেছে পেটে। পরিবারের পক্ষ থেকে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। মেডিসিন নিলেন। উত্তর দিকে মাথা পশ্চিম দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। বললেন, আমার নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। বুকে হাত দিলেন। উচ্চারণ করলেন সর্বশেষ শব্দ ‘আল্লাহ’। আস্তে করে চোখ বন্ধ করলেন। ১২-১২-১২ রাত ১২টা ২০ মিনিটে ডাক্তারের পক্ষ থেকে ঘোষিত হলো, মুফতি আমিনী আর নেই”
ইন্নালিল্লাহী ও ইন্না ইলাইহী রাজিয়ুন।

বিশিষ্ট ইসলামী লেখক ও ইসলাম টাইম টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক মাওলানা শরিফ মুহাম্মাদ তার ব্যাপারে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লেখেন,

‘মুফতী আমিনী রাহ.-এর বিশেষত্ব কী ছিল? তিনি একজন প্রজ্ঞাবান বড় আলেম ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী দুটি বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস ছিলেন। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে সরব একজন ইসলামী রাজনীতিক ছিলেন। তার পরিচয় এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গত দুই যুগ ধরে তিনি ছিলেন এদেশের ধর্মপ্রাণ-দেশপ্রেমিক মানুষ ও সর্বস্তরের আলেম সমাজের একজন প্রধান প্রতিনিধি। তিনি তাদের ভাই ছিলেন। তিনি তাদের দুঃখ ও দ্রোহের কণ্ঠ ছিলেন। তিনি তাদের বন্ধু, নেতা ও অভিভাবক ছিলেন। সঙ্কটকালে তার গমগমা কণ্ঠ আর হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন তারা। আহা! এত সুন্দর করে জনসভা ও মাহফিলগুলোতে ইসলামের অতীত গৌরব, বীরত্ব, আশাব্যঞ্জকতা, উদ্দীপনা, আল্লাহনির্ভরতা আর সাহসের পঙক্তিমালা তিনি উচ্চারণ করতেন যে মুহূর্তের মধ্যেই লাখো মানুষের ছায়াচ্ছন্ন, চিন্তাক্লিষ্ট চেহারায় প্রত্যয় ও আশ্বাসের রোদ হেসে উঠত। তিনি তার বক্তব্যে পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা পেশ করতেন। তিনি বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, গাজী নুরুদ্দীন জঙ্গি রাহ.-এর অমিত সাহসের ইতিহাস উচ্চারণ করতেন। শাহ ওয়ালি উল্লাহ, সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, কাসেম নানুতুবী ও শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহ.-এর জীবনব্যাপী সংগ্রামের দাস্তান শোনাতেন। শেখ সাদী, জালালুদ্দীন রূমী, আকবর এলাহাবাদী, ইকবাল, হালী, জিগার মুরাদাবাদী ও খাজা আজিজুল হাসান মজযুব রাহ.-এর শের আবৃত্তি করতেন। তার কণ্ঠের উঠানামায় লাখো মানুষের মজমা তরঙ্গের মতো দুলতে থাকতো। তিনি সাহসের কণ্ঠ ছিলেন। সংগ্রামের ময়দানে অবিচলতার পাহাড় ছিলেন’।

সংগ্রহ ও সম্পাদনা : হাছিব আর রহমান। নির্বাহী সম্পাদক, পাবলিক ভয়েস। 

মন্তব্য করুন