মসজিদ থেকে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১১:৩৮ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২১

আল আজহার কায়রোর প্রথম মসজিদ। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে একই নামে একটি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নানা ঘটনার সাক্ষী এই মসজিদ। ৯৭২ সালের ২৩ জুন এই মসজিদে প্রথম জুমা শুরু হয়। এই মসজিদ নিয়ে লিখেছেন আবু নুসাইবা

মিসরের কায়রোকে বলা হয় ‘হাজার মিনারের শহর।’ আল আজহার কায়রোর প্রথম মসজিদ। মসজিদটি ফাতেমীয় খলিফা আল মুইজ লিদিনাল্লাহ ৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল নির্মাণ শুরু করেন। ৯৭২ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হয় এবং ওই বছরের ২৩ জুন (রমজান মাসে) প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়।

প্রথমে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহার মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি বিশ^খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনা বিশে^র ইতিহাসে এটাই প্রথম।

মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর ৯৮৯ সালে স্থানীয়দের কোরআন-হাদিস ও ইসলাম বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্য ৩৫ জন আলেম নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে মসজিদটি ধীরে ধীরে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি মুসলিম বিশ্বে দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ শরিয়া বিষয়ক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে শিক্ষার্থীরা কোরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষা নেন। পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ফার্মেসি, মেডিসিন, প্রকৌশল, কৃষি, যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯৬১ সালে জাতীয়করণ করা হয় এবং স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর স্কলারশিপ পেয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান কয়েকজন শিক্ষার্থী। আল আজহার বিশ^বিদ্যালয়ের আলাদা ইতিহাস রয়েছে, সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ ।

কায়রো শহর জওহর আল সিকিলি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সিসিলি থেকে আগত গ্রিক বংশোদ্ভূত ফাতেমীয় সেনাপতি। তিনি ফাতেমীয় খিলাফতের পূর্ববর্তী রাজধানীর নামানুসারে এর নাম দিয়েছিলেন ‘আল মানসুরিয়া।’ ৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই মসজিদ ব্যবহৃত হয়।

তখনকার সাধারণ রীতি হিসেবে মসজিদটিকে ‘জামে আল মানসুরিয়া’ তথা ‘মানসুরিয়ার মসজিদ’ বলা হতো। খলিফা আল মুইজ লিদিনাল্লাহ শহরের নাম বদলে আল কাহিরা রাখেন। এরপর মসজিদের নাম ‘জামে আল কাহিরা’ তথা ‘কায়রোর মসজিদ’ বলা হয়।

মসজিদের বর্তমান নামটি খলিফা আল মুইজ থেকে মিসরের দ্বিতীয় ফাতেমীয় খলিফা আল আজিজ বিল্লাহর সময়কার। আজহার শব্দটি আরবি আজ জাহরা শব্দ থেকে এসেছে। ‘আজ জাহরা’ অর্থ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। হজরত মুহাম্মদ (সা).-এর কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-এর উপাধি ছিল এটি। এই উপাধির সঙ্গে মিল রেখে, তাকে উদ্দেশ্য করেই মসজিদটির নাম দেওয়া হয় ‘আল আজহার মসজিদ।’

৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ঈদুল ফিতরের সময় খলিফা কর্র্তৃক আল আজহারকে কায়রোর সরকারি জুমা মসজিদ ঘোষণা করা হয়।

এক হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে আল আজহার মসজিদ কখনো উপেক্ষিত হয়েছে, আবার কখনো গুরুত্ব পেয়েছে। এমনকি সরকারি বরাদ্দ বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে অনেক সময়। সঙ্গত কারণেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে আছে আল আজহার।

বিভিন্ন সময়ে আল আজহারের আলেমদের ওপর সরকারি নানাবিধ বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। কেউ তা মেনেছেন, অনেকে আবার বিদ্রোহ করে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। শুরুতে এখানে কোনো গ্রন্থাগার ছিল না। ১০০৫ খ্রিস্টাব্দের পর সেখানে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। মসজিদের নিজস্ব ছাপাখানা চালু করা হয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে।

১৯৫২ সালে মুহাম্মদ নজিব ও জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের বিপ্লবের পর মিসরের রাজতন্ত্র উৎখাত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় এবং মসজিদ পৃথক করা হয়। ১৯৫৫ সালে আধুনিক ক্যাম্পাসের জন্য মসজিদের চারপাশের স্থান অধিগ্রহণ করে পুরনো স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলা হয়। ১৯৬১ সালের আইনে আল আজহারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকাকে পৃথক করা হয়।

এই আইনে আল আজহারে ধর্ম-বহির্ভূত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জামাল আবদেল নাসের আল আজহারে বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি আল আজহারের আলেমদের প্রভাব খর্ব করে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে আল আজহারকে নবগঠিত ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ফলে মসজিদ তার নিজ অর্থনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনার দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কর্র্তৃত্ব প্রদর্শনে অক্ষম হলেও জনগণের মধ্যে আল আজহারের প্রভাব বজায় ছিল এবং একে জাতি ও রাষ্ট্রের ইসলামি চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাত মিসরের রাষ্ট্রপতি হন। নানা কারণে সমালোচিত আনোয়ার আল আজহারকে আরব বিশ্বে মিসরীয় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আরব বিশ্ব মিসর ও আল আজহার ছাড়া চলতে পারে না।’

১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার পর হোসনি মোবারক তার উত্তরসূরি হন। তার অধীনে আল আজহার পূর্বের চেয়ে একটু বেশি স্বাধীনতা পায়।

২০১১ মিসরীয় বিপ্লবের সময় আল আজহারের ওপর বিপ্লবের বিশাল প্রভাব পড়ে। মোহাম্মদ মুরসির পর প্রেসিডেন্ট সিসির আমলে বলতে গেলে কার্যত আজহারের তেমন কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় না। মাঝে আল আজহারের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি উঠলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

আল আজহার মসজিদের স্থাপত্যশৈলী মিশ্র। এতে প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে গ্রিক ও রোমানসহ নানা সময়ের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

প্রথমে শুধু একটি উঠোনসহ নামাজের স্থান নির্মিত হলেও পরবর্তীকালে মূল কাঠামোকে ঘিরে মসজিদের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। মিসরের অনেক শাসক আল আজহারের স্থাপত্যকে ভিন্নরূপ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে উসমানীয়দের গম্বুজ, মামলুকদের মিনার ও নতুন মিহরাব সংযোজন অন্যতম।

রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে আল আজহারে বেশ কয়েকবার তালা লাগনো হয়েছে, নামাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। তারপরও স্বমহিমায় উজ্জ্বল আল আজহার।

এটা শুধু পর্যটকদের কাছে নয়, চিন্তাশীল, গবেষকদের কাছে ভিন্নমাত্রার মসজিদ। যে মসজিদের উঁচু উঁচু মিনার থেকে শুধু আজানের ধ্বনি, মেহরাব থেকে বিপ্লব-প্রতি বিপ্লবের কথা নয় ভেসে আসে ঐতিহ্যের কথা, ইসলামি শিক্ষার-সংস্কৃতির কথা; মুসলিম উম্মাহর পুনর্জাগরণের কথা।

আকাশে মাথা উঁচু করে থাকা আল আজহার মসজিদের মিনার, নানা সময়ের করা অপূর্ব সব নকশা, ভেতরের কারুকাজ, দৃষ্টিনন্দন দরজা স্থাপন, আয়তন বড় করে মসজিদের চেহারা অদল-বদল করা হলেও আল আজহার আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছে সমকালে। কালের আবর্তনে আল আজহার শুধু চমৎকার ঝাড়বাতি লটকানো আর উন্নতমানের কার্পেট বিছানো সুবিশাল মসজিদ প্রাঙ্গণ নয়, এটা শুধু হাজারো মুসল্লিদের নামাজের স্থান নয় এটা দিনে দিনে পরিণত হয়েছে শিক্ষা, সভ্যতা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্র।

আইএ/

মন্তব্য করুন