
ইসমাঈল আযহার
পাবলিক ভয়েস
জিনজিয়াংয়ে বন্দি থাকা নিজের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাকিস্তানি ব্যবসায়ী জানান, ক্যাম্পে তাদের শূকরের মাংস ও অ্যালকোহল খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। কাজেই তার স্ত্রী এখন সেই নিষিদ্ধ বস্তু খাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে ছাড়া পেয়েছেন। যদিও এই অন্তরীণ ক্যাম্পকে চীন সরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে। ইসলামে নিষিদ্ধ এমন কার্যক্রম করতে ক্যাম্পের ভেতর তাদের বাধ্য করা হয়।
ফিরে এসেছেন বছর তিনেক আগে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়া এক উইঘুর মুসলিম নারীও। জানা গেছে, চীনা ধরপাকড় অভিযানে তাকেও আটক করা হয়। অনেক ধকল ও খেসারতের পর তিনি ছাড়া পেয়েছেন। ওই নারীর স্বামী বলেন, মুক্তি পেয়েছে, তবে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় চীনা প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের ৪০ উইঘুর মুসলিম নারী, যারা প্রতিবেশী পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের বিয়ে করেছেন, দেশটিতে অন্তরীণ ক্যাম্পে তাদেরও আটক করে রাখা হয়েছিল। খবর এএফপির।
ওই নারীর স্বামী আরও বলেন, তার স্ত্রী তাকে জানিয়েছেন- সে যদি কর্তৃপক্ষকে খুশি করতে পারে যে তার ভেতরে কোনো উগ্রপন্থী চেতনা নেই, তবে তিনি বাড়িতে ফিরে আসার সুযোগ পাবেন। ক্যাম্পে তাকে কোরআন ও নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে; তার বদলে ঘরে বিভিন্ন চীনা বই রাখতে হচ্ছে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাস তাদের স্ত্রীকে জিনজিয়াংয়ে রেখে নিজ দেশে ব্যবসায়িক কাজে যান। কেবল ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায়ও তাদের আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এর আগে আটক হওয়া কয়েকজন বলেন, বোরকা পরা ও দাড়ি রাখার মতো ইসলামী ঐতিহ্য মেনে চলার কারণে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক উইঘুরসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিরাপত্তা ধরপাকড়ে তাদের আটক করা হলেও আন্তর্জাতিক নিন্দা ও পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার স্বার্থে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত দুই মাস ধরে ধীরগতিতে তারা একে একে ছাড়া পাচ্ছেন।
কয়েক নারীর স্বামী অভিযোগ করেছেন, তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও তিন মাসের জন্য জিনজিয়াং থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। এ সময় তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এক রত্নপাথর ব্যবসায়ী বলেন, চীনা সমাজের সঙ্গে তারা কতটা খাপ খেতে পেরেছেন, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি কর্তৃপক্ষের মনে হয়, সমাজের সঙ্গে তারা এখনও মিলে যেতে পারেননি, তবে ফের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। এই শর্তেই তারা ছাড়া পেয়েছেন বলে তিনি জানান।
মুক্তি পাওয়ার প্রাথমিক আনন্দ খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি তাদের। ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার পর তাদের প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও মায়েদের দেখতে একেবারে অদ্ভুত লাগছে। বলেন, আমার স্ত্রী জানিয়েছেন- ক্যাম্পের ভেতর খোলামেলা পোশাক পরে তাকে নাচতে বাধ্য করা হয়েছে। শূকরের মাংস ও মদ খাওয়ানো হয়েছে। এর পর তার হাতে একটি নির্দেশনাপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। ছবি আকারে ছাপানো ওই নির্দেশনাপত্রে মসজিদে লাল ক্রসচিহ্ন দিয়ে চীনা পতাকায় সবুজ চিহ্ন দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কোনো নারী মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন। কেউ তাদের আচরণ নিয়ে সরকারকে রিপোর্ট করতে পারে আশঙ্কায় ভুগছেন তারা। ওই ব্যবসায়ী বলেন, সবচেয়ে খারাপ দিকটি হচ্ছে, তার নীরবতা। সে সবাইকে সন্দেহ করছে। তারা বাবা-মা, পরিবার এবং আমাকেও।
সে একসময় নিয়মিত নামাজ পড়ত, কিন্তু এখন সেই অভ্যাস নেই। মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁয় গিয়ে সে মদ খাচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষ নারীদের কাছ থেকে এমন আচরণই প্রত্যাশা করছে।’ অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জেইমস লেইবোল্ড বলেন, জিনজিয়াংয়ে চীনা সরকার নজরদারি জোরদার করেছে। নিজেদের সক্ষমতায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
মুসলিম ঐতিহ্যবাহী জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর জনগোষ্ঠীর বসবাস হাজার বছর আগে থেকে। সেখানে বরং বর্তমান চীনা সম্প্রদায়ই (যারা প্রধানত হান গোষ্ঠীর) বহিরাগত ও জবরদখলদার। মুসলমানদের স্বর্ণযুগে, ‘পূর্ব তুর্কিস্তান’ নামে অতীতে সুপরিচিত জিনজিয়াংয়ের কাশগড়, ইয়ারকন্দ, খোটান প্রভৃতি স্থান শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্যের সুবাদে বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। গত কয়েক দশক জিনজিয়াংয়ের সংখ্যাগুরু উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়ন এবং বঞ্চনা বৈষম্যের সম্মুখীন। এটা বলা চলে যে, তারা ইসলামি ধর্মবিশ্বাস তথা মুসলিম পরিচয় এবং স্বকীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মূল্যবোধের কারণেই নানাভাবে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছেন।
আইএ/পাবলিক ভয়েস

