

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার বিভিন্নস্থানে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে “হিজড়া সম্প্রদায়”
হিজড়া। তৃতীয় লিঙ্গে জন্ম নেওয়া একদল মানুষ। শারিরিক দেহ গঠনে তারা সম্পূর্ণ সুস্থ ও সবল। যে কোনো কাজ তারা অন্যসব মানুষের মতোই করতে পারে। কেবল সন্তান জন্ম দেওয়াসহ নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক ও মানবদেহের ভেতরগত কিছু বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে তাদের।
হিজড়াদের প্রতি দয়া দেখিয়ে তাদের দৈহিক এই সমস্যার কথা বিবেচনা করে মানুষ তাদের সাহায্য সহযোগীতা দিয়ে জীবন চলার পথ করে দিয়েছে। কোনো কাজ কর্ম না করে মানুষের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েই চলে তাদের জীবন যাপন। কিন্তু এই দয়াই এখন সাধারণ মানুষের জন্য ভয়ানক বিপদ হয়ে দাড়িয়েছে। “বিনা কষ্টে উপার্জন” এর এই পথকে তারা ব্যবসা হিসেবে নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন যেন অস্থির করে তুলছেন।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে; সম্প্রতি ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষদের টার্গেট করে সম্মিলিতভাবে মাঠে নেমেছে হিজড়া সম্প্রদায়। যাদেরকে মনে হয় তারা রাজধানী ছেড়ে বাড়ি যাচ্ছে তাদের ওপরই তারা হামলে পড়ে। মোবাইল, মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে বিভিন্ন স্থানে।
রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশ ও বহির্গমন পথে তারা ওঁৎ পেতে বসে থাকে এবং সাধারণ মানুষকে চরমভাবে বিরক্ত ও হেনস্থা করে টাকা আদায় করছে। বিশেষ করে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষই তাদের প্রথম টার্গেট। এমনকি টাকাও তারা নির্দিষ্ট করে দেয়। ১০/২০ টাকায় হবে না বরং ১০০ টাকার নিচে তাদের দেওয়া যাবে না।
কেউ টাকা দিকে অস্বিকার করলে তার ওপর নেমে আসে চরম লজ্জাজনক পরিস্থিতি। চড়, থাপ্পড়, গায়ে হাত দেওয়াসহ “নিজেদের কাপড় খুলে নগ্ন হয়ে” পর্যন্ত মানুষকে হেনস্তা করে তারা। তাই লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই তাদের চাহিদামতো টাকা দিয়ে দেয়।
মূলত হিজড়াদের এসব চাঁদাবাজী তাদের স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য না। এসবে রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। চাঁদা আদায়ের শৃঙ্খলার জন্য রাজধানীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছে তারা। এক-একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন হিজড়াদের এক-একজন নেতা। একজনের স্থানে অন্যরা যখন চাঁদা আদায় করতে যান তখনই দুই গ্রুপের মধ্যে বিপত্তি দেখা দেয়।
এ ছাড়াও আদায়কৃত চাঁদার টাকা নিয়েও সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তারা। ঘটছে গুলির ঘটনাও। প্রতি মাসে রাজধানী থেকে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকেন হিজড়ারা। হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণকারী নেতারা বিলাসী জীবন-যাপন করেন। তারা নিজ অনুসারীদের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করেন। চাঁদা আদায় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হিজড়াদের বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে।
আদায়কৃত চাঁদায় ভাগ বসাতে স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। অবৈধভাবে অস্ত্রও সংগ্রহ করে তারা। কখনও কখনও সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে তাদের মধ্যে। প্রতি মাসে এক একটি গ্রুপ চাঁদাবাজীসহ বিভিন্নভাবে কোটি টাকা আয় করে থাকে বলে হিজড়া সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কাওরানবাজারের এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, প্রায়ই তাদের ব্যাংক ঘেরাও করে হিজড়ারা। মনে করে ব্যাংকে টাকা আছে, ঘেরাও করলেই তাদের দিয়ে দেয়া হবে। বুঝানোর পরও তারা বুঝতে চায় না। নিজ পকেট থেকে টাকা দিয়ে তাদের বিদায় করতে হয়। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব বিব্রত। একই অভিযোগ করেন ফার্মগেইটের পাঞ্জাবি ডটকমের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শামীম।
তিনি জানান, হিজড়ারা প্রায়ই মার্কেটে চাঁদা আদায় করতে যায়। না দিলে যেতে চায় না। দোকানের সামনে বসে থাকে। ঝামেলা এড়াতে টাকা দিয়েই তবে বিদায় করতে হয় তাদের। হিজড়ারারা শুধু মার্কেটে না তারা রাস্তাঘাটেও চাঁদা আদায় করে থাকেন। মতিঝিল, গুলিস্তান, বাবুবাজার, সদরঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, রামপুরা, খামারবাড়ি, মিরপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত চাঁদা আদায় করে থাকেন তারা।
সব মিলিয়ে ঢাকায় হিজড়াদের মাসিক চাঁদার পরিমাণ কত তা নির্দিষ্টভাবে কেউ জানাতে পারেননি। তবে কোনো কোনো সূত্রমতে, পুরো রাজধানী থেকে মাসে কোটি আয় করে থাকেন হিজড়ারা। এই টাকায় ভাগ বসান স্থানীয় অনেক সন্ত্রাসী। তারা বিভিন্নভাবে হিজড়াদের সঙ্গে মিশে গেছেন। অনেক সন্ত্রাসী রয়েছেন যারা হিজড়াদের বয়ফ্রেন্ড হিসেবে তাদের সঙ্গে বসবাস করেন।
সূত্রে জানা গেছে, হিজড়াদের এক নেত্রীর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে তার সঙ্গে থাকেন আরমান নামের এক যুবক। ওই যুবক এক সময়ে যাত্রাবাড়ীর এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়াও অনেকে ছদ্মবেশ ধারণ করে হিজড়া নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
আধিপত্য বিস্তার ও নিজেদের গ্রুপের শক্তি প্রদর্শনের জন্য হিজড়া নেতারা অস্ত্র সংগ্রহে রাখেন। এ ছাড়াও তাদের সঙ্গে সখ্যতা থাকে অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের। হিজড়াদের একটি গ্রুপ মাদক বিক্রয়েও সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে হিজড়া নেতা আবুল জানান, অনেকেই অনেক খারাপ কাজ করছে। টাকা উত্তোলনের নামে চাঁদাবাজি, ছিনতাই করছে। মাদকও বিক্রি করছে বলে শুনেছি। তবে কারা এতে জড়িত তা জানা নেই বলে জানান তিনি।
হিজড়া নেতাদের অনেকেই অঢেল সম্পত্তির মালিক। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। পুরান ঢাকায় মেসবাহ হিজড়ার অধীনে রয়েছে অর্ধশত হিজড়া। নানা ধরনের চাঁদাবাজি, অনৈতিক কাজই তাদের আয়ের উৎস।
খিলক্ষেত এলাকায় নাজমার অধীনে রয়েছে অন্তত ৩৫ হিজড়া। তার রয়েছে বিপুল টাকা। বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে সুদে টাকা দিয়ে থাকেন নাজমা। একইভাবে আরামবাগের আবুল হিজড়ার রয়েছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের দুটি বাড়ি।
দক্ষিণ গোড়ান সিদ্দিকবাজার এলাকার ময়না হিজড়ার রয়েছে বিলাস বহুল বাড়ি। খিলগাঁও এলাকার মাদক বিক্রেতা রেখা ও ফাতেমার সঙ্গে ব্যবসায় জড়িত ময়না হিজড়ার গ্রুপটি। এমনকি এসব বিষয়ে কোনো সংবাদ পরিবেশন হলে তারা তাদের গ্রুপের নাম ও এলাকা পরিবর্তন করে ফেলার ঘটনাও ঘটে থাকে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, অপরাধী যেই হোক অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু হিজড়াদের অপরাধ নিয়ে কেউ তেমন কোনো অভিযোগ করেন না বলে জানান তিনি।
/এইচআরআর