
এই পৃথিবীতে প্রতিটি পদক্ষেপই আমাদের জন্য পরীক্ষা। অর্থনৈতিক, শারীরিক, ভালোবাসার কাউকে হারিয়ে ফেলা কিংবা দাম্পত্য সম্পর্ক ভঙ্গ- ‘চলার পথে এরূপ নানাবিধ তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের’।
তবে একজন মু’মিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে কখনোই দিশেহারা হয় না। কারণ সে জানে, সবকিছুই আল্লাহ তা’য়ালা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আল্লাহ তা’য়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তিনি তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে বেশি বেশি পরীক্ষা করেন।
আল্লাহ তা’য়ালা সূরা বাকারার ১১৫ নং আয়াতে বলছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এবং কর্মফলের মাধ্যমে পরীক্ষা করবো। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। যারা বিপদগ্রস্ত হলে বলে, আমরা আল্লাহর জন্য, আর তাঁর নিকটই আমাদের প্রত্যাবর্তন’।
যখন কেউ প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলে, অথবা অন্য কোনোভাবে বিপদগ্রস্ত হয়, তখন আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বিনা অভিযোগে তা মেনে নিতে হয়। যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করে বিপদে আপদে আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য কামনা করে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হয়; আর যে বিপদে ধৈর্যহারা হয়ে অভিযোগ করতে থাকে, সে বিনিময়ে কিছুই পায় না।
ইসলাম বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছে। যেমনটি হযরত আইয়ুব আ. এর জীবনী থেকে জানা যায়। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে এক দূরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জিহ্বা ছাড়া তাঁর শরীরের কোনো অঙ্গই ভালো ছিলো না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে, তাঁর সকল আত্মীয়-স্বজন আক্রান্ত হবার ভয়ে তাঁর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলো; এবং তাঁকে শহর থেকে বের করে দিলো। শুধুমাত্র তাঁর একজন স্ত্রী তাঁর সঙ্গে থাকলো।
এই ভয়ানক বিপদে থেকেও, আইয়ুব আ. ধৈর্যহারা হননি; বরং সর্বদা আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। দীর্ঘদিন একই অবস্থা দেখে একদিন তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, আপনি কেনো আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন না? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে দীর্ঘ ৭০ বছর ভালো রেখেছিলেন, আর এখন বিপদগ্রস্ত হয়ে আমি আল্লাহ তা’য়ালার নেয়ামত ভুলে গিয়ে ধৈর্যহারা হবো?
অবশেষে আইয়ুব আ. আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করলেন,
أني مسني الضر وأنت أرحم الراحمين
অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি বিপদগ্রস্ত। আর আপনি সর্বাধিক দয়ালু। সূরা আম্বিয়া: ৮৩
অতঃপর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন। এ ব্যাপারে সূরা আম্বিয়ার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলছেন, ‘অতঃপর আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, এবং তার দুর্দশা দূর করে দিলাম। তাকে তার পরিবারবর্গ ফিরিয়ে দিলাম। এবং আমার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ আরও দিলাম’।
কোরআনের আলোকে ধৈর্যের গুরুত্ব
ধৈর্য সম্পর্কে কোরআনে কারীমে অসংখ্য আয়াত বর্ণিত হয়েছে।
এক আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’। সূরা বাকারা: ১৫৩
অন্যত্র আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো। তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করো না, এতে করে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, এবং তোমাদের শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন’। সূরা আনফাল: ৪৬।
আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং ধৈর্য ধারণে প্রতিযোগিতা করো’। সূরা আলে ইমরান: ২০০
হাদীসের আলোকে ধৈর্য
ধৈর্য সম্পর্কে হাদীসেও বহু রেওয়ায়েত পাওয়া যায়।
আনাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- ‘‘আমি যদি আমার কোনো বান্দাকে তার দুটি প্রিয় জিনিস (দুই চোখ) থেকে বঞ্চিত করি, আর এতে সে যদি ধৈর্যশীল থাকে, তাহলে ওই দুটির বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করবো’’। বুখারী: ৫৬৫৩
আরেক হাদীসে এসেছে,
আবূ হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘আমার মু’মিন বান্দার জন্য আমার নিকট জান্নাত ব্যতীত অন্য কোনো পুরস্কার নেই, যখন আমি তার দুনিয়ার প্রিয়তম কাউকে কেড়ে নই এবং সে সওয়াবের নিয়তে সবর করে’’। বুখারী: ১২৮৩
সুতরাং বিপদগ্রস্ত হয়ে যখন মনে হয়, আর কোনো আশা নেই, তখন ধৈর্যধারণ করে আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা যথাসময়েই বিপদ দূর করে দেবেন, আর ধৈর্যধারণের জন্য দেবেন দ্বিগুণ পুরস্কার।
লেখক: ফরহাদ খান নাঈম
তরুণ আলেম ও এক্টিভিটিস্ট

