
ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনবিরোধী প্রতিবাদে সামিল হয়ে সব থেকে বেশিসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে উত্তর প্রদেশে। ঘটনা তদন্তে গঠিত এক স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, বিক্ষোভকারীকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি চালিয়েছে সেখানকার পুলিশ।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ সেখানে প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হচ্ছে। হাজার হাজার মুসলিমকে আটক ও পুড়িয়ে মারার হুমকির পাশাপাশি তাদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হচ্ছে। বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ ও সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিতর্কিত অবস্থান ও বক্তব্যে নিন্দার ঝড় বইছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাবি করেছে, বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সময় পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে তারা।
গত ১২ ডিসেম্বর অনুমোদন পাওয়া ভারতের সংশোধিত আইনে প্রতিবেশি তিন দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সংঘটিত বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৯ জনই উত্তর প্রদেশের।
রাজ্যের ৬ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে বন্দি করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে সহিংস বিক্ষোভে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে।
উত্তর প্রদেশে নিহত ১৯ জনের একজন হলেন বিজনোর শহরের বাসিন্দা সুলেমান হুসাইন (২০)। তার বাবা জাহিদ হুসাইন কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘২০ ডিসেম্বর নামাজ শেষে সুলেমান যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লাঠিচার্জ শুরু করে। সবাই দৌঁড়ে পালালেও সে অসুস্থ থাকায় পারেনি। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে এবং গুলি চালায়।’
বিজনোরের পুলিশ কর্মকর্তা অরুণ কুমার গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করেননি। তবে দাবি করেছেন, আত্মরক্ষার স্বার্থে ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘সেখানে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের আশঙ্কা ছিল। আমরা যদি সেখানে সময়মতো না পৌঁছাতাম তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারতো।’
বিজনোরের বাসিন্দারা জানিয়েছে, পুলিশ তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন নামের একজন আল জাজিরাকে বলেছেন, পুলিশ দরোজা ভেঙে আমার পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত ভাই শামসুদ্দিনের বাড়িতে প্রবেশ করে। সবাইকে লাঠিপেটা করে।
তিনি বলেন, ‘দরোজা ভেঙে তাকে টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায় এবং পেটায়। সে এখন কারাবন্দি।’ জাহিদ বলেছেন, ‘সেখানে ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করায় অনেকেই দরোজা বন্ধ করে বাড়ির মধ্যে অবস্থান করছে। পুলিশি নৃশংসতার কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।’
সদ্য প্রকাশিত এক ভিডিওতে দাঙ্গা পোশাক পরিহিত পুলিশ কর্মকর্তাকে দুই বেসামরিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। টুপি পরিহিত ওই ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘কোথায় যাবে? এই গলি আমি ঠিক করে দেবো।’
আলাপরত ব্যক্তিরা নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা জানালে পুলিশ কর্মকর্তা তখন বলেন, ‘এখানে যারা কালো ও নীল ব্যাজ পরে আছে তাদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলো।’ তখন আরেক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘সব কটাকে পুড়িয়ে দিতে এক সেকেন্ড লাগবে।’
পরে পুলিশ কর্মকর্তা অখিলেশ নারায়ণ সিং মুসলিমদের উদ্দেশে বলেন, ‘খাবে এক জায়গার, আর প্রশংসা করবে অন্য জায়গার। ভারতে থাকতে না চাইলে পাকিস্তানে চলে যাও।’
উপস্থিত দুই ব্যক্তি ‘ঠিক বলেছ’ বলে চলে যেতে উদ্যত হলে আবারও ফিরে আসেন পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, ‘আমি প্রতিটি বাড়ির সবাইকে জেলে পাঠাবো।’ পরে অখিলেশ নারায়ণ সিং ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে দাবি করেছেন, বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছিল বলে তাদের পাকিস্তানে যেতে বলেছেন।
এর আগে বিক্ষোভে সহিংসতার ঘটনায় ‘বদলা’ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। এই সপ্তাহের শুরুতে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, সরকারি সম্পদ যারা ভাঙচুর করেছে বা আগুন ধরিয়েছে, হামলাকারীদের সম্পত্তি নিলাম করেই সেই অর্থ উসুল করা হবে।
এই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নেবো।’ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে মোট ৪৯৮ জনকে শনাক্ত করেছে উত্তর প্রদেশ পুলিশ। এদের মধ্যে শুধু মিরাটেই রয়েছে ১৪৮ জন। বৃহস্পতিবার পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে মোট এক হাজার ১১৩ জনকে আটক করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গত শুক্রবার প্রশাসনের হাতে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৫০৭ টাকার ডিমান্ড ড্রাফট তুলে দেয় স্থানীয় মুসলমানেরা।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কার্যালয়ের অফিসিয়াল টুইটে বলা হয়, ‘সব দাঙ্গাকারী ভয় পেয়েছে। সব সমস্যা সৃষ্টিকারীও ভয় পেয়েছে। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের কঠোরতায় সবাই চুপ হয়ে গেছে।’ এর পরে ওই টুইটারে হ্যাশট্যাগ দ্যগ্রেট-সিএমযোগী বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে।
কংগ্রেসের মুখপাত্র নওয়াব মালিক বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, মানুষের বিক্ষোভের অধিকার রয়েছে। দেশের অন্য অংশের বিক্ষোভকারীরা শান্ত থাকলেও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ধর্মের ভিত্তিকে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দিয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পুলিশ সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে। উত্তর প্রদেশ ঘুরে আসা অনুসন্ধানী দলের সদস্য অ্যাক্টিভিস্ট কবিতা কৃশান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মুসলিম কলোনির মানুষেরা রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। তারা পুলিশি অভিযান বা সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কায় ভীত।’
আল জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তর প্রদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করতেই সেখান থেকে যারা ঘুরে এসেছেন এবং দিল্লির উত্তর প্রদেশ ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করছেন তাদের বন্দি করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিরীহ বিক্ষোভকারীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং পুলিশি বর্বরতার অভিযোগ তদন্ত করতে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
আই.এ/

