
ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই চীনের এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। আরব সওদাগরেরা চীনে আসতে শুরু করার সাথে সাথে ক্রমেই আরো বেশি সংখ্যায় মুসলমান চীনে আসতে থাকে। তাদের মধ্যে অনেকে চীনেই বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। জিনজিয়াংয়ের আদি বাসিন্দা হচ্ছেন উইঘুররা। তারা ইসলামে বিশ্বাসী। উইঘুররা জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে তুর্কিঘনিষ্ঠ। চীনের অন্যসব এলাকার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী হান জাতিগোষ্ঠী ও তার শাসকদের থেকে উইঘুররা সম্পূর্ণ আলাদা।শত বঞ্চনা ও নির্যাতন সত্ত্বে¡ও অধিকারহারা উইঘুররা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আঁকড়ে ধরে আছে শত শত বছর ধরে।
চীনের সব সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিম ২০ শতাংশ, যার ৯০ শতাংশই হুই ও উইঘুর মুসলিম। ৫৮.২ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশে ২৪ হাজার মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে ৭০০ বছরের পুরনো মসজিদও রয়েছে। এখানে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস ১৩০০ বছরের বেশি পুরনো।
উইঘুরদের মূল পরিচয়, এটি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথেও সংয্ক্তু। চীন কর্তৃপক্ষ উইঘুরদের এই ধর্মীয় পরিচয়টিকেই মুছে ফেলতে চাইছে। তারা বিশ্বাস করে, এর ফলে কেবল স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাই নষ্ট হবে না, বরং ব্যাপক পরিসরে জাতিগত নিশ্চিহ্নের পথে পড়বে উইঘুররা।মূলত ইসলাম পালনের কারণেই উইঘুররা এ ধরনের নির্যাতনের মুখে পড়ছে। কিন্তু ইসলাম কিভাবে দোষী, তার জবাবে বলা হচ্ছে, এই অঞ্চলে ইসলামপন্থীরা সহিংসতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত। বেশ কিছু দিন ধরেই চীন ইসলামকে ‘মানসিক অসুস্থতা’, অনেক ক্ষেত্রে ‘আদর্শগত অসুস্থতা’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জিনজিয়াংয়ে মুসলিম ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর জন্য তাদের কর্মক্ষেত্র এমনকি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালায়।
কিছু দিন আগে অল্পবয়সী উইঘুরদের ধর্মীয় শিক্ষার্জনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সব মিলিয়ে বন্দিশিবির ছাড়াও কয়েক বছর ধরে যেন পুরো জিনজিয়াংটিই একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে। ইসলাম ও মুসলিম ধ্বংসের নীল-নকশা আগে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিমরা স্বাধীনভাবেই তাদের ধর্ম পালন করতে পারতেন। জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে চীনের নীতিতে যেন পরিবর্তন আসে। বিভিন্ন স্থানে বন্দিশিবির স্থাপন করা হয়, যেগুলোকে তারা দীক্ষাদান কেন্দ্র হিসেবে পরিচয় দেয়।
মানসিক (ইসলাম) রোগের কারণে এসব শিবিরে বন্দীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে মুসলমানদের শুকর খেতে ও মদ্যপান করতে বাধ্য করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গীত মুখস্ত করতে ও গাইতে, মান্দারিন ভাষা শিখতে এবং নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে তাদেরকে বের করে আনতে যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ ছাড়া উইঘুর নারীদের বাধ্য করা হয় ভিন্ন ধর্মের হান পুরুষদের বিয়ে করতে।
শুধু এ বন্দিশিবিরের কারণে উইঘুর মুসলমানদের ১০-২০ শতাংশ লোক তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে উইঘুরদের মধ্যে যেমন এ বন্দিশিবিরের বিষয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, কখন কাকে ধরে নিয়ে যায়, তেমনি এ শিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও সমাজে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সরকারের গুপ্তচরবৃত্তির চাপ থাকায় শিক্ষক-ছাত্র, ভাইবোন, প্রতিবেশী কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
চিন্তিত পরবর্তী প্রজন্ম নিয়েও চীন কর্তৃপক্ষ যে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক উইঘুরদেরই তাদের লক্ষবস্তু বানিয়েছে, বিষয়টি তেমন নয়, বরং তারা উইঘুরদের পরবর্তী প্রজন্মের দিকেও তারা হাত বাড়িয়েছে। তারা বিভিন্ন বয়সের উইঘুর শিশুদের সরকারি আশ্রমে লালনপালন করে নিরিশ্বরবাদ, মান্দারিন ভাষা ও হ্যান সংস্কৃতি শেখানো হচ্ছে। এসব শিশুকে তাদের মা-বাবার বিরুদ্ধে নজরদারির কাজেও লাগাচ্ছে চীন কর্তৃপক্ষ।
তারা কোনো ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে কি না, সে বিষয়ে গুপ্তচরের মতোই ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের। এখন করণীয় ৪ সেপ্টেম্বর একটি টুইট ভাইরাল হয়ে যায়। টুইটে বলা হয়েছিল, আমরা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা বিশ্বকে আমাদের পরিচয় জানাতে অপেক্ষা করছি। টুইটটি করেছিল ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী এক উইঘুর ছাত্র। সে পরবর্তীতে চীনের ওই সব বিশেষ ক্যাম্পে আটক থাকা তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুদের মানবেতর জীবন যাপনের বর্ণনা দেয়।
তার অনুযোগ ছিল, বিশ্বজুড়েই মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এ খবর প্রকাশ করে না। আর করলেও তা গুরুত্বের তুলনায় অতি সামান্য। সবক্ষেত্রে হয়তো এর জন্য উদাসীনতা দায়ী নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এ সম্পর্কে অবগতই নয়। চীনে উইঘুর মুসলিমদের শাস্তি দেয়ার সময়ই কর্তৃপক্ষ এমন দক্ষতার আশ্রয় নেয়, যাতে কোনোভাবেই তা প্রকাশ না পায়। বরং দেশটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও উগ্রপন্থার বিষয়গুলো বর্ণনার সময় উইঘুর মুসলমানদেরই এর জন্য দায়ী করা হয়।
কিন্তু আসলে তারা কারা? তারা তো কোনো অপরাধী নয়, বরং তারা গর্বিত মুসলমান, যাদের একমাত্র দোষ হলো, তারা এমন এক স্থানে বসবাস করে যে স্থান সব সময় তাদেরই ছিল এবং তারা এমন এক বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কথা প্রকাশ করে, যা তাদের হৃদয়ে প্রোথিত। চীন সরকার এখন খুব জোরেশোরেই উইঘুর মুসলমানদের তাদের পরিচয় প্রত্যাখ্যান করতে, বিশ্বাস ভুলে যেতে চাপ দিচ্ছে। এখনো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। এখনো সময় আছে উইঘুর সম্পর্কে জানার এবং বিশ্বের পরবর্তী মানবিক বিপর্যয় থেকে তাদেরকে রক্ষা করার।

