
নোবেল শান্তি পুরস্কার আর বিতর্ক, এ দুটো যেন হাত ধরাধরি করেই হাঁটছে। সারা বিশ্বের মানুষ অক্টোবর এলেই ক্ষণ গুণতে শুরু করে কবে ঘোষণা হবে শান্তি পুরষ্কার বিজয়ীর নাম। কে নোবেল পাবে, কেন পাবে তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। আর চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণার পরই শুরু হয়ে যায় সমালোচনা। সেই ১৯০১ সালে হেনরি ডুনান্ট থেকে শুরু করে সর্বশেষ আবি আহমেদ, একটু আধটু সমালোচনা সবাইকেই নিয়েই হয়েছে, খোঁজা হয়েছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।
কিন্তু এর মধ্যেও কয়েকজন আবার আছেন, যাদের নোবেল জয় নিয়ে বয়ে গেছে বিতর্কের ঝড়। হয়েছে প্রতিবাদও। অনেক নোবেলজয়ী আবার মানুষের জন্য কাজ করে জনপ্রিয় হয়ে, পরবর্তীতে হেঁটেছেন ভিন্ন পথে। প্রশংসিত থেকে হয়েছেন ঘৃণিত। শান্তির নোবেলকে যারা কলঙ্কিত করেছেন, তাদের নিয়েই এই প্রতিবেদন-
অং সান সু চি
নরওয়ের নোবেল কমিটি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৯১ সালে। এটা নিয়ে শুরুতে কোনো বিতর্ক ছিল না। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার নির্ভীক অবস্থান ও গণতন্ত্রের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য সারা বিশ্বেই সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ক্ষমতায় এসেই চেহারাটা পালটে যায় সু চির। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইন বৌদ্ধদের চলমান সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে হাজারো বাড়িঘর। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় নির্বিকার। সু চির এই ভূমিকায় তার সমালোচনা যারা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুও। তার শান্তি পুরষ্কার কেড়ে নেওয়ারও দাবি উঠছে কয়েক বছর ধরে।
হেনরি কিসিঞ্জার
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে নোবেল প্রদানের প্রতিবাদে নোবেল কমিটির দুজন সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধে তার অবস্থান ও কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানী সকলেরই জানা।
১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পান। যে প্রচেষ্টার জন্য তারা এই পুরস্কার পান, সেটা ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। থো এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তার অভিযোগ ছিল, ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
মেনাচেম বেগিন
শান্তিতে বিতর্কিত নোবেল বিজয়ীদের মাঝে অন্যতম ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেনাশিম বেগিন। ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি সই করে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল জয় করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে নোবেল জয়ের মাত্র চার বছর পর অর্থাৎ ১৯৮২ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর নির্দেশ দেন বেগিন। এতে নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ। আর বাস্তুচ্যুত হয় কয়েক লাখ।
রিগোবার্তা মেঞ্চু
গুয়াতেমালা থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে গিয়েছিলেন রিগোবার্তা মেঞ্চু। এই অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে একটি বই লিখেছিলেন তিনি। যেখানে উঠে এসেছিল গুয়াতেমালার বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন এবং মানুষের সংগ্রামের বর্ণনা। এজন্য তাকে শান্তিতে নোবেল প্রদান করা হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় বেরিয়ে আসে তার বইয়ের বর্ণনা মিথ্যা, ভুল ও বানোয়াট তথ্যে ভরা। এজন্য এখনও অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে, মেঞ্জু আসলেই কি নোবেল শান্তি পুরষ্কারের যোগ্য?
আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজ
অসলো চুক্তির জন্য ১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদী নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল জয় করেন ইসরায়েলি নেতা আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজ। তবে পুরস্কার জয়ের কিছুদিন পরই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, চুক্তি করলেও আরবদের ওপর নিপীড়ন থামাবার কোনো ইচ্ছাই ইসরায়েলের নেই। ফলে আইজ্যাক রবিন ও শিমন পেরেজের নাম নোবেল জয়ীদের তালিকাকে কালিমালীপ্ত করেছে।
মিখাইল গর্বাচেভ
শীতলযুদ্ধের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখায় ১৯৯০ সালে শান্তিতে নোবেল পান সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ। অথচ এর এক বছর না পেরোতেই বাল্টিক দেশগুলোর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মাটিতে মিশিয়ে দিতে দেশগুলোতে সামরিক ট্যাংক পাঠান তিনি। শেষ পর্যন্ত দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু শান্তির নোবেল জয়ের পর অশান্তির পথে হেঁটে সমালোচিত হয়েছেন মিখাইল।বাংলা ইনসাইডার।

