অহংকারের পরিণতি

প্রকাশিত: ৮:৩৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২০, ২০১৯

মুফতী সাঈদ আহমাদ

অহংকার হল আত্মিক রোগ। বরং অন্তরের সকল রোগের মা। যাকে উম্মুল আমরাজ বলা হয়। অহংকারী মুসলিমের জানা থাকা উচিত সে যতই বড় হোক না কেন পাহাড় সমান তো আর হতে পারবে না; জমিন ছিদ্র করে বেরিয়ে যেতে পারবে না।

বিনয় যেমন মাটির মানুষকে আকাশের উচ্চতায় উঠিয়ে নেয়, ঠিক এর বিপরীতে যশ-খ্যাতি, সম্মান, অর্থসম্পদ, প্রভাবপ্রতিপত্তি, বিদ্যাবুদ্ধি ইত্যাদি যে কোনো ক্ষেত্রে কেউ যখন সফলতার চূড়া স্পর্শ করে অহংকার করতে থাকে তখন তা তাকে নিক্ষেপ করে আকাশের উচ্চতা থেকে সাত জমিনের নিচে। এক আরবী গল্পে অহংকারের উপমা খুব চমৎকার ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। তবে দুই চোখের পরিবর্তে এক হাজার মানুষের দুই হাজার চোখ তাকে ছোট করে দেখছে। অর্থাৎ অহংকার করে একজন যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে তখন এ অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا

“পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ পৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না।” (–সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩৭)

وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ . وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِن صَوْتِكَ ۚ إِنَّ أَنكَرَ الْأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيرِ

“অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নীচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।” (–সূরা লোকমান, আয়াত: ১৮-১৯)

আল্লাহপাক আরও  বলেন-

ساصرف عن آياتي الذين يتكبرون في الأرض بغير الحق

“আমি এমন লোক দের কে আমার আহকাম ও আয়াত সমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখবো যারা জমিনে অহংকার করে যেটার কোনো হক তাদের নেই”

كذالك يطبع الله على كل قلب متك جبار

“এমনি ভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও অত্যাচারীর অন্তরে মোহর মেরে দেন। নিশ্চিত ভাবে আল্লাহ্‌ অহংকারী দের কে পছন্দ করেন না।”

إن الذين يستكبرون عن عبادتي سيدخلون جهنم داخرين

“যারা অহংকার বশত আমার এবাদত থেকে ফিরে যাবে অচিরেই তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করব”

হাদিস শরীফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

((لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ كَانَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كِبْرٍ)

“যার অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

অহংকার এমন একটি গুণ যা শুধু আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। যে ব্যক্তি এ গুণ নিয়ে আল্লাহর সাথে টানাটানি করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন, তার প্রতাপ নস্যাৎ করে দেন ও তার জীবনকে সংকুচিত করে দেন।” (সহীহ মুসলিম। হাদিস নং- ৯১)

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي ، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ

“অহংকার হচ্ছে আমার চাদর আর সম্মান হচ্ছে আমার পরনের কাপড়; যে ব্যক্তি এ দুটির কোন একটি নিয়েও আমার সাথে টানাটানি করে, আমি তাকে আযাবে নিক্ষেপ করি।” (–আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪০৯০)

নিজের সৌন্দর্য্য, দামী পোশাক ও দামী খাবার ইত্যাদি দ্বারা অভিভূত হয়ে পড়া এবং মানুষের উপর দাম্ভিকতা প্রকাশ করাও অহংকার।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-

ينما رجل يمشي في حلة تعجبه نفسه مرجل جمته إذ خسف الله به فهو يتجلجل إلى يوم القيامة

“একদা এক ব্যক্তি হুল্লা পরে, আত্মম্ভরিতা নিয়ে, মাথা আঁচড়িয়ে হাঁটছিল এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে সহ ভূমি ধ্বস করে দিলেন এবং এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত সে নীচের দিকে যেতে থাকবে।” (–বুখারী, হাদিস নং : ৩২৯৭. মুসলিম, ২০৮৮)

অহংকার কাকে বলে? হাদীসে ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্নিত-

الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ

অর্থাৎ সত্য বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও তা না মানা আর মানুষ কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, অহংকার কুফুরী থেকেও বেশী মারাত্মক কারণ কুফুরী হয় অহংকারের কারণেই।

অহংকারই ইবলিশকে ইবলিশে পরিণত করেছে। অহংকারে দুনিয়ার ক্ষতি হলো কোনো মানুষ তাকে দিল থেকে ভালবাসে না, বিপদে পড়লে কেউ তাকে রক্ষা করতে আসবে না, বরং খুশী হয়। মনে রাখতে হবে, অহংকার শয়তানের চরিত্র। অহংকারী ব্যক্তি যেন জেনে নেয় যে সে শয়তানের চরিত্র গ্রহণ করেছে।

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ পাক তিন প্রকার ব্যক্তির সাথে কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের প্রতি (দয়ার) দৃষ্টিপাতও করবেন না এবং তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি। তারা হলেন, এক. বৃদ্ধ ব্যভিচারী দুই. মিথ্যাবাদী শাসক তিন. অহংকারী ভিক্ষুক। (মুসলিম শরীফ-১/৭১)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, আমি কী তোমাদেরকে জান্নাতবাসী সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলেন, দুর্বল লোক তাদেরকে লোকেরাও দুর্বল ও হেয় মনে করে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তারা এতো সম্মানিত যে, তারা যদি আল্লাহর নামে কসম করে, অবশ্যই আল্লাহ পাক তা সত্যে রূপান্তরিত করেন। তিনি আরো বলেছেন, আমি কী তোমাদেরকে জাহান্নাম সম্পর্কে অবহিত করবো না? তারা হলেন, অনর্থক বিবাদকারী, বদমেজাজী ও অহংকারী। (বুখারি শরীফ-২/৮৯৭)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ পাক ওহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ প্রেরণ করেছেন যে, নম্রতা এবং হেয়তা অবলম্বন করো। অহংকার ও গর্ব করা থেকে বিরত থাকো।’ কেননা এগুলো আল্লাহ পাকের কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট।(ইবনে মাজাহ-২/৩০৮)


এছাড়া কিয়ামতের দিনে অহংকারীদেরকে ভয়াবহ শাস্তি প্রদান করা হবে। এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠোর হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে পিপীলিকার ন্যায় একত্রিত করা হবে এবং তাদের আকৃতি হবে পুরুষের মতো। অপমান-লাঞ্ছনা তাদেরকে বেষ্টন করে নিবে, তারপর তাদেরকে ‘বাওলাস’ নামক জাহান্নামের দিকে তাদেরকে হেঁকে নেয়া হবে। আগুনের অগ্নিশিখা তাদের ওপর ছায়া হবে এবং তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহ নিংড়ানো ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক পুঁজ-রক্ত।’ (তিরমিজি শরীফ-২/৭৬)


উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, অহংকার একটি মারাত্মক গুনাহ। যার শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই তা পরিহার করে বিনয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। বিনয় মানুষের ভাব-মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে, পক্ষান্তরে অহংকার মানুষের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। অহংকারকারী নিজকে নিজের কাজে অনেক বড় মনে করে। কিন্তু অহংকারীদের আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য নেই। একই বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, হযরত ওমর রাযি. এর কণ্ঠে, তিনি বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা বিনয়ী হও। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে আল্লাহর জন্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ পাক তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। সে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং মানুষের দৃষ্টিতে সম্মানি। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অহংকার করে আল্লাহ পাক তাকে হেয় করে দেন। সে মানুষের দৃষ্টিতে অসম্মানি ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং নিজেকে অনেক বড় মনে করে। পরিশেষে সে মানুষের কাছে কুকুর অথবা শুকরের চেয়েও ঘৃণিত ও তুচ্ছে পরিণত হয়।’(শু‘য়াবুল ঈমান- ৬/২৭৬)

আল্লাহ পাক সকলকে এ ঘৃণিত কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুক। আমীন।

 

মন্তব্য করুন