আপন ভালোবাসার কোমল গল্প; শায়খ আলী তানতাবী

প্রকাশিত: ৪:৫১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০১৯

(প্রথম পর্ব)

ভাষান্তর : ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী

স্বপ্নময় প্রভাত

কথা বলার জন্য এই মূহুর্তে আমার নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই৷ ভাবছিলাম কী নিয়ে কথা বলব? প্রবলভাবে মনে পড়ছিল আমার ব্যক্তি জীবনের অতীত কিছু স্মৃতীকথা৷ ভেসে উঠছিল শৈশবের সহজ ও কোমল কিছু চিন্তার রেখা৷ যখন আমি মায়ের আদরে বাবার ভালোবাসায় বেড়ে উঠছিলাম৷ তাদেরকে নিয়েই জীবনের সব স্বপ্ন সাজাতাম৷ প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সব গল্প এখানেই গড়ে তুলতাম৷ ভাবতাম কখনও তাদের থেকে দূরে যেতে পারবো না৷ তাদের ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবো না৷ এরাই আমার আশা ভরসার কেন্দ্রভূমী ৷ তারাই আমার সুখ স্বপ্নের একমাত্র ঠিকানা৷ প্রতিটি সন্তানই যেমন ভেবে থাকে৷ মা-বাবা ও সন্তানের মাঝে যে অকৃত্তিম বন্ধন গড়ে উঠে থাকে৷ আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না৷ তারা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল৷ তাদের সাথে প্রতিনিয়ত আষ্ট্রেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতাম৷ তাদের ছাড়া জীবন মাটি মনে হত৷ তাদের দূরত্ব কখনও সইতে পারতাম না৷ তাদের ছাড়া একদিনও থাকতে পারতাম না৷ তাদের চলে যাওয়ার পর এক মূহুর্তও বেঁচে রইব – কল্পনাও করতে পারতাম না৷ মা-বাবাহীন জীবনকে মেনে নেওয়ার মত কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেতাম না৷

অসহ ভাঙ্গন:

কিন্তু এসব ভাবনা বহমান ছিল৷ আমাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখত৷ বিভোর ভালো লাগায় ডুবিয়ে রাখত৷ হঠাৎ জীবনে বজ্রপাতের মত গর্জন ধেয়ে আসে৷ একে একে মা বাবা চলে যান৷ তাদের মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হই৷ দেখতে দেখতে অর্ধশতাব্দী কেটে যায়৷ আগের মতোই বেঁচে থাকি৷ কিছু দিন পাথর সময় কাটাই৷ ইতিমধ্যে আরও অনেককেই হারাই৷ দাদা দাদী ছিলেন৷ চলে যান তারাও৷ নানা নানীও প্রভুর ডাকে সাড়া দেন৷

ভালোবাসার একটি জগৎ হারিয়ে যায়৷ তিলে তিলে পবিত্র প্রেম দিয়ে গড়ে তোলা একটি পরিবার বিলীন হয়ে যায়৷ নতুন আরেকটি পরিবারের যাত্রা শুরু হয়৷ আমি ও আমার ভাই বোনদের নিয়ে সময়ের ব্যবধানে আরেকটি মালঞ্চ গড়ে উঠে৷ একে অপরের প্রতি কত আস্থাশীল ও নির্ভরশীল হয়ে উঠি৷ আদর স্নেহ ও ভালোবাসায় তৃপ্ত হতে থাকি৷ আমরা যেন একটি বইয়ের কয়েকটি পাতা ছিলাম৷ একটি ফুলদানির কয়েকটি ফুল ছিলাম৷ একটি দেহের কয়েকটি অঙ্গ ছিলাম৷

কিছুদিন যেতেই আমরাও আলাদা হয়ে যাই৷ এতোটা দূরে চলে যাই যা কখনও কল্পনাও করিনি৷ অনেক দূর দূরান্তে যার যার নিবাস গড়ে নিই ৷ বিয়ে করে পৃথক সংসারী হয়ে উঠি৷ নতুন নতুন পরিবার নিয়ে যার যার মতো ব্যস্ত হয়ে যাই৷ হ্যাঁ পারস্পরিক হৃদ্যতা, ভালোবাসা, আত্মীয়তা ও রক্তের পবিত্র সম্পর্কতো আছেই৷ এবং তা যথারীতি থাকবেই ৷ কিন্তু দূর থেকেই৷ তারপর থেকে অল্পই কাছাকাছি হতে পারি৷ চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি৷ বুকে বুক রেখে রক্তের ঘ্রাণ নিতে পারি৷

ভালোবাসার বিরাণভূমি:

আবার নতুন বাগান গড়ে উঠে জীবন সংসারে ৷ আমার কন্যারা জন্ম নেয় ৷ এরা আমার জীবনে আসে ভালোবাসার রংধনু হয়ে ৷ সঞ্চিত স্বপ্নের আলোকধারা বইয়ে দেয় আমার মননে ৷ শ্বাস নিশ্বাাসের স্পন্দন হয়ে যায় আমার অস্তিত্বে ৷ আমি কখনও দূরে যাব, ওরা কখনও আমার চোখের আড়ালে যাবে -এই চিন্তা পুরোপুরি বিতারিত হয় জীবন থেকে ৷ বিচ্ছিন্নতার সব চিন্তা সমাহিত হত প্রতিদিন আমাদের মমতার ঘরে ৷ ভালোবাসার চরাচরে ৷

কিন্তু আমাদের ভাবনা ও বাসনা যথারীতি পরাজিত হয় ৷ মহান আল্লাহর বিধানই বিজয়ী হয় ৷ একসময় বড় মেয়েটি বিয়ের বয়সে পৌঁছে যায় ৷ প্রস্তাব আসে ৷ বিয়ে হয়ে যায় ৷ তারা তাকে নিয়ে যায় ৷ ওখানে তার একটি স্বতন্ত্র বাড়ী হয়ে যায় ৷ একটি ভিন্ন সংসার হয়ে যায় ৷ যে পরিবারটি তার মা-বাবার মূল পরিবারের চেয়েও প্রিয় ও আরাধ্য হয়ে উঠে ৷ তার অনাগত সময়ের সুখ-স্বপ্নগুলো এখানেই পাখা মেলতে থাকে ৷ ভবিষ্যতের সব পরিকল্পনা এখানেই পাতা গজাতে থাকে ৷ পেছনের গল্প পেছনে পড়ে রয় ৷ আমাদের মত তারাও নতুন পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় ৷ অন্যান্য মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে যায় ৷ যার যার শহরে প্রত্যেকেই আপন ঠিকানা গড়ে নেয় ৷ সবাই দূরের মেহমান হয়ে যায় ৷ একসময়ের বিস্ময়কর চিন্তা নিষিদ্ধ ভাবনা এখন স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়ে যায় ৷ তবে এই দূরত্ব যদিও হৃদয়ের নয় ৷ আবেগ অনূভুতির নয় ৷ যোগাযোগ ও সম্পর্কের নয় ৷ শুধু স্থান ও নিবাসের ৷ নতুন পরিচয়ের ৷ তথাপি তারা কাছের মানুষও নয় ৷ ইচ্ছা হলেই একটু দেখে চক্ষু শীতল করা যায় না ৷ একটু হাত বুলিয়ে আদর করা যায় না ৷

দূরন্ত সময়ের রঙ্গীন ক্যানভাস:

মনে পড়ে জীবনে কিছু ভাই বন্ধু ছিল ৷ যাদের সাথে শৈশব কেটেছে ৷ কৈশর কেটেছে ৷ যৌবনের কত সোনালী সময় কেটেছে ৷ জীবনের কত স্মৃতীকথা তাদের সাথে জড়িয়ে আছে ৷ কত গল্প, কত হাসীগান,কত ছন্দ কবিতার কলতান নিত্য প্রবাহিত হয়েছে আমাদের জীবনের অলিতে গলিতে ৷ কত বিষয় নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আশায় বুক বেঁধেছি ৷ একসাথে কত স্বপ্ন গড়েছি ৷ ভেঙ্গেছি ৷ মালা গেঁথেছি ৷ ছিড়েছি ৷ অল্প সময়ের জন্য দূরে গেলেও পরবর্তী সাক্ষাতের সময় ঠিক করে নিতাম ৷ একটু দীর্ঘ সময় দেখা না হলে অস্থিরতায় হাঁপিয়ে উঠতাম ৷ তারাও আজকে কেউ আর কাছে নেই ৷ কর্মময় জীবন সবাইকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নিয়ে গেছে ৷ কেউ কেউ বরং অনেকেই মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে ৷ কারও উপর প্রৌঢ়ত্ব চেপে বসেছে ৷ বয়সের ভারে কেউ নূঁয়ে পড়েছে ৷ কেউবা দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভোগছে ৷ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে ৷

আমি আছি আমার শহরে ৷ বেঁচে আছি হাজারো স্মৃতীর ভীড়ে ৷ বিস্তৃর্ণ গল্পের নীড়ে ৷ মানুষের জীবন মানে কী ? জীবন মানে একগুচ্ছ স্মৃতীর গুঞ্জরণ ৷ শব্দহীন অনুরনন ৷ আমি বেঁচে থাকি আমার শৈশব কৈশরের দূরন্ত খেলাঘরে ৷ গ্রামের পথে প্রান্তরে ৷ দূর থেকে দৃ্শ্যমান মসজিদের সুদৃশ্য মিনারে ৷ স্বজনদের ভালোবাসার মায়াময় ক্যম্পাসে ৷
মানুষের বেড়ে উঠার স্মৃতীময় অঞ্চল তার বেঁচে থাকার অনেক বড় অবলম্বন ৷ তাই সে যখন অন্য কোনো শহরে চলে যায়, সে যেন ঐ তরুলতা বা চারাগাছের মত হয়ে যায়, যেটি মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে ৷ অন্য ভূমিতে ৷ অন্য জমিতে ৷ সেটি হয়ত পরিবেশের সহযোগিতায় আবারও বেড়ে উঠবে ৷ ফুল ফলে সমৃদ্ধ হবে ৷ কিন্তু জীবনের প্রকৃত ছন্দ হারায় ৷ নিঃস্বঙ্গতায় সময় কাটায় ৷ ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষ আপন গ্রাম শহরেই জীবনের প্রকৃত স্বাদ ও আহ্লাদ খুঁজে পায় ৷ দূর দূরান্তে যতটাই বর্ণিল সময়ের সন্ধান পায়, উন্নত জীবন উপকরনে মজে যায় ৷ তথাপি তার আপন ভূমিতে, জন্মের নগরীতে বেড়ে উঠার শহরটিতে যখনই ফিরে আসে; তার মাটির ঘ্রাণের মাদকতা তাকে মুগ্ধ করে ৷ আশপাশের চিরচেনা চোখ মুখ তাকে তৃপ্ত করে ৷ পরিবেশের সজীবতা তাকে প্রাণবন্ত করে ৷ কেননা এখানেই যে তার জীবন বৃক্ষের বীজ বপিত হয়েছে ৷ চারা গজিয়েছে ৷ বেড়ে উঠেছে ৷ এখানেই বিচিত্র সম্পর্কের গল্পরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৷ হয়ত এসব গল্প কখনও মৃত্যু এসে শেষ করে দেয় ৷ কখনও স্থানান্তর ৷ কখনও দূরত্ব ও পরিস্থিতির পরিবর্তন ৷ তথাপি সৌরভ রয়ে যায় ৷ বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায় ৷

পরের পর্বের জন্য চোখ রাখুন পাবলিক ভয়েসের ওয়েবসাইটে।
প্রকাশ তারিখ : ২২-০১-১৯ সন্ধ্যা- ৭.০০ টা

মন্তব্য করুন