চার কিশোরের যুদ্ধাভিযান

প্রকাশিত: ১২:৪৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল জব্বার। সন্ধ্যার পর পরই ওদের বৈঠক করার কথা। জলিল, মালেক, রহমত আলী গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে আছে। জব্বারকে দেখেই তাদের মাঝে চঞ্চলতা ফিরে আসে। জব্বার ছিলো তাদের টিম লিডার। হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন তৎপরতার সংবাদ সংগ্রহ করাই এদের মূল দায়িত্ব। কমান্ডার আব্দুল মতিন এর নির্দেশনায় এরা কাজ করতো। জব্বারের সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে কমান্ডার মতিন তার নেতৃত্বে এই গোয়েন্দা টিম গঠন করেন। একবার এলাকায় মিলিটারি আসে। এলাকায় হামলার পরিকল্পনা করে। বেশ কয়েকদিন ধরে তারা স্কুল ঘরে অস্ত্র-সস্ত্র জমা করছিলো। জব্বার ছিলো বেশ সাহসী ও কৌতুহলী কিশোর। কৌতুহল বশত সে একদিন স্কুলের সেই রুমটিতে প্রবেশ করে যেখানে মিলিটারিরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা করছিলো। এক সিপাই তাকে ধরে বসের কাছে নিয়ে গেলে খুব কান্নাকাটি ও অনুনয় বিনয় করে উপায় না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চৌদ্ধগোষ্ঠি উদ্ধার করে ছাড়া পায়।

মিলিটারিদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে জব্বার সোজা মতিন কমান্ডারের কাছে চলে যায়। তখনো এলাকায় মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়নি। যে কোনো মুহুর্তে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়ে শহরে মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা চালাতে পারে, হানাদাররা তাদের এদেশীয় দোসরদের কাছ থেকে পাওয়া এমন সংবাদের ভিত্তিতেই গ্রামের স্কুলে ক্যাম্প বসায়। সেই ক্যাম্প ঘুরে মতিন কমান্ডারকে ভিতরের খবর জানায় জব্বার। পরে সেই রাতেই মতিন কমান্ডার আরো কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার-হানাদার বাহিনীর সব পরিকল্পনা নসাৎ করে দেয়।

জব্বারকে পেয়ে সবাই আলোচনা শুরু দেয়। তারা সেই স্কুলেরই একটা পরিত্যক্ত অন্ধকার রুমে বসে আলোচনা করছিলো। সেই রাতে পুরো স্কুলটিই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তারপর থেকে সন্ধ্যা হলে কেউ ভুলেও স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটে না ভয়ে। দু’দিন আগেই তারা সংবাদ পেয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে নদী পথে হানাদার বাহিনীর বিশাল এক অস্ত্র বোঝাই জাহাজ আসতেছে। আজ রাতের মধ্যেই জাহাজটি তাদের এলাকা অতিক্রম করবে। ওদিকে মতিন কমান্ডার মুক্তি বাহিনীর টিম নিয়ে অন্য একটি অপারেশনে ব্যস্ত। সুতরাং যা করার তাদেরই করতে হবে। আলোচনা ও পরিকল্পনা করে যে যার মতো চলে গেলো। ডিসিশন রাত ১২ টার পর সবাই নদীর পাড়ে এসে একত্রিত হবে।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চেনা পথেও আলো ছাড়া চলা মুশকিল। কিন্তু আলো জ্বালালে বিপদের শঙ্কা। তখন প্রায় সোয়া একটা বাজে। ওরা চারজন। মাথায় চিন্তার ভাঁজ। সবাই গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন। মালেক ফিস ফিস করে একটা আলোর দিকে ইশারা করলো। আশপাশসহ যতদূর চোখ যায় জেলেদের জালের আঁচলে জ¦লা আলো অতটা স্পষ্ট না। জেলেদের জালে টিম টিম করে ছোট ছোট কুপি জ¦লছে। নৌকা বড় হলে হারিকেন কিংবা বড়জোড় দুটো বা তিনটি কুপি থাকে। সবগুলোই নিভু নিভু হয়ে জ¦লে। আলো একেবারে সামান্যই। কিন্তু কিছুটা দূরে একটি অগ্রসরমান আলো দেখা যাচ্ছে। যেন গ্রামের সরু রাস্তায় মালবাহী ট্রাকের বিশাল হেডলাইট। মনে হচ্ছে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মিনিট দশেক যাওয়ার পর তারা নিশ্চিত হলো সেটা অস্ত্রবাহী জাহাজের হেডলাইটের আলো। কারণ এখন দুটো আলো দেখা যাচ্ছে। প্রথম আলোর একটু পরেই কিছুটা দ্বিতল ভবনের দ্বোতলাসমেত উঁচুতে দ্বিতীয় আলোটি টিম টিম করছে। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটি ঘর। তার ভিতরে আলো জ¦লছে। বুঝতে বাকী রইলো না যে ওটা জাহাজের মাস্টার কেবিনের আলো।

জড়তা কেটে সবাই প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। পরিকল্পনা মাফিক জব্বার ও মালেক স্কুলের পুকুর থেকে আনা কচুরিপানার স্তুপ নিয়ে নদীতে নেমে যায়। প্রথমে কচুরিপানার স্তুপ নদীতে ভাসিয়ে ডুব দেয়। তারপর দুজনই স্তুপের ভিতর দিয়ে মাথা জাগায়। দুটি শুকনো বাঁশের টুকরা কচুরিপানার উপরে সুবিধা মতো বসিয়ে নেয় আড়াআড়িভাবে; যাতে বাঁশের উপর ভর করে তারা দীর্ঘ সময় মাথা জাগিয়ে থাকতে পারে। সাথে ছোট দুইটি পানি খাওয়ার বাটি দুজনের কাছে। এরপর দুজনেই জাহাজের নিশানা ঠিক করে জাহাজের দুই পাশ দিয়ে নদীতে ভাসতে থাকে। জাহাজের দু’পাশেই বড় বড় টায়ার বাঁধা ছিলো মোটা রাবারের। এতে করে তাদের সুবিধাই হয়। এক হাতে টায়ার ধরে আরেক হাতে জাহাজের মাঝামাঝি সমান দূরত্বে সুবিধা মতো দুটি করে আগুন বোমা সেট করে। যেগুলো তারা বাটিতে করে নিয়েছিলো। ততক্ষণে জাহাজ তাদেরকে নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে যায় যেখান থেকে তারা নেমেছিলো। আগুন বোমা সেট করে তারা সতর্কতার সাথে নদী সাঁতরে কিণারে আসে। পাড়ে উঠে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওদিকে ওরা যেখান থেকে নদীতে নেমেছিলো সেখানেই একটি ঝোপের আড়ালে থেকে জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলো জলিল ও রহমত আলী।

রাত তখন প্রায় তিনটা বেজে গেছে। হঠাৎ করে পর পর বিকট কয়েকটি শব্দ। সারা গ্রামের মানুষ বিস্ফোরণের বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। জাহাজটি বিস্ফোরিত হয়। জলিল আর রহমত আলী উল্লাস করতে থাকে। লোকজন আস্তে আস্তে করে তাদের কাছে থেকে ঘটনা জানতে পেরে স্বস্তি পায়। ওদিকে জব্বার আর মালেকের স্বজনরা তাদের অনুপস্থিতি টের পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। জলিলরাও তাদের ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারছিলো না তখন। জব্বার ও রহমত আলী যেই বাড়িতে আশ্রয় নেয় সেই বাড়িতে ছিলো একজন তরুণী আর তার মা শাহানা বেগম আর এক বৃদ্ধা নারী। তরুণীর বাবা শফিক মিয়া কিছুদিন আগে একটি গেরিলা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। শফিক মিয়া মতিন কমান্ডারের অধীনেই যুদ্ধ করেছিলো। বিস্ফোরণের আওয়াজে তরুণীসহ ঘরের সবাই ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। তরুণীর মা রীতিমতো বিলাপ করতে শুরু করেন। আজকের রাতে কত স্ত্রী-ই না জানি স্বামী হারিয়েছে। কত আদরের সন্তানই বা না জানি বাবা হারিয়েছে। এতোক্ষণ চুপচাপ বসেছিলো জব্বার-মালেক। কৈশোরের শেষ প্রান্তে থাকা দু’জন উঠতি যুবকের আকস্মাত ঘরে প্রবেশ ভয় জাগিয়ে তোলে শাহানা বেগমের মনেও। এবার গলা ছাড়লো জব্বার। জব্বার তাদেরকে অভয় দিয়ে বলে ঐ বিস্ফোরণের কাজটিই তারা কিছুক্ষণ আগে করে এসেছে।

রাতের মধ্যেই খবরটি গ্রাম পেরিয়ে শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের সেনা ক্যাম্পের সদস্যরা ঘটনার আকস্মিতায় হতভম্ব হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে রাতেই শহরের আশপাশের কয়েকটি মুক্তি দল একত্রিত হয়ে সেনা ক্যাম্পে হামলা করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা সেনা ক্যাম্প দখলে নিয়ে জাতীয় পতাকা উড়ায়। ভোর হতেই শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এক রাতে পর পর দুটি সফল অপারেশনে শত্রুমুক্ত হওয়ায় গোটা শহর ছড়িয়ে গ্রামে গ্রামে আনন্দের জোয়ার।

সূর্য ওঠার পর জব্বার আর রহমত আলী বাড়ি ফিরলে মানুষের মুখে মুখে তাদের সফলতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলে মতিন কমান্ডার এসে জানালেন শহর শত্রমুক্ত করার গল্প। মতিন জানালেন জাহাজ বিস্ফোরণের পরই শত্রুদের মনোবল ভেঙে যায়। সুযোগ পেয়ে মুক্তি বাহিনী সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করে লাল সবুজের পতাকা উড়ায়। মতিন কমান্ডার গ্রামবাসীর সামনে চার কিশোরকে ডেকে বলেন, মূলত তাদের এই কৃতিত্বই শহর শত্রুমুক্ত করার পথকে ত্বরান্বিত করেছে। এতো বড় সফলতার কথা শুনে তাদের সে কী আনন্দ…….

শাহনূর শাহীন
কবি, লেখক ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন