তারা আমাদের ছাঁয়া

প্রকাশিত: ৬:৪৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৭, ২০১৯
ছবি: গোলাম রাব্বি

আহমদ জারীর

“বাঁশ বাগানের মাথার ওপর
চাঁদ উঠেছে ঐ,
মা গো আমার শোলক বলা
কাজলা দিদি কই…”
সাবিত আনমনে আবৃত্তি করে যাচ্ছে। বাগচীর কবিতাটা তার দারুণ লাগে। শুকুর মিয়ার বিরক্তি বোধ হচ্ছে,আবার হচ্ছে না।
সে ভাবছে, “লোকটা আধ পাগল,কোনো সন্দেহ নাই। আইসছো গ্রান্ড সুলতানে, থাকো না ওই খানেই। এই জঙ্গলে আসার দরকার কি? আচ্ছা না,আইসবা ভালা কথা, তো দিনে আসো।রাত বিরাতে জঙ্গলে হাটার শখ!! টেকার রোগ আর কি। এখন আবার বাঁশবাগান জপতিছে। এই জঙ্গলে বাঁশ বাগান পাইলো কই? পাগল আধা না, পুরাটাই….”


গতবার বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়েছে যায়েদ সাবিত। বিয়েরও বেশীদিন হয় নি, বছর খানেক হবে। ছুটি কাটাতে সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে আসা। এখানকার সবচেয়ে ভালো রিসোর্ট, গ্র‍্যান্ড সুলতানে উঠেছে সস্ত্রীক। পরিচিত জনদের অনেকেই জানেন, তার উদ্ভট সব শখের কথা। এই যেমন গভীর রাতে ছাদে বসে গল্প করা, ইলেক্ট্রিসিট চলে গেলে শহরের রাস্তায় হাটা, হাতে এক কাপ চা নিয়ে ভোর দেখা এইস শখ নিয়ে ঘুরে সাবিত।

তার অফিসের পিয়নের মতে,“স্যার লোকটা ভালোই,খালি মাথায় একটু গন্ডগোল আছে আর কি।” শ্রীমঙ্গলে এসে সাবিতে মাথায় হঠাৎ শখ চেপেছে রাতে লাউয়া ছড়ায় হাটার। হোটেল ম্যানেজার কে তার শখ জানাতেই,“স্যার,জঙ্গলটা বেশ সুবিধার না, সাপ খোপের আড্ডায় ভর্তি, রাত্রে মেছো বাঘ চলা ফেরা করে, জঙ্গলে প্রচুর শিয়াল…….”
আর সব ধরনের বিপদের ধারণা দিয়েও ম্যানেজার যখন দেখলেন কোনো ভাবেই এই তরুণ অফিসার কে নিরস্ত করা যাচ্ছে না, অনেকটা নিরুপায় বললেন, “স্যার,তাইলে থানায় বলে ফোর্সের ব্যবস্থা করি?”

সাবিতের পুরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।বিশাল দল নিয়ে জঙ্গলে হেটে আবার আনন্দ আছে না কি? শেষ পর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পুরনো,বয়স্ক গাইড শুকুর মিয়াকে নিয়ে রাতের লাউয়া ছড়া দেখার শখ পূরণে বেরুতে হলো সাবিত কে। রাত ঠিক আটটায় শুকুর মিয়া গ্র‍্যান্ড সুলতানের গেটে হাজির হয়। রিসোর্টের গাড়িতে লাউয়াছড়ার গেট পর্যন্ত। আবার ঠিক রাত দশটায় গাড়ি চেপে হোটেলে। শুকুর মিয়া হোটেল গেটেই নেমে যায়।মাঝখানের সময়টায় গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার লাউয়াছড়ার গেটেই অপেক্ষায় থাকে।
শুকুর মিয়া প্রতি রাতে সাবিতের সাথে জঙ্গলে দু-তিন ঘন্টা হেটে পকেটে পাঁচশো টাকার কড়কড়ে নোটে পুরো খুশি।

শহুরে বাবুরা সাধারণত তেমন কথা বলেন না। কিন্তু সাবিত জঙ্গলে হাটার পুরো সময়টা ধরে শুকুর মিয়ার সাথে কথা বলেই চলছে। কথা মানে একদম পরিবার থেকে নিজের চাকরি সব নিয়েই কথা,গল্প চলে। যার কারণে শুকুর মিয়া আরো বেশী খুশি।

“বুঝলে শুকুর মিয়া,কতো মানুষ আসে এই লাউয়াছড়ায়। সবাই ই কিন্তু দিনে আসে।আমিও প্রায় পাঁচ ছয় বার আসছি এখানে।। কিন্তু রাতের লাউয়া ছড়ার সৌন্দর্য,রাতে যে লাউয়াছড়ায় হাটে নি সে কল্পনাও করতে পারবে না।

-আচ্ছা শুকুর মিয়া,এখানে চা’’র স্টল আছে?”
-আছে স্যার,ওগুলা দিনে খুলা থাকে,সন্ধ্যায় বন্ধ কইরা নেয়।সন্ধ্যার পরে তো আর কেউ আসে এই দিকে,তাই আর কি…?
-কাল আসার সময় মনে করবা,হোটেল থেকে এক ফ্লাক্স চা নিয়ে নেব।ভেতরের রেল লাইনে বসে চা খেতে খেতে গল্প করবো…..
কথা চলে,হাটাও চলে তাদের। মাঝে মাঝে লক্ষী পেচা ডেকে ওঠে, কানে আসে হঠাৎ বাদুড়ে পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ,কাছে থেকে হঠাৎ কি যেন দৌড় দেয়।হরিণ হয়তো,শেয়ালও হতে পারে। এসবে ভয় না পেয়ে বরং আনন্দই পাচ্ছে সাবিত। সাবিত মাঝে মাঝে দু-একটা কবিতার দু-তিন লাইন আওড়ায়।
-আচ্ছা শুকুর মিয়া,তুমি গান জানো না?একটা গান ধরো তো, তোমার যা খুশি..
শুকুর মিয়া ভাঙা গলায় গান ধরে,
“লোকে বলে,বলে রে
ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার…”

শুকুর মিয়ার বেসুরো গানে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হলেও, সাবিতের খুব একটা খারাপ লাগে না। লাউয়াছড়ায় রাতকে অবশ্যি পুরোপুরি নিস্তব্ধ বলা যায় না। ঝি ঝি পোকার ডাক, এখানে রাত কে নিস্তব্ধ হতে দেয় না পুরোপুরি।  তারপরও যেন কিছুটা নিস্তব্ধতা থেকে যায়। আর সেটুকুই এখন শুকুর মিয়ার বেসুরো গান ভাঙছে। শুকুর মিয়ার গানের দৌড় ওই দুই লাইনই, বাকিটা মনে করতে পারে না। অন্য গান ধরে। এক সপ্তাহের ছুটিতে এসেছিলো শ্রীমঙ্গল। স্ত্রী নিয়ে থাকে ঢাকায়।

আজ রাতে হাটা শেষে গ্র‍্যান্ড সুলতানে গেটে এসে শুকুর মিয়ার হাতে পাঁচ শত টাকার বদলে এক হাজার গুজে দেয় সাবিত।
-শুকুর মিয়া, তুমি মানুষ খারাপ না। কাল চলে যাবো ঢাকায়। আর আসলে তোমার খোজ নেবো,ভালো থেকো। কেমন?
সাবিত দেখলো, বিদায় না নিয়ে শুকুর মিয়া কেমন উসখুস করছে।

-কিছু বলবে না কি শুকুর মিয়া?
-“স্যার, যাইতাম তো ঠিকই, একটা কথা কইয়া যাই। ভুল কইলে আগেই মাফ চাইতাছি। আপনি হাটতে হাটতে একদিন কইলেন না, আপনি আপনের মা বাপের একমাত্র সন্তান, আপনের মা-বাপ দেশের বাড়িতে থাকেন। তাগো আপনে মাসে মাসে দেখতে যান। কিন্তু আমি কই কি, জঙলে একদিন হাটতে হাটতে একটা ময়নার ছাও পাইছিলেন না, সেদিন? ওই ময়নাটারে আপনি আদর কইরা হাতে নেয়ার পরেও কিন্তু কাপতাছিলো। মা-বাপ হইলো মাথার উপরের ছায়া। মা-বাপ ছাড়া পোলাপান ঝড়ে বাসা হারানো পাখির ছাওয়ের মতোই। তাগো যতো কাছে থাকবেন, বিপদ ততোই দূরে থাইকবো। আসি তাইলে স্যার।”

হেটে হেটে আধারে মিশে গেলো শুকুর মিয়া। সাবিত ঠায় দাঁড়িয়ে হোটেলের গেটে।
হঠাৎ তার মনে হলো, সে শুধু জঙ্গলের অন্ধকারে হাটে নি, অন্ধকার হয়ে এক আলোর পথেই যেন হেটেছিল শুকুর মিয়ার সাথে।

মন্তব্য করুন