হৃদিতা শারমিনের কবিতা: আমার তাবৎ জীবন বর্ষাকাল

প্রকাশিত: ১০:৩৪ অপরাহ্ণ, জুন ৩, ২০২১

আমার তাবৎ জীবন বর্ষাকাল

                          -হৃদিতা শারমিন

মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সুঁইসুতোয় যত্নবতী সংসারী মা কে আঘাত করে
আমি সুখ দিতাম,
জানান দিতাম আমি ভালো আছি, আমি বেড়ে উঠছি।
শুক্লাদ্বাদশীর দিনে জন্মের পরও রোষারক্ত নয়নে ধরিত্রীর কেউ কেউ উপহাসে মেতে উঠতে উঠতে বললো,
“ছ্যহ! মায়ের মতো মেয়েও দেখি মেয়ে প্রসব করল!
পেলে-পুষে তো সেই পরের ঘরেই পাঠাতে হবে। ”
তখন আমার বয়স মাত্র ৩৫৯ সেকেন্ড।
অভাগী মায়ের কাছে আমি তখন অপেক্ষার পরম পাওয়া,
নৈসর্গিক অমৃতলোক হতে আগত সদ্য অতিথী।
বিকৃতবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মনোভাবের শ্রাদ্ধ ঘটানোর পর ছলছল চোখে অনুরাগী মা জ্বালায় আমার জীবনপ্রদীপ ;
যন্ত্রণার একফালি মোড়ক উন্মোচন করে নেয় সহাস্যে।
অথচ অসুন্দরের এমন শ্রাদ্ধে বিজয়ী হয়েও মায়ের চোখে তখন তুমুল বর্ষাকাল।

সময়ের পরিক্রমায় আধো আধো বুলিতে মায়ের মুখে মুখে শিখতে শুরু করলাম
আলিফ,বা, তা,মিম,
ক,খ,গ, জ্বিম।
জীবনের নাতিদীর্ঘ একটি ধাপ অতিক্রম করে
আমি হাতে তুলে নিলাম স্ব-বিদ্রোহী কলম,
কাঁধে সস্তা ব্যাগ।
মায়ের কোলে চড়েই হলো বিদ্যাপীঠে আমার প্রথম অভিষেক ।
নিয়মিত আর্থিক দীনতার কর্কশ ধ্বনিতে জীবন তখন দূর্বিষহ।
ষাট টাকায় কেনা চাল,তেল আর শুকনো মরিচে যাপিত হতো আমাদের দিনকাল।
দীর্ঘশ্বাসের প্রবহমান নদীতে প্রতিফলিত হতো
আমাদের জীবনের বিরতিহীন বায়স্কোপ।
সপ্রতিভ মায়ের উৎকণ্ঠিত মনে বসত করতো আক্ষেপের স্রোতস্বতী।

মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে
শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে এসে আমার সঙ্গী
কেবল ধুলোজমা ক্যালেন্ডার, সৎ সাহস এবং তীব্র ইচ্ছা।
তারুণ্যের সরলতায় কৈশোরী নেত্রপল্লবে তখন জীবসত্তার নতুন রূপের জন্ম।
খাঁচায় বন্দি জীবন উপড়ে ফেলে এসে আমার উৎসুক মনের তখন খুব সাধ –
প্রিয়তমেষুর জীবনে উপনিবেশ গড়ার।
অথচ প্রিয়তমেষুর নিমিত্তে প্রেম নিবেদনের আবশ্যক কোনো বিলাসবহুল রসদ আমার নেই।
পারিপাট্য স্বভাবে পরিপূর্ণ পৌরুষের কাছে বেলোয়ারি চুড়ি উপঢৌকন চাওয়ার মতো,
প্রেমাতাল গন্ধবিলাসে অভিলাষী হওয়ার মতো,
ভালোবেসে ভাঙনের নীলদাগ বয়ে বেড়ানোর মতো
ঔদ্ধত্যপূর্ণ দুঃসাহসের ছিটেফোঁটাও আমার মাঝে নেই।

সমুদ্রজলে চাল ধুয়ে যার গর্ভধারিনী লবনের অভাব মেটায়,
ঘাত-প্রতিঘাতে বিদ্ধ হয়ে
অস্তগামী সূর্যের মতো যাকে আঁধারমাঝে সমর্পিত হতে হয়,
তার এমন করে অপ্রাপ্তির বেদনাকে আলিঙ্গন করাই শ্রেয়।

সাহিত্যাঙ্গনে সপ্ততল আকাশকে উপজীব্য করে
নৃতত্ত্বের যে উদার মানবিক প্রেমের গল্প লেখা হয়,
তা কেবল জলপাইরাঙা রাতের শহরেই দিব্যি মানিয়ে যায়,
বিষাদশান্ত,আটকপালে বর্ষাপ্রেমীর জীবনোপন্যাসে নয়।

অতঃপর;
তীব্র আক্ষেপে শিউলিতলার গন্ধরাগে অভিমান ভাঙার নিঃসীম অপেক্ষার আপদমস্তক সমাধি হয়।
না চাইতেও ধুলোপড়া আয়নায় ভেসে ওঠে
নশ্বর জীবনে নৈরাশ্যবাদী হওয়ার অন্তিম সাইরেন।
উপায়ান্তর না দেখে;
ভাবনার বিলাসিতা উপেক্ষা করে জীবনঘড়ির পিঞ্জরবদ্ধ আকাশকে আপন করে নিতে হয়।
চোখের শার্সিতে জমে থাকা মেঘের শ্রাবণঘাটে স্নান করে শুদ্ধ হতে যেয়ে
নিদারুন সোল্লাসে মুখে আওড়াতে হয়, “আমার তাবৎ জীবন বর্ষাকাল।”

 

এন.এইচ/পাবলিক ভয়েস

প্রিয় পাঠক! আপনিও লেখা পাঠাতে পারেন সাহিত্য, ফিচার, ইসলাম ও জীবনযাপন বিভাগে। সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেন না। লেখা পাঠাতে ব্যবহার করুন পাবলিক ভয়েসের মেইল publicvoice24@gmail.com। ফেসবুক পেজের ইনবক্সেও লেখা পাঠানো যায়। (তরুণ লিখিয়ে বন্ধুদের লেখা ছাপা হয়। তবে লেখা নির্ভুল হতে হবে)

মন্তব্য করুন