ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও লেজহারাদের গল্প

প্রকাশিত: ১:০০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৮, ২০২০

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থীরা গো-হারা হেরেছে, এটাই যেন একটা বিরাট ঘটনা। আওয়ামী লীগ আসমানভাংগা জিতেছে এবারে। এর পূর্বে বড় বিজয়কে “ভূমিধ্বস জয়” বলে অভিহিত করা হতো। এটাকে আমি “আসমানভাংগা বিজয়” বলি। সেটা তো নস্যি করো দিলো এবারে। আওয়ামী লীগের এমন আসমানভাংগা বিজয়ের ক্ষণে ইসলামী আন্দোলন কেন খারাপ করলো? এমন প্রশ্ন অনেকের। কেন এ ধরনের প্রশ্ন করেন সবটা জানিনা, তবে মতলব খারাপ সেটা বুঝি।

এ নির্বাচনকে যারা “নির্বাচন” বলে মনে করেন তাদের জন্য করুণা। তাঁদের মাঝে আওয়ামী প্রেতাত্মা ভর করছে। একশো পার্সেন্ট জালিয়াতিতে ভরা এ নির্বাচনের ভোটসংখ্যা ও পরিসংখ্যান দ্বারা দলীল পেশ করা সত্যকে অস্বীকার করার নামান্তর। এটা একটা অগ্রহণযোগ্য ও শতভাগ জালিয়াতিতে ভরা নির্বাচনের নামে প্রহসন। এমন কলঙ্কিত নির্বাচনের ভোট থাকলেই কি? না থাকলেই বা কি?

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এমন একটি ইসলামী রাজনৈতিক গ্রুপ, যা হক্বের নিক্তিতে উত্তীর্ণ। বিতর্কহীন ও সম্ভাবনাময়ী।

এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম পীর সাহেব চরমোনাই মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম (রঃ)। তিনি যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও ওলী হযরত আল্লামা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর ও আল্লামা শায়খুল হাদীস আজিজুল হক সাহেবের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তাঁদের আহ্বানে তিনি রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ঐক্যজোটের ব্যানারে কাজ করলেও এক পর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশ নামক ইসলাম বেইজড দলটির গোড়াপত্তন করেন।

ইসলামী ঐক্যজোট থেকে চলে আসার মূল কারণ ছিল, জোটের রাজনীতিতে ঐ দলটি জড়িয়ে পড়েছিল। তিনি বা তাঁর দলের মৌলিক একটা নীতি হলো, প্রচলিত রাজনৈতিক জোটের অংশীদার হবেন না।এতে সমাজ তথা রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায় না বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জোটভূক্ত নেতাদের কাছে ইসলামী আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। এমনটা মরহুম পীর সাহেব হুজুর:(রঃ) বিশ্বাস করতেন। এবং এ স্বকীয়তা ও আপোষহীনতার নীতি আজীবন তিনি লালন করে গিয়েছেন।

২০০৬ সালে মরহুম পীর সাহেব চরমোনাইর ইন্তেকালের পর অদ্যাবধি সে নীতিতে অটল আছেন বর্তমান শায়েখদ্বয়, আইবি’র মুহতারাম আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম ও সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম । ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের বাধ্যবাধকতার কারণে “শাসণতন্ত্র” শব্দটি কাটা পড়ে। অন্যথায় নিবন্ধন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে হতো।

আওয়ামী লীগের দু টার্ম দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। এর কারণ হিসেবে সমালোচকরা বলে থাকেন, আওয়ামী লীগের আনুকূল্য পেয়ে এটা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ মাঠ ছেড়ে দিয়েছে। দলটির বিরূদ্ধে আওয়ামীপ্রীতি বা দালালীর অভিযোগ করে থাকে মুখচেনা একটি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আরো কয়েকটি ইসলামী দলও। এর সাথে কতক সাংবাদিকও প্রচারণায় শামিল হন।

তারা এসব অভিযোগ করেই যাচ্ছেন কিন্তু প্রমাণ দেখানোতে বরাবরই ব্যর্থ। যেখানে বিএনপি সভা-সমাবেশ করতে পারে না, সরকার অনুমতি দেয় না সেখানে ইসলামী আন্দোলন মিছিল করে, সমাবেশ-মহাসমাবেশ করে। এটা আঁতাত ছাড়া সম্ভব না। এই হলো পয়েন্ট।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতা কর্মীদের চরিত্রে কোন কালিমা নাই যেভাবে নেই শীর্ষ নেতাদের। ইসলামী ঘরানায় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বৃহৎ স্বপক্ষশক্তি আর নেই। সুতরাং সরকার এ দলটিকে সমীহের চোখে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। সব দলেই রাজাকার আছে এমনকি খোদ আওয়ামী লীগেও, অথচ আইএবি’তে একজনও পাবেন না। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ইসলামী আন্দোলন করেন। এ ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ শতভাগ পাশ।

আইএবি বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সমাবেশ- মহাসমাবেশ, প্রতিবাদ -বিক্ষোভ মিছিল করেছে। হ্যাঁ, এটা বহুলাংশে সত্যি। এসব কর্মসূচি পালনে পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। ইসলামী আন্দোলন নিজস্ব কর্মসূচির জন্য দরখাস্ত দিলে বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সীর মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া হয়, তাতে হয়তো কোন হবু ভায়োলেন্সের আভাস পায় না। ফলে অনুমতি নিয়েই আইএবি কর্মসূচি পালন করে।

আইএবি কর্মীদের দ্বারা আজতক সমাজবিরোধী বা আইনবিরোধী কোন কাজ সংগঠিত হয় নাই বিধায় পুলিশের পক্ষ থেকে কর্মসূচি পালনে হয়তো বারিত হয়নি। তবে কর্মসূচি পালনে শতভাগ অনুমতি মিলেছে তাও সঠিক নয়। মাঝে মাঝে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা ভায়োলেন্স করেনা, করতে পারেনা এমন একটি ভাবমূর্তি পুলিশের খাতায় রয়েছে। এটা অন্য দলগুলো থেকে একটু ব্যতিক্রম কিনা!

আমি আগ বাড়িয়ে আরো বলতে পারি, বিএনপি-জামাত সরকারে এলেও আইএবি’র প্রতি পুলিশের নেক-নজর আরো ত্বরান্বিত হবে। ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসার সুযোগ নেই।

আইএবি’র নেপথ্যে আরেকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনও বটে, নীতি-আদর্শের পাশাপাশি আল্লাহভীরুতা সকল নেতা কর্মীদের মাঝে বিরাজমান। তাঁদের মাঝে উগ্রতা খুঁজে পাবেন না। তাঁরা আল্লাহকে একটু বেশীই ভয় করেন। সুতরাং পুলিশ প্রশাসন থেকে সুবিধা প্রাপ্তির পেছনে অন্য কিছু তালাশ করা বাতুলতা মাত্র।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এখনো এমন কোন শক্তি হয়ে উঠেনি, যাতে সরকার নিজেদের বিপরীতে হুমকিস্বরূপ মনে করতে পারে। সুতরাং এমন দূর্বল শ্রেণীকে নিজ স্বার্থে সুযোগ দিতে পারে যাতে তাদেরকে একটু একটু গণতান্ত্রিকও বলা যায়। আর সবার কন্ঠ রোধ করলেও এখানে একটু ছেড়ে দিয়ে যদি গণতন্ত্রীর লেবেল লাগানো যায় ক্ষতি কি? সরকারের নীতিনির্ধারকরা এমনটা ভেবে ইসলামী আন্দোলনকে ক্ষূদ্র সাইজের স্পেস দিতে সমস্যা কোথায়? হয়তো সেটাই করেছে।

সরকারের যদি এতোই পেয়ারের হবে! তাহলে কেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদের যে সব আসনে জেতার সম্ভাবনা ছিলো সেখানে খাতির করে ‘রাইতের আমলে’ ভোট কেটে বাক্স ভরা থেকে বিরত থাকলেন না? আইএবি’র আসনভিত্তিক ভোটের যে পরিমাণ দেখানো হয়েছে তা তো ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। বিগত দশ বৎসরে অন্ততঃ দশগুন ভোট বেড়েছে। আইএবি অনেক উন্নতি করেছে, দেশের সকল মিডিয়া তাতে একমত। কিন্তু ভোটের সংখ্যা দেখলে সহজেই অনুমেয়, আওয়ামী লীগ এখানেও স্বভাবগতভাবে আওয়ামী চরিত্র ফলিয়েছে। কোন খাতির করে নাই। আরে! ঐ পরিমানের চেয়ে বহুগুণ খাছ কর্মীই আছে আইএবির। তাঁদের ভোট গেল কি? সাধারণ ভোটারদের ভোট তো গরহাজির!

তারপরও যারা আওয়ামী প্রীতির কথা বলবেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো- আইএবি’র প্রতি আপনার বিদ্বেষ ভয়ংকর লেবেলে পৌঁছেছে। আর এ বিদ্বেষের কারণে নিজেদের অধঃপতন ঠেকাতে তো পারেন নাই বরং তা নিয়ে অভ্যন্তরীণ আত্মসমালোচনার জ্ঞাণও হারিয়ে শুধুমাত্র আইএবি নিয়ে পড়ে আছেন। আমার অনুরোধ থাকবে নিজেদের কাজগুলো করুন, তাহলে অন্যকে নিয়ে চর্চা করার সময় পাবেন না। সে ই ভালো।

আমি একটি ইসলামী দলের নাম নিবো না। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক ময়দানে এককোণে অবস্থাণ করছে। একেবারে কোণঠাসা। তাঁদের গায়ে পিচ্ছিল কাদা লেগে থাকায় বারবার হোঁচট খাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কৌশল তাদের থেকে আলাদা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র দল। নিজস্ব মেনিফেস্টো আছে। দেশের আলেম সমাজের অধিকাংশের নিকট আইএবি’র রাজনীতিটা পছন্দ। অথচ তাদের পক্ষে আলেম সম্প্রদায়ের সমর্থন কোনকালেই ছিলনা, এখনো নাই।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষে সকল সেক্টরের আলেমদের সমর্থন ও শুভকামনা রয়েছে। সুতরাং আইএবি’কে বিতর্কিত করতে পারলে বহুত ফায়দা হবে- এমন নীতির কারণে তারা নানা অপপ্রচার চালায়। সরকারের থেকে চরমোনাইওয়ালারা অনুদান নেয়ার অলীক গল্প ফাঁদে। কিন্তু তা বুমেরাং হওয়ায় বারবার তাদেরকে হতাশ হতে হয়। আর এ হতাশাবোধ থেকে বিরতিহীনভাবে সরকারের সাথে সম্পর্কের গল্প বাজারজাত করে। আমাদের যা নাই তা তোমাদের থাকবে কেন?

নরসিংদী এলাকায় একটি উইভিং ফ্যাক্টরীর রংয়ের খোলা ড্রামে এক শিয়াল কৌতুহলবশতঃ নেমে পড়ে গোছল করতে। কিন্তু বের হবার সময় লেজ আটকে পড়ায় সে প্রাণপনে দৌড় দিলে লেজটা সেখানে কাটা পড়ে। রংমাখা শরীর নিয়ে স্বজনদের কাছে গেলে সবাই তার বর্ণিল শরীরের দিকে তাকালে সে রংয়ের পানিতে গোসল করার বহু ফায়দার কথা বর্ণনা করতে থাকে, যাতে সবাই ওখানে গোছল করতে গিয়ে লেজটা বিসর্জন দিয়ে আসে…

এম শামসুদদোহা তালুকদার। কলামিস্ট, বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন