

স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারীর নেতার নাম অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দীন। ৮০-র দশকের শুরুর দিকে মাদরাসা ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন আন্দোলন করে ‘বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড’কে একটি স্বায়ত্বস্বাসিত বোর্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রনী ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছারছিনা মাদরাসা সংকটাপন্ন হলে তৎকালীন সময়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে এ সংকট সমাধানে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাথে যুবকদের নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করেছেন নিরলসভাবে।
ভারতে মুসলিম নিধন বন্ধ এবং বাবরী মসজিদ যথাস্থানে নির্মানের দাবীতে আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন জেলে বন্দী জীবন পার করেছেন যে সংগ্রামী মুজাহিদ তিনি ইসলামী আম্দোলন বাংলাদেশ এর সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ইসলাম দেশ মানবতার রক্ষায় মজলুম মানুষের পক্ষে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দীন।
জন্ম পরিচয় ও শিক্ষা জীবন :
অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দীন বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জের সন্তান। তার বাবার নাম আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল আলী। তিনি ছিলেন বৃটিশ আমলের টাইটেল পাশ। তিনি ১৯৪৭ সালে বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন একটি আলীয়া মাদ্রাসা। তারা ১১ ভাই এবং ৫বোন। এটিএম হেমায়েত উদ্দিনের লেখাপড়ার শুরু তার বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানেই। তারপর খুলনা শিরোমনি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পবিত্র কুরআন হেফজ করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় আসেন পশ্চিম রাজাবাজার জামে মসজিদে তারাবি পড়াতে। পরে ঐ মসজিদে ইমামতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ঢাকা আলীয়ায় লেখাপড়া করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে পশ্চিম রাজাবাজার হেফজখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ঢাকার মালিবাগে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী আবুজর গিফারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। কিছুদিন তার পিতার প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে রামপুরা একরামুন্নেছা ডিগ্রি কলেজ, ঢাকায় অধ্যাপনা করছেন।
এটিএম হেমায়েত উদ্দিন-র জীবন সংগ্রাম :
এদেশের ইসলামী রাজনীতির ডায়েরীতে ইতিহাস রচনার যোগ্য অংশীদার আপোষহীন লড়াকু সৈনিক এই দেশপ্রেমিক মানুষটি। তিনি ছাত্র জীবন থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৯ সালে (ব্রিটিশ আমলের) প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া’র তিন সেশনের (১৯৮১-৮৩) কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন। কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েই মাদরাসা ছাত্রদের ১৭ দফা দাবী আদায়ে ১৯৮১ সনে বাংলাদেশ জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার উদ্যোগে জাতীয় সংসদ ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করেন তিনি। এবং সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সফলও করেন কর্মসূচি। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে অধ্যাপক এটিএম হেমায়েত উদ্দিন বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এর স্বায়ত্বশাসনের দাবী পূর্ণ করেন। মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড স্বায়ত্বশাসনের দাবী বাস্তবায়নের পর জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হাফেজ মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সংবর্ধনা সভা। সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখেন স্বায়ত্বশাসিত মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান জনাব বাকিবিল্লাহ খান।
৮০-র দশকে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাথে যুবকদের নিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে থেকেই হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অটুট। যখন খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠা হয় তখন হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে একদম শুরু থেকেই তিনি খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেখানে তার সঙ্গে কাজ করেন। হাফিজ্জী হুজুরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন সর্বস্ব দিয়ে। খেলাফতের স্বপ্ন পূরণে ত্যাগ আর কুরবানীর নযরানা পেশ করেন। হাফিজ্জী হুজুরের মৃত্যুর পর খেলাফত আন্দোলন দূর্বল হয়ে গেলেও দমে জাননি তিনি। খেলাফতের স্বপ্ন আবার দেখেন নতুন করে হাফিজ্জী হুজুরের শীষ্য সৈয়দ ফজলুল করিম (পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ) এর নেতৃত্বে।
সময়ের পরিক্রমায় তিনি যুক্ত হন এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া তৎকালীন ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’র সঙ্গে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন শ্লোগান “শুধু নেতা নয়, নীতির পরিবর্তন চাই” প্রবর্তক সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. এর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিভার ডানা মেলে এটিএম হেমায়েত উদ্দীনের। ১৯৮৭ সালে ১৩ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সেই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক শক্তিটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম ইসলামী শক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। দলটির আজকের এই অবস্থানের পেছনে যতজন লড়াকু ও নিবেদিত কর্মীর অবদান রয়েছে, তার মাঝে এটিএম হেমায়েত উদ্দীনের অবদান অনস্বীকার্য৷ তিনি ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ছিলেন, মনে হতো তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও পেশাই ইসলামী আন্দোলন। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করে তিনি আজ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব।
১৯৯১ ও ৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের মিনার প্রতিকে বাগেরহাট ৪ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন। ২০০১ সালে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বাগেরহাট ৩-৪ আসনে নির্বাচন করেছেন। তিনি মসজিদের নগরী অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০০২ এ মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে ঢাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম সারির এক বীরের নাম এটিএম হেমায়েত উদ্দীন। আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল মিটিংয়ে পুলিশের টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ উপেক্ষা করে পল্টনের রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকতেন সাহসের প্রতীক হিসেবে। সভা, সমাবেশ, সেমিনার, মিছিল-মিটিং প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। তাঁর রক্তে প্রতিবাদের বারুদ এতটাই জাগ্রত ছিল, অন্যায় বিরোধী শ্লোগানে সর্বাগ্রে দেখা যেত তাকে। সারাটা জীবন জাতির কল্যাণে ব্যয় করেছেন। পীর সাহেব চরমেনাই রহ. এর ডানহাত হয়ে ইসলামী রাজনীতিতে জীবন বিলিয়েছেন লাভ লোকসানের হিসেব মিলানো ছাড়াই।বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ করে জেল খেটেছেন দীর্ঘ সময়। নাস্তিক মুর্তাদ বিরোধী আন্দোলন, বাবরি মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন সহ এমন কোন আন্দোলন সংগ্রাম নেই যেখানে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেননি। রাজপথ থেকে যতবার গ্রেফতার হয়েছেন ততবারই দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে ফিরে এসেছেন আবারও রাজপথে। রাজনীতিতে ভয় বলে কোন শব্দ ছিল না তার জীবনে। বহুবার মিছিলের ব্যানার ছিনেয়ে এনেছেন পুলিশের হাত থেকে।
শ্লোগানের আওয়াজ শুনলে এটিএম হেমায়েত উদ্দিন নিজেকে ধরে রাখতে পারতেন না। তাঁর পুরো দেহ ও হৃদয়জুড়ে প্রতিবাদের স্রোতধারা বয়ে যেতো। তার শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় মিশে আছে দেশপ্রেম, ইসলাম আর কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন। নির্মল আদর্শের অকুতোভয় এক সৈনিক তিনি।
ছোট্টো দলটির আজকে ঢাকা মহানগরে লাখো কর্মী আছে। এই যে বিশাল কর্মী বাহিনী গড়ে ওঠেছে এর পিছনের কারিগর যিনি তিনি এটিএম হেমায়েত উদ্দিন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে রাজধানী ঢাকা ইসলামী আন্দোলনের দূর্গে পরিণত হয়েছে। ঢাকার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন সংগঠনের কাজে। ইসলামী বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে কাজ করতো সর্বদা। হেঁটে হেঁটে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নের ফেরি করেছেন সারাটি জীবন। ছড়িয়ে দিয়েছেন বিপ্লবের কামনা সহকর্মীদের মাঝে। তাঁর বক্তব্য ও বজ্রকণ্ঠ বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটিএম হেমায়েত উদ্দীনের বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর প্রতিবাদী শ্লোগান যুগযুগ ধরে স্মরণ রাখবে জাতি। তিনি নতুন প্রজন্মের কাছে রাজনৈতিক আদর্শ।
আজ তিনি শয্যাশায়ী। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অসুস্থ শরীর নিয়েও মাঝে মাঝে পাগলের মতো ছুটে আসেন রাজপথে। ইসলামী রাজনীতির এই প্রাণপুরুষ প্রিয় হেমায়েত উদ্দিন স্যার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন দীর্ঘ কয়েকমাস যাবৎ। বিছানা থেকেই চোখের পানিতে আফসোস জানাচ্ছেন জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামে সময় দিতে পারছেন না বলে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পীর সাহেব চরমোনাই এর নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে থেকে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে গণবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো আপোষহীন ভাবে এখন পর্যন্ত সে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আশাকরি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাছাকাছি এসে গেছে। আন্দোলনের ত্যাগী নির্লোভ কর্মী বাহিনীকে দেখলে তার ঘরের মধ্যে বন্ধি হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। তার কাছে মনে হয়, তিনি যেনো দ্বীনি আন্দোলনের কাজ করায় অন্যদের থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। অনেকদিন হয়ে গেল তিনি অসুস্থ হয়ে আছেন। আগের মত আসতে পারেন না রাজপথে। কিন্তু যখনই আসে তখন শুনতে পাই তার দারাজ কন্ঠের বক্তৃতা। মনে হয় তিনি আজও ৮০ দশকের সেই এটিএম হেমায়েত উদ্দিন।তাঁর বক্তব্যের শেষে বলতেন, আবার দেখা হবে আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রতিবাদ আর রাজপথে; কথা হবে সভা, সেমিনার সমাবেশ আর মিছিলে। আজও তাকে রাজপথে দেখলে লক্ষ যুবকের প্রাণের বিপ্লবের হাওয়া লাগে। প্রিয় মানুষটি সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসুক বাংলার রাজপথে। বজ্রকণ্ঠে কাঁপিয়ে তুলুক অত্যাচারী জালেম শাহীর মসনদ।
লেখক : সামছ্ আল ইসলাম ভূঁইয়া
গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মী