আলহামদুলিল্লাহ! আমার শরীরে সামান্য আঁচড়ও লাগেনি : আল্লামা ত্বাকী উসমানী

প্রকাশিত: ২:৫৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০১৯

হামলার পর দারুল উলুম করাচীর মসজিদের সামনে আসার পর মুফতী তাকী উসমানী সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে মুচকি হেসে বলেন— আলহামদুলিল্লাহ! আপনাদের দোয়ায় আমার শরীরে সামান্য আঁচড়ও লাগেনি।


করাচি থেকে ওমর ফারুক ইবরাহীমী :

ইতোমধ্যে আসরের আযান হয়ে গেছে। মসজিদের সামনে অসংখ্য মানুষ কোনো একজনের অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টি গিয়ে মেশে এক জায়গায়— লক্ষ্য মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন হযরত শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর বাসার দরজায়।

তিনি এলেন। আল্লাহু আকবার! তাঁর মুখে ভয়ভীতির লেশমাত্র নেই! কী নূরানী-হাস্যোজ্জ্বল চেহারা তাঁর! অথচ এইতো কিছুক্ষণ আগে তাঁর ওপর দিয়ে কী তুফান বয়ে গেলো! পাষণ্ড সন্ত্রাসীরা তাঁকে নিয়ে কী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের ফাঁদই না পেতেছিল! কিন্তু আল্লাহ চান তাঁর প্রিয় বান্দাকে দীনের জন্য বাঁচিয়ে রাখবেন।

হামলার পর তিন-চার স্তরের নিরাপত্তায় বেষ্টন করে দেওয়া হয় তাঁকে। অথচ মাত্র কিছুদিন আগে সরকারী মহলে তাঁর নিরাপত্তা প্রত্যাহারের জোর দাবি উঠেছিল! উপচেপড়া মানুষ আজ তাঁদের সেই “আহ্লাদী নিরাপত্তা” মানলেন না। নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সবাই। হযরতকে ফিরে পেয়ে কেউ আনন্দে হাসেন, কেউ কাঁদেন। হযরতের ঠিক বাঁপাশ ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে মসজিদ পর্যন্ত যাই। মাঝে মুসাফাহা করে নিজের অজান্তেই হযরতের বাঁহাতটি কিছুক্ষণের জন্য চেপে ধরে রাখি।

মসজিদের সামনে আসার পর হযরত সবার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে মুচকি হেসে বলেন— আলহামদুলিল্লাহ! আপনাদের দোয়ায় আমার শরীরে সামান্য আঁচড়ও লাগেনি।

আসরের নামাযের পর হযরত মিম্বরে আরোহন করেন। সংক্ষিপ্তভাবে আক্রমণের পুরো বিবরণ সবার সামনে তুলে ধরে তিনি বলেন-

“আসসালামু আলাইকুম!
আমার ধারণা, আপনারা আজকের ঘটনাটি নিয়ে বেশ চিন্তিত এবং পেরেশান। তাই আমি আপনাদেরকে সংক্ষেপে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি— আমি বাইতুল মোকাররমে (দারুল উলূম করাচি থেকে ২০/২৫ মিনিট দূরত্বে) জুম্মা পড়াই। সে মানসেই দারুল উলুম থেকে বের হই। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী এবং নাতি-নাতনীরা ছিল। তারা ছয়-সাত বছরের শিশু। (বাইতুল মুকাররমে হযরতের এক কন্যার বাসা, তাই প্রায় সময় তাঁর আহলিয়াও সঙ্গে যান।) একজন নিরাপত্তা কর্মী যিনি পুলিশের পক্ষ থেকে আসেন তিনি আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন। আমার ড্রাইভার হাবিব ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল।

আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর হঠাৎ বৃষ্টির মতো মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তারা আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করেই গুলি চালায়। সামনের দিক, ডান ও বাম দিক থেকে অনবরত বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। আমার ড্রাইভারের ডানহাতে এবং বাহুতে দুটি গুলি লাগে। নিরাপত্তা কর্মীরও মাথায় গুলি লাগে। আল্লাহ তা’আলার দয়া ও অনুগ্রহ আমার শরীরে, আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের গায়ে ভেঙ্গে আসা কাঁচের টুকরোর আঘাত ছাড়া তেমন কোনো আঘাত লাগেনি।

হামলাকারীরা আক্রমণ করে ফিরে যায়। তাদের হয়ত খেয়াল হয়— যাকে লক্ষ্যবস্তু বানায় তাকে লক্ষ্যে পরিণত করতে পারেনি। তখন তারা ফের ফিরে আসে এবং দ্বিতীয়বারের মতো চতুর্দিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমার নিরাপত্তাকর্মী আবারও গুলিবিদ্ধ হয়। আমার ড্রাইভারের ডানহাত গুলির আঘাতে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু সে বাম হাত দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জীবনবাজী রেখে গাড়ি চালাতে থাকে সে।

আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার হাতে আঘাত লেগেছে। তুমি সরে আমাকে দাও, আমি গাড়ি চালাই। কিন্তু সে রাজি হয়নি। সে বলে— হযরত! আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এমনটি করবেন না। ওরা আপনার ওপর পরপর দুবার হামলা করেছে। শঙ্কা আছে হয়ত তৃতীয়বারের মতোও হামলা চালাবে। আপনি পেছনে বসুন এবং মাথা নিচু করে বসুন যেনো আপনার শরীরে গুলি না লাগে।

তার হাত গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল। রক্ত ঝরছিল। এই অবস্থায় সে নিপা চৌরাঙ্গি থেকে লিয়াকত ন্যাশনাল হসপিটাল পর্যন্ত নিজে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছুনোর পর আমি তাকে গাড়ি থেকে নামাই। ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। কর্তৃপক্ষ দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আমরা আশা করেছিলাম নিরাপত্তা কর্মী বেঁচে যাবেন। কিন্তু ডাক্তাররা জানালেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ড্রাইভারের কথা জানালেন যে, এর চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা করলে তিনি বেঁচে যাবেন এবং সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমাদের পেছনের গাড়িতে একজন ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। গুলির আঘাতে নিরাপত্তা কর্মী শহিদ হয়ে যান এবং ড্রাইভার মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনিও হাসপাতালে ভর্তি। তার অপারেশন হবে।

আল্লাহর তাআলার কুদরত যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনাদের দোয়া এবং আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ছিল। আল্লাহ তাআলা আমাকে কীভাবে রক্ষা করেছেন তার ব্যাখ্যা আমি জাগতিক কোনো জিনিসের মাধ্যমে করতে পারব না। আল্লাহ তা’আলার দয়ায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থ আছি, ভালো আছি। আমি ভয়ও পাইনি এবং চিন্তিতও নই। কিন্তু আমার দুইজন সাথী শহিদ হয়েছেন। তাদের জন্য আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। তাদের পরিবারের প্রতি আমার দোয়া ও সমবেদনা। দুইজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ সুস্থতা দান করেন। আমীন।”

প্রসঙ্গত : উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দীন ও ইসলামী স্কলার পাকিস্তানের মুফতি তাকী উসমানীর গাড়ি বহরে শুক্রবার (২২ মার্চ) দুপুরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় মুফতী তাকি উসমানী বেঁচে গেলেও নিহত হয়েছেন তার দুজন সঙ্গী।

হামলাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু না জানা গেলেও ধারণা করা হচ্ছে পাকিস্তানের উগ্র চিন্তা-ধারণা লালন করা কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাজ এটি যারা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চায় বলে দাবি করছে পাকিস্তানের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

মন্তব্য করুন