

“মুক্তির মূলমন্ত্র ইসলামী শাসনতন্ত্র” এই স্লোগান কে সামনে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন যা আজকের ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে (০৩৪ নং) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
সামছ আল ইসলাম ভূঁইয়া : খোদাদ্রোহী শাসনব্যবস্থার যাতাকলে ইসলামী চেতনা যখন প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছিল। ইসলামপন্থী জনতা যখন একটি চরম প্রতিকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন সচেতন বিবেকবানদের মধ্যে এ অবস্থার পরিবর্তনের ও ইসলামকে বিজয় করার আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। সে আকাঙ্খা বাস্তবতা লাভ করে ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চের আজকের এই দিনে। “মুক্তির মূলমন্ত্র ইসলামী শাসনতন্ত্র” এই স্লোগান কে সামনে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন যা আজকের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে (০৩৪ নং) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল।
এই দলটি একক কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করেনি। বরং অনেকগুলো ইসলামী নেতা ও দলের সমন্বয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে এর কার্যক্রম শুরু হয়। চার বছরের ব্যবধানে এই ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এটি একটি একক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৮৭ সনে তদানিন্তন সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট আলিম, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী রাজনীতিবিদ অনুভব করলেন ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – চরমোনাই’র পীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক, ঐক্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুর রহীম, (জামায়াতের) মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলী, আওলাদে রাসূল মাওলানা আবদুল আহাদ মাদানী, তৎকালীন যুব শিবিরের সভাপতি অধ্যাপক আহম্মদ আব্দুল কাদের প্রমূখ। হাফিজ্জী হুজুরের মৃত্যুর পর তার সংগঠন খেলাফত আন্দোলনে ভাঙন সৃষ্টি ও ছোট দলগুলো আলাদা হয়েগেলে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করতেই ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন সৃষ্টি করা হয়।
চরমোনাই’র পীর সৈয়দ ফজলুল করিম শাসনতন্ত্র আন্দোলনেও ভাঙনের সংশয় প্রকাশ করলে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ঐক্যের জন্য পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে শপথ করলেন এবং সকলেই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ, সকলের উপস্থিতিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়া হবে এবং এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন। কিন্তু সেদিন সম্মেলনস্থলে গিয়ে জানা গেল ঐক্যবদ্ধ ইসলামী আন্দোলনের উদ্যোক্তা মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী দেশ ছেড়ে উধাও হয়ে গেছেন। তিনি নাকি নিজ দল জামায়াতের চাপে ইতিমধ্যেই পাড়ি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। কারণ জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে আরো কোনো শক্তিশালী ইসলামী ব্লক গড়ে উঠুক, এটা নাকি জামায়াত নেতারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
নির্ধারিত দিনেই ঢাকাস্থ মতিঝিলের হোটেল ‘শরীফস ইনে’ অনুষ্ঠিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশ ঘটলো। ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন পীর সাহেব চরমোনাই রহ.। সাংবাদিক সম্মেলনে পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ১৩ মার্চ ১৯৮৭ শাপলা চত্বরে সমাবেশে জনসম্মুখে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণা দেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত শাপলা চত্বরের সমাবেশে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পেটুয়া পুলিশী বাহিনী আক্রমণ করে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সারাদেশ থেকে আগত নেতাকর্মী ও তৌহিদী জনতার উপর। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ভিতরে গিয়েও পুলিশের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। তৌহিদী জনতার রক্তে রঞ্জিত হল শাপলা চত্বর আর জাতীয় মসজিদ। সেদিন স্বৈরশাহীর নগ্ন হামলা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চেতনাকে আরো শানিত করে। কিন্তু কিছুদিন পর এই ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম টি হতাশা ও অনৈক্য থেকে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে।
১৯৮৭ সনের ১ অক্টোবর মাওলানা আব্দুর রহীম ইন্তেকাল করেন। এরপর ‘৯১এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্যারিস্টার মাওলানা কোরবান আলীর নেতৃত্বে একটি অংশ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনে থেকে যায়, আর হাফেজ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ এ ঐক্য থেকে বের হয়ে যায়। অন্য দিকে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) এবং ইসলামী যুব শিবিরও এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে থেকে বেরিয়ে যায়। এবং ১৯৮৯-এর ১২ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলন (আ-গা) ও যুব শিবিরের এক যৌথ বৈঠকে খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত সবাই চলে গিয়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন চরমোনাই’র পীর সাহেবের নেতৃত্বাধীন একটি একক দলে পরিণত হয়।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ৭টি ইসলামি দলের রাজনৈতিক জোট ইসলামী ঐক্যজোটে ইসলামী আন্দোলন সম্পৃক্ত হয় এবং জোটবদ্ধ হয়ে মিনার প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও ইসলামী ঐক্যজোট থেকেই ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলটি। জোটের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি আমিনী রহ. বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে ইসলামী ঐক্যজোটের সম্পৃক্ত হওয়ার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে আসে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। ২০০১ সালে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট নামে জাতীয় পার্টি সহ কয়েকটি দল নিয়ে জোট গঠন করে। এবং ২৩টি আসনে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নির্বাচন করে।
২০০৬ সালের ২৬ নভেম্বর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’র আমীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করিম পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ইন্তেকাল করেন। এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন বর্তমান আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই। নতুন আমীরের হাত ধরে বেশি দিন চলতে পারেনি ইশা আন্দোলন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভের জন্য ২০০৮ সালের অক্টোবরে বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে তৈরী হওয়া ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে নিবন্ধন লাভ করে। সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট মহাজোটের বাহিরে থেকে এককভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১৬৬ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬৯টি ভোট পেয়েছিল, যা ছিল মোট ভোটের ১.০৫% পার্সেন্ট।
এখান থেকেই শুরু হয় দলটির নতুন পরিচিতি। হাতপাখা প্রতিকে তাদের নতুনভাবে পথচলা তাদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে দলটি নির্বাচন অংশ নেয়নি। তবে হাজারের উপরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদন্ধিতা করেছে, পৌরসভা ও সিটি নির্বাচন গুলোতে চমক লাগানো ভোট প্রাপ্তি দলটির। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিয়েছে এবং সবচেয়ে বেশী আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে। নির্বাচনের প্রচারণাও ছিলো বেশ জোরে শোরে। ব্যাপক কারচুপি ও নজিরবিহীন ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফলাফল প্রত্যাখান করে পূণরায় নির্বাচন করার দাবি জানিয়ে দলটি এই সরকারের অধিনে কোন ধরনের নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। রক্তাক্ত এক অধ্যায় সূচনার মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু হয় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলাম, দেশ ও মানবতার পক্ষে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করা দলটি তিন দশক ধরে পথ চলছে।
১৯৯১ সালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে লালন শাহর মুর্তি উচ্ছেদ, ১৯৯৪ সালে কুখ্যাত নাস্তিক তসলিমা নাসরিনের বিরোধী আন্দোলন, দাউদ হায়দার বিরোধী আন্দোলন, কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে আন্দলোন, মালিবাগ মসজিদ রক্ষার ও ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন, টিপাই মুখবাধ বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষানীতি ও নারীনীতি বিরোধী আন্দোলন, নাস্তিক ব্লগার বিরোধী আন্দোলন, মিয়ানমারের মুসলিম সহ সবধরনের মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন ও সংগ্রামে সর্ব ছিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. আওয়াজ তুলেছিলেন “শুধু নেতা নয় নীতির পরিবর্তন চাই”।
তিনি সকল শ্রেণীর সকল দল ও মতের ইসলামপ্রিয় জনতা এবং শান্তিকামী মানুষকে গণ-ঐক্য গড়ে তুলতে এবং নীতির পরিবর্তনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে ছিলেন। তিনি আরও বলেছেন- “নেতা কে হবেন, দেশ কারা পরিচালনা করবেন, তা নীতির আলোকে জনগণই নির্ধারণ করবে। কিন্তু তার আগে যে নীতি মানবতার মুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যে নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অক্ষম, যে নীতি সর্বত্র আল্লাহর নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে সেই নীতির পরিবর্তন ঘটাই”। নীতির পরিবর্তনের এই ঘোষণা একটি আদর্শিক বিপ্লবের আওয়াজ। তাই তো পীর সাহেব চরমোনাই রহ. চলে যাওয়ার ১যুগ পরও এ আওয়াজের প্রতিধ্বনি পৌঁছে যাচ্ছে গণ-মানুষের কানে কানে।
সংগ্রাম মুখর দুঃসাহসী অভিযাত্রা’র তিন দশক পাড়ি দেওয়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা।