গল্প দিয়েই শুরু করি। গতকাল এক পরিচিত জন জানতে চাইলেন, ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণের কী অর্থ আছে? তারা কি জিততে পারবে? প্রশ্নটা করে তার চওড়া মুখটাতে একখানা বিদ্রুপের হাসি ছড়িয়ে দিলেন। রেগে না গিয়ে আমি হেসেই তার জবাব দিলাম, আরে ভাই তারা তো এক মরতবা জিতেই গেছে। তিনি জানতে চাইলেন কেমনে? বললাম, কেন? রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন না? আর কেমনে! এই যে প্রায় তিন দশক আগে পরিবেশ পরিষদ কর্তৃক ঢাবিতে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এবং সেই রুলসের জুজু তুলে ইশা ছাত্র আন্দোলনকে সুদীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিতব্য কাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে দেবার হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্ধের হাইকোর্ট দেখে ইশা ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দমে জাননি।
তারা পরিবেশ পরিষদকে চ্যালেঞ্জ করেছে। হাইকোর্টে যাবার হুমকি দিয়েছে। কুপোকাত হয়ে গেছে পরিবেশ পরিষদ। এজন্যেই আজকের ঢাবির ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জুব্বা-টুপি পরা তরুণেরা। কী ছবিগুলো দেখলে প্রানে লাগেনা? তার মুখটা অল্পতেই বিমর্ষ হয়ে গেল। যাইহোক, তাকে এক কথায় জবাব দিয়ে বিমূঢ় করে দিলেও ইশা ছাত্র আন্দোলনের অবদান কিছুতেই এতটুকু মাত্র নয়। নিঃসন্দেহে অপরিসীম। ঢাবির দৃশ্যমান রাজনীতিতে তারা অস্তিত্বের জানান দিয়ে গোটা ইসলামী রাজনীতিকে দায়মুক্ত করেছে। বহুকাল ধরে যারা এদেশে ইসলামী রাজনীতি করছেন কিন্তু মাদরাসার বাইরে ভিন্ন কোনো ধারা এখনও তৈরি করতে পারেননি, এই নবীন সংগঠনটি তাদেরকে সামনে হাঁটার সাহস ও প্রেরণাও দিয়েছে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠন এজন্যেও দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন ছিল যাতে বামপন্থীরা ঢাবিকে তাদের অভয়ারণ্য ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে না পারে। এবং ইসলামপ্রিয় শিক্ষার্থীরা যেন হীনমন্যতায় না ভুগে। সে কাজটি ইশা ছাত্র আন্দোলন করে দেখিয়েছে। সুখের বিষয় নিঃসন্দেহে। তবে এ কাজটা যে সংগঠনটির জন্য কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, হালের রাজনীতির খোঁজখবর যারা রাখেন তারা অবশ্যই জানবেন। অপরাজেয় বাংলা থেকে যেদিন ইশা ছাত্র আন্দোলন মিছিল নিয়ে ঢাবি প্রদক্ষিণ করেছিল, সেদিন থেকেই বাম ও ক্ষমতাশীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে এবং ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেছিল। আলোচনা উঠে এল পড়ার টেবিল, চায়ের টেবিল থেকে নিয়ে টকশোর টেবিলে। ইশা ছাত্র আন্দোলন তাতে বরং জোয়ারই পেয়েছে।
যদ্দুর জানি, ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ফজলুল করীম মারুফ দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশের সকল পাবলিক ভার্সিটিতে তাঁর সংগঠনকে দৃশ্যমান করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। একজন তরুণ আলেম। বিলক্ষণ তিনি সফল হয়েছেন। অবশ্য ইশা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নিয়ে অদ্যাবধি সকল সেশনের কেন্দ্রীয় কমিটিতেই ঢাবিয়ানরা ছিল। এবং ছিল ঢাবি শাখা কমিটিও। তবে সেখানে সংগঠনের কর্মসূচী দৃশ্যমান ছিলনা। বলা চলে দৃশ্যমান হবার মোক্ষম সুযোগও তৈরি হয়নি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ ফজলুল করীম মারুফের ভাগ্য বলতে হবে, ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে তিনিই ভাগ্যবান সভাপতি যার আমলে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে।
এবং তিনি যোগ্য নেতৃত্ব বলে সংগঠনকে ঢাবির ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান করে দেখিয়েছেন। ডাকসুর সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে একঝলক দেয়া যেতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। তার পরের শিক্ষাবর্ষেই (১৯২২-২৩) ডাকসু প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ৩৬ টি। এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরে হয়েছে শুধু ৭ টি। যদিও গঠনতন্ত্রে প্রতি সেশনে ডাকসু নির্বাচন হবার কথা রয়েছে। আর সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে। সে নির্বাচনে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে আমানুল্লাহ আমান ও খাইরুল কবির খোকন।
ইতিহাস প্রমাণ করছে, ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচনটিও হয়েছিল ইশা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার আগে। কারণ, সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘৯১ এর আগস্টে। সুতরাং এই নির্বাচনে ইশা ছাত্র আন্দোলন যে একেবারেই নবীন তা বলার অবকাশ রাখেনা। আমি মনে করিনা যে, ইশা ছাত্র আন্দোলন গতানুগতিকভাবেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দৃশ্যমান হয়ে গেছে। বরং আমার মনে হয় সংগঠনটির আজকের এই অবস্থান হচ্ছে একজন মহামনিষীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন ও দোয়ার প্রতিফলন। তিনি হচ্ছেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও আমরণ ইসলামী হুকুমের তরে নিবেদিত এক মহাপ্রাণ স্বপ্নচারী শাইখ সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. পীর সাহেব চরমোনাই। তিনি বলেছিলেন, “আমার সুযোগ হলে চরমোনাইতে আলিয়া ও কওমিয়া সিলেবাসের পাশাপাশি কলেজও প্রতিষ্ঠা করব ইনশাআল্লাহ।” তিনি সুযোগ পাননি। চলে গেছেন পরপারে। কিন্তু আজ তাঁর সে স্বপ্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশের সমস্ত কলেজ ও ভার্সিটিতে ইশা ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে অসংখ্য মেধাবী তরুণ দ্বীনের দাওয়াত ও দীক্ষা লাভ করছে। ইসলামী বিপ্লবের পথে হাঁটছে খেলাফতের স্বাপ্নিক হয়ে। সৈয়দ ফজলুল করীমের রহ. কবরে রহমতের শিশির বারি বর্ষিত হবার জন্য এটা কি বিরাট বড় উপলক্ষ্য নয়?