ঈশ্বরথেরাপি

প্রকাশিত: ৭:০০ অপরাহ্ণ, মার্চ ৮, ২০১৯
ছবি: এনাইকিউ

-সাইফ সিরাজ

আমি, মানে ‘আমরা’র প্রতিনিধি। পালাতে চাচ্ছি। আসলে তল্লাট ছেড়ে নয়। রোগী ছেড়ে নয়। আমার কর্তব্য থেকে। আমার বিশ্বাস থেকে। আমার অবস্থান থেকে পালাতে চাচ্ছি। কিন্তু! কোথায়? নিজেরে ভেতরেই নিজে একটা খোলস বানিয়ে লুকিয়ে ফেলবো নিজেকে! আমার একটু শান্তির প্রয়োজন। এত এত চাপ আমি নিতে পারছি না। কেন যেন সব ‘আমরা’ হঠাৎ করেই আমি হয়ে গেছি। আর পারছি না। এখন আমাকে লুকাতেই হবে। আমি আমার ভেতরেই লুকাবো, যেখানে কেউ নেই আমার অবস্থান বলে দেওয়ার। আমি গেলাম… “না তুমি যেতে পারবে না। তোমার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার জায়গাটাকে আরেকবার নক করে দেখো।” আমি আবার গম্ভীর একটা আওয়াজ শুনতে পাই।
_ কে? কে?? একটা দীর্ঘ জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেই অদৃশ্যে।

পড়ে আসুন-ঈশ্বরথেরাপি (১ম পর্ব)

গভীর রাতের কথাটা এখনই বলছি। আমার প্রশ্নে জলদগম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে আসে…


_ আমি তোমার ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তোমাকে দিয়ে বিশেষ একটা কাজ নেওয়া হবে। দ্রুত তৈরি হও। হ্যাঁ, কেমনে তৈরি হবে? সেটাই বলছি। শোন। কেবল নিজেরে আত্মাকে সকল লোভ লালসা থেকে রক্ষা করো। এটাই তোমার প্রস্তুতি।
_ আমি আজীবন লোভ লালসা থেকে পবিত্র। তুমি যা বলবে, বলতে পারো। অবশ্য আমার একটা প্রশ্ন আছে।
_ কী সেই প্রশ্ন?
_ আমাকে যে কাজের জন্য বলা হবে তাতে কি আমার করা না করার স্বাধীনতা থাকবে?
_ না। ঈশ্বরের নির্দেশে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না। অবশ্য তিনি চাইলে দিতে পারেন। তবে আজকে তুমি কোন স্বাধীনতা পাবে না। তবে তোমাদের রোগীর চিকিৎসার জন্য তোমাকে এই কাজটা করতেই হবে। এবং তুমি এটাতে সানন্দেই রাজি হবে।
আমি আনন্দ চিত্তেই রাজি হলাম। একটা আশার আলোক দেখতে পেলাম। আমার তল্লাটের সেই পুরনো রোগীটা হয়তো এখন সুস্থ হয়ে ওঠবে। আমাদের রাতগুলো আর হতাশার ও হাহাকারের থাকবে না। রাতের মোহনীয় নিরবতা আমরা এখন উপভোগ করবো জমিয়ে। মনের মধ্যে এক চিকন শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।


আমাকে প্রথমে বলা হল। আমাদের তল্লাটের সব সাধু-সন্ত ও সন্নাসীকে ডেকে আনতে। যেহেতু আমার কোন প্রশ্ন করার অধিকার নাই। সেহেতু আমি ছুটতে চাইলাম। প্রতিনিধি বলল, ‘কোথায় ডেকে আনবে?’ আমি চুপ করে রইলাম। তিনি আবার বললেন, “নদীর ওপারে বিজন চরে নিয়ে আসো সবাইকে। অবশ্য অনেকেই প্রশ্ন করবে। আসতে চাইবে না। তখন তুমি তাদেরকে বাধ্য করার ইচ্ছে করবে। সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য করার ক্ষমতা পেয়ে যাবে।” আমি ছুটলাম। এবং কোন বাধা বিপত্তি ছাড়াই সবাইকে চরে নিয়ে আসলাম।

এরপর আমাকে আমাদের তল্লাটের সব অলি-বুজর্গ, গাউস-কুতুব, আলেম-উলেমা, পীর-মুর্শিদকে ডেকে আনার নির্দেশ দেওয়া হলো। ঈশ্বরের কথা শুনে তারা কেউই আর কোন প্রশ্ন না করেই চলে আসলো। তারপর একে একে ফকির, বাউল, পুরোহিত, নান, ব্রাহ্মণ, যাযক, কবি, সুশীল সবাইকে ডেকে আনার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু গোল বাধল, সুশীল সমাজ ও কিছু কবিদের ক্ষেত্রে। তারা আমাকে পাত্তা দিতেই চাইলো না। বরং আমাকে অপমান-অপদস্ত করতে চাইল। অবশেষে আমি আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করলাম। অল্প সময়ে সমাজের বিশেষ শ্রেণির সবাইকে একত্রিত করতে পারার জন্য তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। বললেন, ‘তোমার কাজ শেষ। চলে যাও।’ মন খারাপ করতে যাবো… ঠিক এমন সময় অদৃশ্য কণ্ঠ ভেসে এল। “আমার আজকের এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাবেদ আজকের আহুত প্রজাতির কোন একটা না হয়েও থাকবে।” চরের মধ্যে দেখলাম অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা মায়াজগত তৈরি হয়ে গেল।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম। সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটাতে কবি আর সুশীল সমাজ দখল নিয়ে লাগিয়ে দিল। একটু পর দেখলাম চারপাশেই সেই দখল কসরত। হেসে ওঠলাম। ঈশ্বরের অনাগত ধমকের কথা কল্পনা করে। তাই হল। ঈশ্বরের ধমক দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! এখন কেউ আর সংঘবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানাজন নানা জায়গায় বসে গেল।

ঈশ্বরের কণ্ঠ ভেসে এল। “তোমরা সবাই তোমাদের তল্লাটের রোগীটার চিকিৎসা করবে। রাজি?” চারপারশ থেকে গুনগুন আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। ঈশ্বর আবার ধমক লাগালেন। সবাই থেমে গেল। আমি দেখলাম আমাদের তল্লাটের সব মানুষই এখনো ‘শক্তের ভক্ত আর নরমের যম’ই আছে। একটু পর ঈশ্বর একজন একজন করে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু দেখা গেল, কেউই আমাদের তল্লাটে কোন রোগী আছে; সেই কথা স্বীকার করতে চাইছেন না। ঈশ্বর আবার ধমকে ওঠলেন। এবার সবাই কিছুটা নরম হলো। বলতে লাগলো রোগীর কথা। রোগীর রোগের জন্য একেকজন একেকজনকে দায়ী করতে লাগলো। শুরু হয়ে গেল হট্টগোল। কেউ বলছেন এসব পীর ফকিরেরাই আমাদের এই তল্লাটের রোগীর অনুস্থতার দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। এবার একে অন্যকে দোষারোপ শুরু হয়ে গেল। ঈশ্বর দেখলেন এদরেকে সাইজ দিতে হবে। এছাড়া এদের দীর্ঘ চর্চিত স্বভাবের বিপরীতে কোন কাজ কারানো যাবে না।


তিনি এবার একজন একজন করে অদৃশ্যে নিয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু কেউই আর ফিরে আসছে না। দেখে অনেকেই পালাতে চাচ্ছেন। কিন্তু এই ক্ষমতা কাউকেই দেওয়া হয়নি। একে একে ঈশ্বর সবার সাক্ষাৎকার শেষ করলেন। সবাই আবার মাঠে ফিরে আসলো। এতক্ষণে যারা এতগুলো মানুষের ফেরত না পাওয়ার চিন্তায় ব্লগ লেখা বা মিছিল করার প্ল্যান করছিল তাদের দেখে মনে হল বেশ মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। আবার আরেকদল মনক্ষুন্ন হয়েছেন একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বলির পাঠা বানাতে পারার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে দেখে। এরা অবশ্য আমাদের তল্লাটে যে কোন ঘটনার তদন্তের মোড় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে অলটাইম উস্তাদ।


ঈশ্বর এবার রোগীর চিকিৎসার জন্য দায়িত্ব দিতে চাইলেন। ঐক্যতানে সবাই দায়িত্ত নিতে রাজি। কেউ কেউ তো ঔষধ পথ্যের নাম বলতে শুরু করে দিয়েছে। ডাক্তার না হয়েই। এবার দায়িত্ব নিতে সবাই হট্টগোল শুরু করে দিল। ঈশ্বর বললেন, যে বা যারা দায়িত্ব নিবে তারা তাদের দেহের একটা অংশ রোগীকে দান করতে হবে। দান করার পাঁচ বছরের মধ্যে তার মৃত্যু হবে কে কে রাজি আছো? এবার কেউই আর কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে ফিসফাস চলতে থাকে। ঈশ্বর দেখলেন কেউই কোন কথা বলছে না। তিনি রেগে যাবেন। এমন সময় তিনজন কবি ওঠে দাঁড়ায়। বলে, “আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই রোগীর জন্য আমার একটা অংগ না পুরোটাই দিতে চাই।”ঈশ্বর খুশি না বেজার হলেন বুঝা গেল না।

মাত্র দশ মিনিট পরে আমি দেখলাম মাঠে কয়েকজন কবি ছাড়া কেউ নেই। ঈশ্বর ঘোষণা দিলেন, “তোমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য তোমাদের সবাইকেই আমি প্রত্যাহার করলাম। আমার এই সুন্দর তল্লাট থেকে।” একটু দূরে তাকিয়ে দেখি সবাই মাটির নিচে সমাহিত হচ্ছে… ঈশ্বর গম্ভীর কণ্ঠে বলছেন। “তোমাদের আর এই তল্লাটে থাকার যোগ্যতা নাই। রুগীর সঙ্গে থেকে থেকে তোমরাও রুগী হয়ে গেছে। কিন্তু তোমাদের কোন ক্ষমতা নেই। কেবল অক্ষমতা ছাড়া। ’ কবিদের মধ্যে মাত্র তিনজনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। আমাকে দেখিয়ে তাদের বললেন, “যাও এর সঙ্গে গিয়ে নতুন করে শব্দের চাষ করো। শব্দের ক্ষমতায় তোমাদের রুগী ভাল হয়ে ওঠবে।

০৪.
বাইরে এসেই দেখি। বর্তমানে আমাদের এই তল্লাটে রোগির চিকিৎসক হতে চাওয়া দু’জনকেই আমাদের রোগির ভাইরাস আক্রমন করেছে। সেই আক্রমণের প্রভাবে দিকবিদিক শূন্য হয়ে তারা ধেয়ে আসছেন আমাদের দিকে। কবিত্রয় জ্ঞান হারালেন। আমি অন্য জগত হয়ে এসে, আপনাদের কাছে এই কাহিনী বর্ণনা করলাম।

‘মায়া কায়া অথবা মৃত্যুছায়া’ থেকে, প্রকাশ- (২০১৭)

মন্তব্য করুন