একজন বিজ্ঞ পাঠকের কলমে আলোচিত বই ‘বিস্ময়বালক’

প্রকাশিত: ৪:১৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০১৯
মুহাম্মাদ আরিফ রব্বানী
আল্লাহ যদি কবুল করেন, তাহলে আমি একজন গ্রেট লিডার হতে চাই। এ জাতিকে লিড দিতে চাই। আমাদের চৌদ্দশত বছরের যে সোনালি ইতিহাসকে ইংরেজরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে; সেটাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। এখনকার সময়ের যে সিস্টেম আপনারা দেখছেন, সেটা ইংরেজদের রেখে যাওয়া সিস্টেম। এটাকে আমি পরিবর্তন করে ইসলামি হুকুমত কায়েম করতে চাই। খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাই। গণতন্ত্রকে উঠিয়ে দিয়ে পুরো জাতিকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী পাঠ করাতে চাই। তাদের শেখাতে চাই—দেখো, আমাদের ইতিহাস কী। আমরা কেন তা পাঠ করছি না। তা ছাড়া মুসলমানদের ইতিহাসে যেসকল বীর সিপাহসালার অতিক্রম করেছেন, তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।

যেমন, খালিদ বিন ওয়ালিদ, তারিক বিন জিয়াদ, ইউসুফ বিন তাশফিন, মুহাম্মাদ বিন কাশিম, সালাহুদ্দিন আইয়ুবি, সাইফুদ্দিন কুতুব, রুকনুদ্দিন বাইপার্স, সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ, সুলতান সুলাইমান, মুহাম্মাদ বিন তুঘলক, সুলতান মুহাম্মাদ গজনবী, তিতুমির, শরিয়তুল্লাহ, সুলতান টিপুসহ এসব লোকদের অধ্যয়ন করবে এবং তাদের থেকে ইন্সপায়ারড হবে।

‘তোমার প্রধান স্বপ্ন কি?’-এর জবাবে ’বিস্ময়বালক’ উপর্যুক্ত কথাগুলো বলে।
বলছিলাম পাকিস্তানসহ বিশ্বে ’দ্যা নান্না প্রফেসর’ এবং বাংলায় ’বিস্ময়বালক’ খ্যাত এগারো বছরের হামমাদ সাফির কথা। যে ইতোমধ্যে পুরো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছে। ক্লাস সেভেনে পড়া এই বালক নাকি ছয়-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রভাষক। শ’খানেক ভার্সিটিতেও নাকি এপর্যন্ত লেকচার দিয়ে এসেছে। কী আপনার চোখ বড় হয়ে গেল? হবারই তো কথা! এগারো বছরের কোন বাচ্চাকে যদি বলা হয় ‘তুমি বড় হয়ে কী করবে?’ ডাক্তার, পাইলট, সেনা-অফিসারজাতীয় উত্তর ছাড়া বেশি কিছু বলবে না। অথচ সেই একই বয়সী একজন হামমাদ সাফিকে যদি বলেন, ’তুমি বড় হয়ে কী করবে?’ সে বলবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বারোটা বাজিয়ে ইসলামি শাসন কায়েম করব। এমন উন্নত চিন্তা মুসলিম ঘরে জন্ম নেওয়া কজন সন্তান করতে পারে? আমিও তো আজপর্যন্ত এমন উচ্চতর কথা বলতে পারিনি।
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ এবং আল্লামা ইকবাল রহ.এর দর্শনকে সামনে রেখে আগামীর বিশ্বকে নতুন কিছু উপহার দিতে আবির্ভূত হয়েছে এই হামমাদ সাফি। একজন মুসলিম সন্তান হিসেবে তার পাশে আমাদেরই থাকতে হবে। পাকিস্তানে জন্ম নিয়েছে বলেই তাকে ‘হেলা’ করা যাবে না। মনে রাখতে সে শুধু পাকিস্তানের নয় সমগ্র বিশ্বের মুসলমানের সম্পদ। এই মূল্যবান সম্পদের সাথে বাঙালিদের পরিচয় করিয়ে দিতেই রচিত হয়েছে ‘বিস্ময়বালক’।
বই নিয়ে কিছু কথা:
১২৮ পৃষ্ঠার এই বইটি ১৫০/- টাকা দিয়ে ক্রয় করে আপনি ঠকবেন না আশাকরি। বইটি পড়ে আপনার মাঝে একটু পরিবর্তন আসবে। একটু স্প্রিট তৈরি হবে। কাজের গতি পূর্বের তুলনায় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। চিন্তারাজ্যে কিছুটা হলেও রেখাপাত ঘটাবে।
বইটিতে হামমাদ সাফির সাক্ষাতকার, লেখচার, বায়োগ্রাফি ও তার লাইফ স্টাইল কেমন তা উল্লেখ রয়েছে। রয়েছে হামমাদ সাফির প্রিয় ‘আইডল’ আল্লামা ইকবাল রহ.-এর সংক্ষিপ্ত জীবন, কর্ম, কবিতা, দর্শন ও আল্লামা ইকবালের সেরা আটটি উক্তি। আরও আছে জান্নাতি যুবকদের সরদার হযরত হাসান-হুসাইন রা.-কে দেওয়া স্বীয় পিতা হযরত আলি রা.-এর মৃত্যপূর্ব অমিয় বাণী। তারপরেও যেন বইটি একটু অপূর্ণ ছিল। সেই অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করেছেন তারুণ্যের প্রিয় লেখক, আমার প্রিয় লেখকদের অন্যতম ব্যক্তি, বিশিষ্ট গল্পকার ‘রশীদ জামীল’ হাফিজাহুল্লাহ। লেখক পরিচিতি লিখেছেন বেস্টসেলার বই ‘পেরাডক্সিক্যাল সাজিদ’-এর লেখক জননন্দিত ‘আরিফ আজাদ’ হাফিজাহুল্লাহ।
‘দ্যা সিক্রেট অব সাকসেস’ শিরোনামে ‘রশীদ জামীল’ সাহেব একটি প্রবন্ধ যুক্ত করে দিয়েছেন বইটিতে। তিনি ড. এপিজে আব্দুল কালামের সংজ্ঞায়িত স্বপ্ন [স্বপ্ন সেটা নয় যা আপনি ঘুমিয়ে দেখেন। স্বপ্ন হলো সেটা, যা আপনাকে ঘুমোতে দেয় না] দিয়ে লেখাটি শুরু করেছেন। এরপর তিনি ‘সফলতার’ বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সাথে সাথে বহুল প্রচলিত বাগধারা ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ নামক বাক্যটির অবাস্তবতা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন বইটিতে। Heard Work এবং Smart Work নামক দুটি কাজের মাধ্যমে চিন্তাজগতে নতুন একটি ভাবনার বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছেন তিনি।
রশীদ জামীল হামমাদ সাফির ব্যাপারে এককথায় বলেন, ‘জাস্ট অসাম’। হামমাদ সাফির ‘ট্যালেন্ট’ দেখে বলেন, ‘যদি সঠিক পরিচর্যা পায়, প্লাটফর্ম যদি সঠিক থাকে, তাহলে আগামীর বিশ্ব এমন কাউকে পেতে যাচ্ছে, যাকে নিয়ে পরের প্রজন্ম আন্দোলিত হতে পারবে।’ সাথে সাথে আশঙ্কা প্রকাশ করতে গিয়েও বলেন, ‘সঠিক পরিচর্যা পেলে আমরা একুশ শতকের একজন আল্লামা ইকবাল অথবা ইমাম গাজালিও পেয়ে যেতে পারি। আর পরিচর্যার অভাবে আরেকজন জাকির নায়েক। নির্ভর করে এনভায়ারনমেন্টের ওপর। সঠিক পরিচর্যার ওপর।’
হামমাদ সাফির জনপ্রিয় কিছু উক্তি:
১. হয় তুমি জিতবে, না-হয় শিখবে। জীবনে ‘হার’ বলতে কোন শব্দ নেই। ২. প্রত্যেকে যার যার ভেতরের সক্ষমতাকে কাজে লাগানো জানতে হবে। আ্যবিলিটির রেসপন্স দেওয়া শিখতে হবে। কিছু করতে পারার সক্ষমতা মানুষের সহজাত এবং স্বভাবজাত। অনেকেই সেটা বুঝতে পারে না বলে শুরুর আগে শেষ হয়ে যায়। এজন্য হার নামের জিনিসটাকে জীবন থেকে বাদ দিতে হবে। চ্যালেঞ্জ আসবে ফেইস করতে হবে। বুক চিতরে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে হবে। তার ভাষায় মানুষ দুই প্রকার : এক. ড্রিমার। দুই. রিস্ক টেকার। শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না; ঝুঁকিও নিতে হবে। ৩. বর্তমান পৃথিবীটা একটা গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে। পৃথিবীর এক প্রান্তে কোন ঘটনা ঘটলে মুহূর্তেই সেই সংবাদ অপর প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এটা সম্ভব হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণে। প্রযুক্তিকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। ৪. টেকনোলজির পজিটিভ ইউজ জানতে হবে। দুনিয়ার ইলমের খাজানা গুগুল এবং ইউটিউবে পড়ে আছে—আমাদের খবর নেই। আমরা মেতে থাকি ফানি ভিডিও নিয়ে। ৫. তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে ডাক্তার দিয়ে কী হবে। তুমি তোমার ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরকে যুক্ত করো। তাহলে তোমার সাবজেক্ট নিয়ে তোমার স্যারের সাথে মেসেঞ্জারে টুকটাক কথা বলতে পারতে। তুমি তোমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গ্রুপ বানাও। তাহলে সেখানে আ্যজুকেশনাল ডিসকাস করতে পারতে।
হামমাদ সাফির ভাষণের প্রভাবে বিলাল খান নামের একজন বলেন, কিছুদিন আগে আমি খুবই হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। আমার কোন চাকুরি ছিল না। একসময় আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একদিন হামমাদের ভিডিও দেখে চিন্তা করলাম—১১ বছরের একটি বালক যদি এই বয়সে কিছু করতে পারে তাহলে আমি কেন নই?
ফেব্রুয়ারির আটাশ তারিখ মাগরিবের নামাজের পরের কথা। একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা ও বিশিষ্ট ওয়ায়েজ মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ সাহেব কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন কফি খেতে। পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলে মুসাফার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। অমনি আমার হাতকে তার হাতের সাথে মিলিয়ে নিয়ে বললেন, আসেন কফি খেয়ে আসি? কখনো আমাকে দেখেনি, এর আগে কোনদিন কথাও হয়নি তার সাথে, অপরিচিত একজন লোককে এভাবে কফির দাওয়াত দিলে সাথে সাথেই কি রাজি হওয়া যায়? অন্যদিন খাবো—বলে এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু কফি খেতে যাচ্ছি না দেখে দু দুবার ডাকলেন। এখন আর না গিয়ে উপায় নেই। এত বড় মাপের একজন লোক তিনবার ডাক দেওয়ার পরেও যদি না যাই তাহলে নিজের প্রতিই ঘৃণা জন্মাবে আমার। গেলাম পিছনে পিছনে।
বইমেলার ভেতরেই ছিল হোটেল। ভীড়ের ঠ্যালায় বসার জায়গা পাচ্ছি না আমরা। দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই। এমনসময় হঠাৎ পেছন থেকে ‘আরিফ ভাই নাকি’ বলে ডেকে উঠল একজন।  তার দিকে রোখ করে হাত বাড়িয়ে দিলাম। মুসাফাপর্ব শেষ করার সাথে সাথেই বুকে জড়িয়ে নিল আমাকে। অনেকটাই পুলকিত হলাম তখন। এর আগেও ‘চা’ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সে। অত্যন্ত মিশুক মানুষ। হাসিটা যেন মুখে লেগেই থাকে তার। স্বাভাবিক ভাষাতেই কথা বলে থাকে। এর আগেও নাকি দুটি বই লেখেছে সে। দুএকটি বই লিখতে পারলেই অনেক কিছু হয়ে গেছি মনোভাব তার মাঝে পেলাম না। যা অনেক লেখকের মাঝেই পরিলক্ষিত হয়। কার কথা বলছি—ভেবে অবাক হচ্ছেন নাকি? অবাক হবার দরকার নেই। বলছিলাম ’বিস্ময়বালক’ বইটির লেখক ‘নাজমুল ইসলাম কাসিমী’ ভাইয়ের কথা। ভালো লাগার আরেকটি লোক সে। অন্তর থেকেই মুহাব্বাত করি তাকে। সে-ও মনে হয় কম করে না।
যাজ্ঞে, প্রিয় লেখকের দীর্ঘ সাধনার ফসল এই ‘বিস্ময়বালক’ বইটি। আগ্রহোদ্দীপনা বাড়ানোর জন্য বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। ক্রয়ের কথাটি বললাম না, কারণ ভাবতে পারেন আমি বইটির আ্যড দিচ্ছে; যাতে বইটির ‘বিক্রিহার’ বেড়ে যায়। আপনার পরিচিত কেউ কিনে থাকলে নিয়ে পড়বেন। আবারও বলছি পড়বেন। কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত হবেন, ইনশাআল্লাহ।
লেকক-
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন