কোনো এক দুপুরের ছায়া

প্রকাশিত: ৪:১২ অপরাহ্ণ, মার্চ ২, ২০১৯

-মিদহাদ আহমদ

আলিফ সাহেব বর্তমানে একজন সুখী মানুষ। বীমা কোম্পানীতে ভালো চাকরী করতেন। সাত বছর হলো রিটায়ার করেছেন। রিটায়ারের সময় গ্র‍্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড সব মিলিয়ে হাতে একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা ব্যাংকে জমা আছে। ইন্টারেস্ট যা পান তাতেই মোটামুটি চলে যায়। স্বাস্থ্য ভালো, রোগ ব্যাধি নেই। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার,হার্টের সমস্যা এই জাতীয় বৃদ্ধ বয়সের রোগের কিছুই তাকে ধরেনি। দুটি মেয়েই ভালো বিয়ে দিয়েছেন। একজন বরের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া আর আরেকজন দুবাই। আলিফ সাহেব একা থাকেন এই একটিই তার সমস্যা। স্ত্রী গত হয়েছেন অনেকদিন আগেই। তবে একা একা থাকেন বলে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার খারাপ লাগে না বরং ভালোই লাগে।দিনের বেলাটা তিনি ঘুরে ঘুরে কাটান।দুপুরে বাইরে কোথাও খেয়ে নেন। ভিড়ভাট্রা তার একেবারে সহ্য হয় না। রাতে কিছু খান না। কোনোদিন একটা কলা,কোনোদিন একটা আপেল খেয়ে শুয়ে পড়েন। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেন।

আশ্বিন মাসের এক দুপুর।বেলা প্রায় দু’টা। আলিফ সাহেব হাটাহাটি করে একটা হোটেলে ভাত খেতে বসেছেন। হোটেলের নাম “ভোজন”। পাশেই আরেকটা হোটেল –“হোটেল জাহান”। সেখানে রমরমা ভিড়।ভোজন রেস্টুরেন্ট একেবারে ফাকা। মনে হয় এই হোটেলের খাবার দাবার সুবিধার না। আলিফ সাহেবের কাছে খাবারটা প্রধান না নিরিবিলি প্রধান। কাজেই তিনি ঢুকেছেন ভোজন রেস্টুরেন্টে। কোণার দিকের অন্ধকারের একটা টেবিলে বসেছেন। ইলিশ মাছ,সবজি এবং ডালের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। সাধারনত তিনি মাছ খান না।আজ কেনো জানি মাছ খেতে ইচ্ছা করলো। তখন হোটেলে আরেকজন কাস্টমার ঢুকলো। এত ফাঁকা জায়গা থাকতেও আলিফ সাহেবের কাছে এসে বললো,আপনার টেবিলে বসতে পারি?
আলিফ সাহেব না বলতে গিয়েও বললেন না। হোটেলটা তার না। কাস্টমার এসেছে,পয়সা দিয়ে খাবে। তার যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসবে। আলিফ সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কারো সামনে বসে খেয়ে তিনি পছন্দ করেন না।

“আশা করি আপনার বিরক্তি উৎপাদন করছি না।”
“জ্বি না।
“একটা দেয়াশালাই দিতে পারবেন?”
আলিফ সাহেব দেয়াশালাই বের করে বাড়িয়ে দিলেন। তার মন আরোও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এই লোকটা প্রচুর কথা বলবে। বক বক করে মাথা ধরিয়ে দিবে। এখনও সময় আছে তিনি ইচ্ছে করলে অন্য টেবলে চলে যেতে পারেন। কাজটা অভদ্রতা হয়।
“আশা করি সিগারেটের ধোয়ায় আপনার অসুবিধা হচ্ছে না।”
“না,হচ্ছে না।”
“আন্তরিক ধন্যবাদ।”

লোকটার অন্য কোনো মতলব নেই তো। ধান্দাবাজ নয়তো লোকটা? বাংলাদেশে ধান্দাবাজ লোকের অভাব নেই। কয়েকদিন আগেই এরকম ধান্দাবাজ লোক একটার সাথে দেখা হয়েছিলো। শার্ট প্যান্ট ইন করে পড়া দেখতে একেবারে ভদ্রলোক। চোখে কালো রিমলেস চশমা।মুখ ভর্তি হাসি। আলিফ সাহেব একটা হোটেলে খেতে বসেছেন, লোকটা তার সামনে এসে খুব বিনীত ভাবে বললো, স্যার,কিছু মনে করবেন না। রাস্তায় আসার সময় আমার মানিব্যাগটা চুরি হয়ে গেছে। এখন খিদের জ্বালায় মরছি। চারটি ভাত খাওয়ান। এরকম চেহারার লোকের মুখের উপর না বলা যায়না। লোকটা ভাত খেলো।তারপর চা আর দই খেলো। সবশেষে মিষ্টি পান আর একটা বেনসন সিগারেট। আলিফ সাহেবকে কিছু বলতে হচ্ছে না। সে নিজেই অর্ডার করছে একের পর এক। কোনো দ্বিধা নেই,সংকোচ নেই। কি সুন্দর করে বলছে-
“স্যার,আপনার অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট দিতে বলি। এমন চমৎকার লাঞ্চের পর সিগারেট না খেলে লাঞ্চের অপমান হয়-
“এই বেয়ারা, একটা বেনসন নিয়ে এসো। দেখে শুনে আনবে, ড্যাম্প যেনো না হয়।ড্যাম্প হলে থাবড়া খাবি।”
এই লোকটাও সেরকম কেউ না তো? আলিফ সাহেব আড় চোখে থাকালেন। সে রকমই তো মনে হচ্ছে। অন্ধকার কোনায় এসে বসেছে। চোখে সানগ্লাস। চোখ থেকে সানগ্লাস খোলেনি। একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিলেন-যারা সহজে সানগ্লাস খুলতে চায় না তাদের ভেতরে সমস্যা থাকে। লোকটা পোশাকে- আশাকে ভালো। খয়েরী রঙের হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট। শাদা প্যান্ট। শাদা প্যান্টের সাথে কালো রঙের চামড়ার জুতা। বিদেশী জুতা নিশ্চয়ই। সিগারেট যে খাচ্ছে সেটাও দামি। সুন্দর গন্ধ আসছে। সস্তা সিগারেটের দম আটকানো গন্ধ না। সিগারেট বের করেছে সিগারেট কেস থেকে। আজকাল অবশ্য কেউ সিগারেট কেস ব্যাবহার করে না। লোকটা সিগারেট কেস আলিফ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিলো।  ৫৮৮নিচু গলায় বললো,
“আপনি সিগারেট খাবেন?”
আলিফ সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন,জ্বি না, আমি ভাত খাবো। ভাতের অর্ডার দিয়েছি।
ভাত চলে এসেছে।সরু চালের সুন্দর ভাত। হোটেলের খাবারে এই একটাই সুবিধা।হোটেলের তরকারী যেমনই রাধুক ভাত ভালোই রাধে। বাড়ির ভাত কখনো এরকম হয় না।কখনো শক্ত কখনোবা নরম,কোনোদিন চাল থাকে আবার কোনোদিন কাদার মতো। এজন্যেই বাড়িতে খাবারের পাট চুকিয়ে দিয়েছেন তিনি।
“স্যার আপনি কি আমার উপস্থিতিতে বিরক্ত বোধ করছেন?”
আলিফ সাহেব হ্যা না কিছুই বললেন না। সবজি দিয়ে ভাত খেতে লাগলেন। সবজির চেহারা দেখতে ভালো। খেয়ে কেমন হবে জানেন না।
“ফুল বাগান কেমন দেখলেন স্যার?”
আলিফ সাহেব চমকে উঠলেন, ঐ লোকটি বাগান থেকেই পেছন লেগেছে? সর্বনাশের কথা! মতলবটা কি?
“আপনি যখন বাগান দেখছিলেন আমিও তখন বাগান দেখছিলাম। আমি অবশ্য এর আগেও অনেকবার দেখেছি। বাংলাদেশে দেখার কিছু নেই। একই জিনিস বার বার দেখতে ভালোলাগে না।বোটানী গার্ডেনে আপনি কি এই প্রথমবার গেলেন?”
‘জ্বি।’
তারপর আলিফ সাহেব আবার খেতে লাগলেন। সবজিটা ভালো রেধেছে। তারপরও কাস্টমার কেনো পাচ্ছে না? একদিন হোটেল জাহানে খেয়ে দেখতে হবে।কে জানে হয়তো ওদের রান্না আরও ভালো। পাশে বসা লোকটা হঠাৎ বলে উঠলো,
“প্রায় তিনশো বছরের পুরানো একটা গীর্জা আছে। “আর্মেনিয়ান গীর্জা”
“গীর্জা ফির্জা আমি দেখি না।”
“স্যার মনে হচ্ছে আমার প্রতিটি কথায় আপনি বিরক্ত হচ্ছেন আমার পরিচয় পেলে আপনি আর বিরক্ত হবেন না। আমি একজন ভ্যাম্পায়ার।
খাওয়া বন্ধ করে আলিফ সাহেব মুখ তুলে বললেন,আপনি কি?
“ভ্যাম্পায়ার? ভ্যাম্পায়ার চিনেন না? ঐ যে কাউন্ট ড্রাকুলা। ট্রানসেলভেনিয়ার বিখ্যাত কাউন্টের গল্প পড়েননি?
আলিফ সাহেব আবার খেতে শুরু করলেন, এবং মনে মনে বললেন, ব্যাটা বদমাইশ ভ্যাম্পায়ার সেজেছে!
“আপনার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। না করারইই কথা। ভ্যাম্পায়ার কি সেই সম্পর্কে আমাদের ধারনা না থাকারই কথা।গল্পের বই, সিনেমা থেকে আহরিত জ্ঞানের সবই ভুল।
“তাই বুঝি?”
“জ্বি তাই।”
চলবে…
 

মন্তব্য করুন