ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে পাওয়া গেল কেমিকেলের গুদাম

প্রকাশিত: ৩:৫৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯

পাবলিক ভয়েস: রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে এখনো প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যালের রয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন যদি কোনোভাবে এই মজুদকৃত কেমিক্যালের সংস্পর্শে যেত, তবে সেটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতো।

আজ শুক্রবার দুপুরের দিকে ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে এই মজুদকৃত কেমিক্যালের সন্ধান পায় ফায়ার সার্ভিস। প্রাথমিকভাবে তারা ধারণা করছেন, মজুদকৃত কেমিক্যালগুলো বিস্ফোরণযোগ্য হতে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক শরিফ বলেন, ‘ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে যে পরিমাণ কেমিক্যাল মজুদ রয়েছে সেগুলো এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে। সেগুলো কতটুকু বিস্ফোরণযোগ্য সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, মজুদকৃত কেমিক্যালগুলো যদি বিস্ফোরণযোগ্য হতো, আর সেগুলো যদি আগুনের সংস্পর্শে আসতো তাহলে অগ্নিকাণ্ড আরও ভয়াবহ হতো।

হাজী ওয়াহিদ ম্যানশন ভবনের মালিক শাহীন বলেন, ‘বেজমেন্টে গোডাউনগুলোতে যে কেমিক্যাল বা অন্য বিস্ফোরক রাখা হতো আমরা জানতাম না। জানলে আমরা ভাড়া দিতাম না’।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ওয়াহেদ ম্যানসন পরিদর্শন শেষে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন জানিয়েছিলেন, এই ভবনে কেমিক্যালের কোনো গোডাউন ছিল না।

মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ডিএসসিসির তদন্ত দলের প্রধান বলেন, ‘ওয়াহেদ ম্যানসনে অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। এখানকার যে পাউডার, সেগুলো কেমিক্যাল। এখানে যেসব প্লাস্টিকের বোতল পাওয়া গেছে, সেগুলোও কেমিক্যাল মাখানো। আমি এ নিয়ে মন্তব্য করবো না, তিনি এমন বক্তব্য কোন পরিপ্রেক্ষিতে দিয়েছেন তা জানা নেই। ক্যামিকেলের জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে বেশি।’

কমিটির প্রধান ও ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এবার যেকোনো মূল্যে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে। আগুনে পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ভবন প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে মনে হয়েছে।’

‘আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের অনুমতি নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনার পর নতুন করে আর কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেয়র (সাঈদ খোকন) বলেছেন, যেকোনো মূল্যে সবাই মিলে এসব এলাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে।’

‘এতোদিন সরানো হয়নি কেন’ জানতে চাইলে এ প্রকৌশলী বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবার যেকোনো মূল্যে সেসব (কেমিক্যাল গোডাউন) সরিয়ে নেওয়া হবে।’

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো ব্যবহারের উপযোগী কিনা তা এক সপ্তাহ পর জানা যাবে বলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী (পুর কৌশল বিভাগ)।

তিনি বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও দ্বিতীয় তলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিম ও কলামগুলো বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিম ও কলাম তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। তবে কতোটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে, ভবনটি ব্যবহারের উপযোগী কিনা।’

অন্যদিকে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউকের) অনুমোদিত কিনা, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি কমিটির আরেক সদস্য রাজউকের অথরাইজড অফিসার মো. নুরুজ্জামান জহির।

ভবনের সঙ্গে ভবন লাগোয়া থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আপনাকে (সাংবাদিক) বুঝতে হবে এটা পুরান ঢাকা। এখানে অনেক আগে থেকেই ভবন তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজউক অনেকদিন ধরে কাজ করছে। তবে সবার আগে দরকার সচেতনতা। এভাবে ভবন নির্মাণের নিয়ম নেই বলেও জানান তিনি।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা কমিটির সদস্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়া আরও অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমের মতো কাজ করেছে।’

এর আগে, সকাল সোয়া ৯টার দিকে ডিএসসিসি গঠিত ১১ সদস্যের তদন্ত দল চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটনাস্থলে যায়। ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিমকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- প্রফেসর ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী (পুর কৌশল বিভাগ-বুয়েট), প্রফেসর ড. ইশতিয়াক আহমেদ (পুর কৌশল বিভাগ-বুয়েট), লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান (পরিচালক-ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স), মো. আসাদুজ্জামান (অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী-ডিএসসিসি), মো. জাফর আহম্মেদ (অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী-ডিএসসিসি), মো. সিরাজুল ইসলাম (প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ-ডিএসসিসি), মো. নুরুল ইসলাম (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-রাজউক), মো. শাহ আলম (পরিচালক-রাজউক) ও সদস্য সচিব মুন্সী মো. আবুল হাসেম (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী-ডিএসসিসি)।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির সদস্যদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটনসহ দুর্ঘটনার সার্বিক বিষয় সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করবে এ কমিটি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী এ কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহম্মেদ খান, ঢাকা জেলার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ জোনের উপপুলিশ কমিশনার।

কমিটিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের উৎস, কারণ ইত্যাদি সার্বিক বিষয় সরেজমিন তদন্তপূর্বক সাত দিনের মধ্যে মতামত ও সুপারিশ প্রদান করার জন্য বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর চকবাজার এলাকার নন্দকুমার দত্ত সড়কের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পেছনের একটি ভবনে গত বুধবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে আগুন লাগে। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আগুনের ভয়াবহতা কিছুটা কমলেও আবারও বেড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট একযোগে কাজ করে গত বুধবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। উদ্ধার অভিযান চলে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় অন্তত ৬৭ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৪১ জন।

মন্তব্য করুন