একুশে বইমেলা, ইতিহাস ও ইসলামী প্রকাশনী

প্রকাশিত: ৬:১১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৬, ২০১৯

পানকৌড়ি রিটার্ন-

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের পর নড়েচড়ে বসা ভাষা প্রেমিকদের অনন্য উপহার বলা চলে একুশে গ্রন্থমেলা। আমাদের বাঙালীর গর্ব করার আর কিছু থাক বা না থাক একুশে গ্রন্থমেলা স্মরণীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।

ব্যাপকভাবে পরিচিত এই একুশে বইমেলা। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলা গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রতিবছর পুরো ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে এই মেলা হয়ে থাকে।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখ মুহাম্মদ সালাম, মুহাম্মদ রফিক, মুহা. আবুল বরকত ও মুহা. আ. জব্বারের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের ঘটনাকে স্মৃতিচারণ করতেই এই মাসে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে । ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা আবৃত্তি করি ;
আমরা বাঙালী মুসলমান
কে আছে হও আগুয়ান-
ভাষার তরে সালাম বরকতের মত
জীবন দিবে কুরবান।’

চলুন এক নজরে ঘেটে দেখি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলার’ ইতিহাস-

-১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চাটাইয়ের উপর কলকাতা থেকে নিয়ে আসা ৩২টি বই সাজিয়ে বিক্রি শুরু করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। তিনিই আমাদের প্রাণের এই বইমেলার প্রারম্ভক। তার নিয়ে আসা ৩২টি বই ছিল তার নিজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী সাহিত্যিকদের লেখা বই।

-১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি বই মেলা উপলক্ষে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।

-১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রফেসর আবু মহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তখন একাডেমি প্রাঙ্গণ সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাই ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমি প্রাঙ্গনে নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় যে যার স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। এতে করে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। তাই পরবর্তী বছর অর্থাত;

-১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চুনের দাগ দিয়ে প্রকাশকদের জন্য কিছুটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলা একাডেমি। সেই নির্দিষ্ট স্থানে প্রকাশকেরা যে যার মতো স্টল তৈরি করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে।

-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এই আয়োজনের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি বাংলা একাডেমি। এমনকি কোনো নামও দেয়নি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি এই সময়ে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানসূচিতেও এর কোন উল্লেখ নেই।

-১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি বইমেলার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন। তার স্ব-উদ্যোগে বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। শুরু হয় বইমেলার গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের।

-১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিগাঁথা অমর একুশে ফেব্রুয়ারির দিকে লক্ষ রেখে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি এবং বইমেলার নামকরণ করে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’

-১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই নিয়মেই ‘একুশে গ্রন্থমেলা’ পালিত হয়। আবার ১৯৮১ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলায় পরিবর্তন আনে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ কমিয়ে ২১ দিনের পরিবর্তে ১৪ দিন ধার্য করে বাংলা একাডেমি। কিন্তু প্রকাশকরা বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাদের দাবি তুলে ধরেন। প্রকাশকদের এ দাবির মুখে ১৯৮২ সালে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়ে মেলার মেয়াদ করা হয় ২১ দিন এবং মেলার উদ্যোক্তা হিসেবে বাংলা একাডেমি সে মেলার আয়োজন করে। ১৯৮২ সালের ঐ মেলায় সহযোগী হিসেবে ছিল জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি।

-১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কাজী মনজুরে মওলা। তিনি বিশেষ কারণে সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাংলা একাডেমি থেকে বাদ দিয়ে দেন। কি কারণে বাদ দিয়ে দেন সে তথ্য বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেনি। বরং বাংলা একাডেমি সে সময় প্রচার করে ‘একুশে বইমেলা’কে নতুন আঙ্গিকে প্রসার করার কারণেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ধুমধাম করে বাংলা একাডেমি ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন শেষ করে কিন্তু স্বৈরশাসক এরশাদ-এর সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আবার ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র পুনঃ আয়োজন করে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে শহিদদের উপর আরও গভীর শ্রদ্ধা দেখাতে ‘একুশে গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামকরণ ১৯৮৩ সালে করলেও ১৯৮৪ সালে তার কার্যকারিতা সফল করে বাংলা একাডেমি। সেই সাথে প্রকাশকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে স্টলের সংখ্যা বাড়ানো হয়, এবং মেলার পরিসরও বাড়তে থাকে। পাঠকের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে চোখে পড়ার মতো হতে থাকে। এক সময় পাঠক এবং প্রকাশকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালেই বইমেলার সময়কাল বাড়িয়ে পুরো মাসব্যাপী করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি। তার জন্য তারা এমনভাবে উদ্বেলিত হয়ে হয়ে উঠেছিল, যা আর কখনো ঘটেনি। এরপর ২০১৪ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় স্টলের সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরিত করে।

এই মোটামুটি অমর একুশে বইমেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

এবার আসি ইসলামী প্রকাশনার অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত করেছে বাংলা একাডেমী।

একটি ইসলামী ঘরানার নিউজ পোর্টাল গত ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের ২ তারিখ একটা নিউজ করে বইমেলা ও ইসলামী প্রকাশকদের দুঃখ গাঁথা শিরোনামে। সেখানে মোহাম্মদী লাইব্রেরী সহ বেশ কয়েকজন প্রকাশক লেখক এর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে তারা সকলেই বেশ আক্ষেপের সাথে বলেছেন বইমেলায় ইসলামী প্রকাশনীর স্থান না পাওয়ার বিষয়টি। তাদের বক্তব্যের ভাষায় যেন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে ‘আমরা একদা একুশে বইমেলায় স্টল দিতাম’।

আমি একান্তভাবেই মাকতাবাতুল আশরাফ ও মাকতাবাতুল আযহার এর স্বত্ত্বাধিকারীদের সাথে খোশ গল্পে বা চা আড্ডায় কথায় কথায় জানতে পারি উনারা একুশে বইমেলার তত্ত্বাবধায়ক বাংলা একাডেমীর বরাবরে সব ধরণের নিয়ম মেনেই আবেদন করেন স্টল বরাদ্দের জন্য, কিন্তু তাদের সৃজনশীল দুইশ এর উপর বই থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে নট এলাউ করা হয় কোন ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই। এছাড়াও আমি যোগাযোগ করি নব প্রকাশ, এমদাদিয়া লাইব্রেরী, নাদিয়াতুল কুরআন প্রকাশনী, মাকতাবাতুত তাকওয়া ও আরো নাম না জানা উদিয়মান সৃজনশীল ইসলামী প্রকাশনীর প্রকাশকদের সাথে। তাদের দুঃখ গাঁথা স্মৃতিচারণ আর দীর্ঘ সময়ের এ পাড়া ওপাড়া দৌড়-ঝাপের ফিরিস্তি শুনে বেশ অবাক নয় ওরা হতবাকই হলাম। জনপ্রিয় ইসলামি গ্রন্থ অনুবাদক আব্দুল্লাহ আল ফারুক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনিও দূঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানালেন ইসলামী প্রকাশনা গুলোকে কোন কারণ ছাড়াই না কি আবেদন খারিজ করে দেন বাংলা একাডেমি।

অথচ বাঙালীর সাথে মিশে গেছে যেখানে ইসলাম সেখানে পাঠক ও ইসলামী বইয়ের মধ্যে সামন্তরাল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কি প্রমান করা হয় আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা।
ইদানিং কেউ কেউ বলছেন বাংলা একাডেমির সেক্যুলার দায়িত্বশীলদের প্রভাব না কি এগুলো।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ বলে বলছি না আমরা যদি মেনে নেই এদেশে ইসলামী সাহিত্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে তাহলে সাহিত্য চর্চা ও প্রচারের একটি বিশাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাংলা একাডেমীর উচিত হলো ইসলামী প্রকাশনী গুলোকে মেলা প্রাঙ্গনে স্টল বরাদ্দ দিয়ে নিজেদের উদার চিত্তের প্রকাশ ঘটানো।

নিজেদের পরিধির ব্যাপ্তি কে না চায়!
সাহিত্যের মানদন্ড বিচারে মুসলিম অমুসলিম বিচার না করে যদি বাঙলা সাহিত্যের বিকাশ ও সম্প্রসারণ বাংলা একাডেমির উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলেও অন্তত উপরে উল্লেখিত প্রকাশনী সহ মানসম্মত ইসলামী প্রকাশনী গুলোকে তাদের প্রকাশিত গ্রন্থাদি ও বাঙলা সাহিত্যের প্রতি অপার সৌন্দর্যের বিচ্ছুরন ফলানো বিবেচনা করে স্টল বরাদ্দ দেয়া উচিত।

কারণ এই কবিতা আমরা বাংলা একাডেমির জন্য গাহিতে চাই না;

লিখনীর নাহি আসুক ছন্দ
বেড়ে উঠাতে যদি নাহি আসে দ্বন্ধ,
বাংলা ভাষায় জন্ম আমার
কে আছে ধরণীতে এমন
বুকে সাহস করে ধারণ
ঠুটি চেপে করে দেবে যবান বন্ধ।

মন্তব্য করুন