

চাঁদপুরের কচুয়ার সাতবাড়িয়ায় মাদরাসার এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে একই মাদরাসার হিফজ বিভাগের ১৩ বছরের শিশুছাত্রকে বলাৎকারের মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনায় পরবর্তিতে জানা গেলো ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
ঘটনার পর মাদরাসার সি সি টিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে অভিযুক্ত উক্ত শিক্ষক সম্পূর্ণ নির্দোষ। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সাথে শত্রুতার জের ধরে মাদরাসা বন্ধের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ওই শিক্ষককে ফাঁসানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেই শিক্ষক নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। দু’একদিনের মধ্যেই গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক মুক্তি পাবেন বলে জানা গেছে।
মাদ্রাসার সেই শিক্ষকের নাম হাফেজ ওমর ফারুক। তিনি দির্ঘদিন ধরে ওই মাদরাসার শিক্ষক। নির্যাতনের ঘটনায় সেই শিক্ষক নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন অভিযোগ তোলা শিক্ষার্থীর বাবা।
ভুক্তভোগী শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলার পেছনে সেই শিক্ষার্থীর চাচার ষড়যন্ত্র ছিল বলে জানিয়েছেন তার বাবা।
গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন সাতবাড়িয়া তালিমুল কুরআন মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা হোসাইন আহমাদ।
মাওলানা হোসাইন আহমাদ বলেন, সেই ছেলের বাবা জানিয়েছেন – পড়াশোনায় অমনযোগীতা ও চাপবোধের কারণে ভুক্তভোগী শিক্ষকের বিরুদ্ধে চাচার প্ররোচনায় এই অভিযোগ তোলে ছেলেটি। শিক্ষকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলার পেছনে সেই শিক্ষার্থীকে তার ষড়যন্ত্রকারী চাচা-ই প্ররোচনা দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীর বাবা রিপন আলী।
ক্ষমা চাওয়ার সময় ছেলেটির বাবা অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য কেঁদে ফেলেন। শুরুতে তিনি নির্যাতনের শিকার শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি ছিলেন না বলে জানান। পরবর্তী ভাইয়ের প্ররোচণায় মামলা করেন।
গতকাল (১ জানুয়ারী) সন্ধ্যায় কচুয়া জামিয়া আহমদিয়ার মুহতামিম মাওলানা আবু হানিফার নেতৃত্বে মাদরাসার এক মিটিং-এ সাংবাদিক, আইনজীবীদের সামনে সিসি টিভি ফুটেজ দেখানো হয়। যেখানে ষড়যন্ত্রের শিকার সেই শিক্ষক নিদোর্ষ প্রমাণিত হন। এই মিটিং-এ এসব জানান সেই শিক্ষার্থীর বাবা।
স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে মাদরাসার সিসিটিভি ফুটেজ দেখাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ।
সূত্রমতে জানা যায়, সেই শিক্ষার্থীর চাচা আমিনুল ইসলাম শিপন এলাকায় কিছুটা প্রভাবশালী ও ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। এলাকায় কওমী মাদরাসাকে তিনি পছন্দ করেন না।
জানা যায় অভিযোগকারী ওই ছেলে হেফজ খানায় রেহাল নিক্ষেপ করে দুষ্টুমি করার কারণে উস্তাদ এসে তাকে ধমক দিলে চাচার প্ররোচণা ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে উস্তাদের বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগ তোলে ছেলেটি।
সূত্র জানায়, উস্তাদের নামে অভিযোগ তোলা শিক্ষার্থীটি অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় পড়াশোনায় অমনোযোগী ও দুষ্ট। কিছুদিন আগে দুষ্টামির কারণে উস্তাদ তাকে শাসন করলে বাড়িতে গিয়ে সে অভিযোগ করলে তার চাচা আমিনুল ইসলাম শিপন এলাকার কয়েকজন গুণ্ডাকে নিয়ে মাদরাসায় হুজুরকে মারধরের জন্য আসেন। তখন মুহতামিম সাহেব সবাইকে বসিয়ে বিষয়টির মিমাংসা করেন। তারা সুযোগ না পেয়ে চলে যায়।
ইতিপূর্বে আলেম বিদ্বেষ থাকলেও তা প্রকাশের কোন সুযোগ না পাওয়ায় সেই ছেলের অভিযোগকে ভিত্তি করে ছেলেটির চাচা এলাকাবাসীকে উস্কে দেয়। মাদরাসায় আক্রমণ করে সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে এবং সেই উস্তাদের উপর নির্যাতন করে।
এর আগে গতকাল প্রথম সারির কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, চাঁদপুরের কচুয়ার সাতবাড়িয়ায় তা’লীমুল কোরআন মাদরাসায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে হিফজ বিভাগের ১৩ বছরের শিশুছাত্রকে বলাৎকারের আভিযোগে মাদরাসাশিক্ষকের মাথা ন্যাড়া করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। পুলিশ আভিযুক্ত শিক্ষক ওমর ফারুককে (২২) গ্রেপ্তার করেছে।
দাবি করা হয়, গত ২৮ ডিসেম্বর বাথরুমে মাদরাসার হিফজ বিভাগের ১৩ বছরের শিশুছাত্রকে সে বলাৎকার করে। পরে জানাজানি হলে স্থানীয় জনতা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাদরাসা ঘেরাও করে ওই শিক্ষককে আটক করে মাথা ন্যাড়া করে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে কচুয়া থানার এসআই মকবুল হোসেন ফোর্স নিয়ে ওই দিন রাতেই তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে এবং বুধবার অভিযুক্ত ওমর ফারুককে জেলহাজতে প্রেরণ করে।’
কিন্তু মাদরাসার কর্তৃপক্ষের একজন সাজ্জাদ শাফায়াত জানিয়েছেন, ‘তাকে পুলিশ আটক করার পর কচুয়ার বড় বড় আলেমদের নিয়ে মিটিং হয়। মিটিংয়ের পর মাদরাসার সি সি টিভি ফুটেজ দেখা হয়। এতে দেখা যায়, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, শিক্ষক সম্পূর্ণ নির্দোষ। তার নির্দোষ প্রমাণ পাওয়ার পর গ্রামের লোকজন মিটিং করে সমাধান করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু এটা এতো সহজে সমাধান করা যাবে না। তাই এটার সাথে যারা যারা জড়িত ছিলো তাদের নামে আমাদের অত্র মাদরাসার পরিচালক মাওলানা হোসাইন সাহেব মামলা দেয়, আমার বাবাও মামলা দিবে । বর্তমান হুজুর জেলে আছে তাকে কাল বা পরশু ছেড়ে দিবে, তিনি বের হওয়ার পর আরেকটি মামলা দিবো ইনশাআল্লাহ।’
এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পেক্ষাপট তুলে ধরে শাফায়াত বলেন, ‘চাঁদপুর, কচুয়া, রহিমানগর বাজারে সাতবাড়িয়া বড় বাড়ি নামে আমাদের বাড়িটি পরিচিত। দাদু, চাচারা সবাই আমরা ঢাকায় বসবাস করি। তাই আমাদের বাড়িটি আমরা মাদরাসা করে ফেলি। এই ভেবে যে খালি বাড়ি পড়ে থাকার থেকে দুই চার টা ছেলে সেখানে কুরআন পড়বে আর সেখান থেকে কিছু সওয়াব পাবো তা ভেবে মাদরাসাটি করা। আমাদের এই মাদরাসাটির শুরু থেকে বেশ শত্রু লেগে আছে কিন্তু তারপরও আমাদের মাদরাসা টা বেশ ভালো চলতে লাগলো আলহামদুলিল্লাহ। মাদরাসার বেশ সুনামও ছড়িয়ে যায় গ্রামে, মাদরাসাটি মাওলানা হোসাইন সাহেব পরিচালনা করেন, তিনি সম্পর্কে আমার আংকেল হন।’ পরবর্তিতে যারা মাদরাসার পেছনে শত্রু হিসেবে যারা লেগে ছিলো তারাই মিথ্যা অভিযোগ তুলে শিক্ষক নির্যাতনের এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
এছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকদের তৈরি করা একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে পাবলিক ভয়েসের কাছে। সেখানে দেখা যায় ঘটনার দিন ভিডিও ফুটেজ চেক করার জন্য বারবার বলা হলেও দেবজিৎ নামক লোকাল এক রাজনৈতিক কর্মী মাদ্রাসায় ঢুকে হুজুরকে পেটাতে থাকে।
এছাড়াও স্থানীয় সুন্নি ধারার কিছু মানুষ ওহাবীদের মাদ্রাসা বন্ধের জন্য শ্লোগানও দেন। এবং সবাই মিলে এক পর্যায়ে নির্যাতন করে ওই শিক্ষককে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এখন চাঁদপুর জেলে আছেন ওই মজলুম হাফেজ ওমর ফারুক।
নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষকের ঘটনা জেনে তার মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন।
বিষয়টি নিয়ে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মাওলানা রুহুল আমিন সাদী (সাইমুম সাদী) তার ফেসবুক আইডিতে একাধিক অনুসন্ধানী পোস্ট করেছেন।
তিনি বলেন – যেখানে স্থানীয় সাংবাদিকরা সঠিক ঘটনা তদন্ত করে রিপোর্ট দিচ্ছেন সেখানে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যাচাই বাছাই না করেই নিউজ প্রচার করছে এই হাফেজ শিক্ষককের বিরুদ্ধে। ইসলামের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে আমাদের মেইনস্ট্রীম সাংবাদিকেরা একেকজন ইসলাম বিরোধী যোদ্ধা!
সাইমুম সাদী আরও লেখেন – একজন আলেমের প্রতি নির্যাতনের এমন ভিডিও দেখে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি। মিথ্যা বলাৎকারের অভিযোগে তাকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা ভয়াবহ।
চাদপুরের কচুয়ায় ওই আলেমকে কিছু কুলাংগার পিটিয়ে মাথার চুল কামিয়ে বারবার ক্যামেরার সামনে মুখটি তুলে ধরছে। লজ্জায় অপমানে তিনি মাটিতে মুখ লুকানোর চেষ্টা করছেন বিভিন্ন মাতব্বরদের পায়ে ধরছেন কিন্তু পাষণ্ডদের মন গলেনি। একজন আলেমের আহাজারিতে একটুও দয়া হয়নি। যে যেভাবে ইচ্ছা কিল ঘুষি মারছে এবং তিনি অসহায়ভাবে চেয়ে আছেন।
অথচ পরবর্তীতে মাদ্রাসার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দেখা গেলো এই মাওলানা সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাকে অন্যায়ভাবে মারধোর করা হয়েছে। অথচ তাকে নির্যাতন করে, চুল কামিয়ে, মিডিয়া ট্রায়াল করে পুলিশে দিয়ে এখন তিনি জেল খাটছেন। হলুদ সাংবাদিকতার নিয়মানুযায়ী কিছু মিডিয়া তাকে নিয়ে বাজে রিপোর্ট করেছে। কিন্তু কেউই মূল ঘটনা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি।
আমরা কচুয়ার ওই ঘটনার বিচার দাবি করছি। একজন অসহায় আলেমের পাশে, একজন নির্যাতিত নায়েবে নবীর ইজ্জত রক্ষার জন্য তার পাশে দাড়ানোর জন্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ।
কোনরূপ ধামাচাপা, আপোষ নয়, যারা এই আলেমের গায়ে হাত তুলেছে, মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে তাদের বিচার দাবি করছি। দেখা যাক পরিস্থিতি কতদুর যায়।
কওমী মাদরসাসমূহকে কোনঠাসা করার একটি প্রক্রিয়া চলছে দাবি করে মাওলানা রুহুল আমীন সাদী আরও লেখেন – কওমি মাদ্রাসার লোকজনকে জামাত শিবির রাজাকার বলে খুব লাভ নেই। এখন এদেরকে ধ্বংস করার পথ একটাই যা অনেক গবেষণা করে বের করা হয়েছে, আর তা হলো বলাৎকারের অভিযোগ তোলা। এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়েছে এবং কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারে শুধু মিডিয়া নয় অনেক রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গকেও জড়িত করা হয়েছে।
জাফরুল্লাহ খান নামক এক ব্যাক্তি কওমিতে বলাৎকার বন্ধ করার কথা বলেছিলেন কদিন আগেই। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক একটি ভুইফোড় সংগঠন জুমার নামাজের পর ঢাবির মসজিদে কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণ করেছিল ক’দিন আগে। ব্লগ এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় প্রায়ই এ নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই প্রচার করা হয়। এবং দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা কে পুজি করে কওমি মাদ্রাসা বন্ধ করার দাবি করা হয় – এসবই দেখছি।
কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক ক’দিন আগে আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন, তাদের বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে সঠিক তা আজ প্রমাণিত। চাদপুরের ঘটনা নিয়ে জাতীয় পত্র পত্রিকা টেলিভিশন চ্যানেল সবাই কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধেই রিপোর্ট করেছেন। অথচ স্থানীয় সাংবাদিকেরা সরেজমিনে গিয়ে প্রমাণ করেছেন বলাৎকারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। সিসিটিভি ফুটেজে কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন মাদ্রাসা ভাংচুর এবং একজন আলেমের গায়ে যারা হাত তুললো তাদের বিচার কে করবে?
এটা একটা টেস্ট কেস। কেউ যদি প্রতিবাদ না করেন অজস্র মিথ্যা অভিযোগে চাদপুরের মত অভিজিত দেবজিতরা মাদ্রাসায় ঢুকে শিক্ষকদেরকে মারধর করবে।
আমাদের উচিত মজলুম শিক্ষক হাফেজ ওমর ফারুক এর পাশে দাড়ানো, ভাংচুরের শিকার ওই মাদ্রাসার পাশে দাড়ানো। তাদেরকে আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা। এবং সরাসরি সরেজমিনে গিয়ে খোজ খবর নেওয়া।
যদি না দাড়াই, যদি সচেতন না হই, কিছুই রক্ষা করতে পারবনা। উঠ পাখির মত বালুতে মুখ গুজে শেষ রক্ষা হবেনা। মুখ তোলে মুখোমুখি হতে হবে এবং এটাই সময়ের দাবি।
★ পাবলিক ভয়েস ডেস্ক প্রতিবেদন।
তথ্য সহায়তা : ইসলাম টাইমস, ফাতেহ, সাইমুম সাদী, মহিউদ্দিন কাসেমী।