

নারায়ণগঞ্জ শহরের তল্লা জেমস ক্লাব এলাকার বায়তুল সালাত জামে মসজিদে এসি বিস্ফোরণে আগুন লেগে অর্ধশতাধিক নামাজরত মুসল্লি দগ্ধ হয়েছেন।
এদের মধ্যে চল্লিশজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক এবং ৩৭ জনকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। বাকীদেরকে নারায়নগঞ্জের স্থানীয় ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো রোগীদের মধ্যে বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক (৬০) এবং মুয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেনও (৫০) আছেন ওই ৩৭ জনের মধ্যে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা :
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মসজিদের প্রবেশ পথে লালাভ পানিতে মিশে আছে ঘটনায় আহতদের রক্ত। মসজিদ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জানালার কাঁচ। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত অংশের সাথে বাইরের অংশ যে থাই গ্লাস দিয়ে আলাদা করা হয়েছিলো সেটির ফ্রেম দুমরে মুচরে গেছে।
মসজিদের দেয়ালের কোনো কোনো অংশের টাইলস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়ে রয়েছে। অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছে দগ্ধদের কাপড়। মসজিদের ছয়টি এসি’র একটিও অক্ষত নেই। প্রতিটিতেই বিস্ফোরনের চিহ্ন রয়েছে। ফ্যানগুলির বেশিরভাগের পাখাই বাঁকা হয়ে গেছে।
ঘটনার সময় মসজিদের অল্প দূরে ছিলেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, আটটায় এশার আজান হয়। সোয়া আটটায় জামাত। এর মধ্যে দু’বার বিদ্যুত আসা-যাওয়া করে।। দ্বিতীয়বার বিদ্যুত গিয়ে আসার পরপরই প্রচন্ড শব্দে বিস্ফোরন হয়। ‘মাগো বাবাগো’ চিৎকার শোনা যায়। মসজিদের বাইরে বৃষ্টির পানি জমে ছিলো। কয়েকজনকে মসজিদ থেকে বের হয়ে সেই পানিতে গড়াগড়ি দিতে দেখা গেছে। তাদের শরীরের বেশিরভাগ অংশে চামড়া নেই। শরীরের কাপড় পুড়ে গেছে। এলাকাবাসী দৌড়ে এসে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ও নগরীর মন্ডলপাড়া নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপতালে নিয়ে যায়।
- নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের পিয়ন নুরুদ্দিন জানান, তার দুই ছেলে সোহেল (২০) ও জুয়েল (২২) নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। দু’জনকেই পাচ্ছেন না। তাদের খুঁজতে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছেন। তিনি জানান, এ ঘটনায় ফটো সাংবাদিক নাদিম (২৮) গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন। আশংকাজনক অবস্থায় নাদিমকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপতালে নেয়া হয়েছে।
পাশের খানপুর সর্দারপাড়া পাঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি জসিম উদ্দিন জানান, এ ঘটনায় জলিল (৫০) নামের একজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার গোলাম মোস্তফা জানান, হাসপাতালে চল্লিশজন দগ্ধ এসেছিলেন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে গুরুতর আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা আবু হোসেন জানান, বিস্ফোরণের পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বহু মানুষ সেখানে ভিড় করেন কী হয়েছে বোঝার জন্য।
মোহাম্মদ রনি নামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তিনি মসজিদের বাইরে বহু মানুষকে গড়াগড়ি খেতে দেখেছেন, তাদের শরীর ছিল পোড়া। স্থানীয় বাসিন্দারা এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ফতুল্লা থানার পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় মসজিদের ভেতরে অর্ধশতাধিক লোক নামাজ পড়ছিলেন। “এর মধ্যে হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণ ঘটলে ভেতরে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। বিস্ফোরণের ধাক্কায় মসজিদের থাই গ্লাস উড়ে গিয়ে পড়ে। ভেতরে যারা ছিলেন, প্রায় সবাই কমবেশি দগ্ধ হয়েছেন। মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে বহু মানুষ রাস্তায় জমে থাকা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন গায়ের আগুন নেভানোর জন্য।”
রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই মসজিদে আগুন লাগার খবর পাওয়ার কথা জানিয়ে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা কামরুল আহসান বলেন, তাদের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আধা ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণের বিষয়ে একাধিক স্থানীয়রা বলছেন – মসজিদের নিচে তিতাস গ্যাসের পাইপ লিকেজের কারণেই এই বিস্ফোরণের তীব্রতা বেড়েছে। তারা জানিয়েছে – মসজিদ বন্ধ থাকা অবস্থায় ভিতরে গ্যাসের লিক হয়ে যায়। পুরো মসজিদের কক্ষটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। এরপরেই এসির বিস্ফোরণ। আর সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের এমন অবস্থা থাকায় বিস্ফোরণের মাত্রা তীব্র হয়। অনেক দিন ধরেই এই মসজিদের নিচ দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের লাইন লিক হয়ে গেছে এমন অভিযোগ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানানো হলেও তারা কিছুই করেনি। তারা আরও জানান, মাঝেই মাঝেই মসজিদের ভিতরের গ্যাসের কটু গন্ধ পাওয়া যেতো। কিন্তু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কোন টনক নরেনি।
ওই মসজিদের কাছাকাছি বাসা, এরকম বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, ওই এলাকায় তিতাসের গ্যাসের পাইপে ‘লিকেজ’ ছিল বহু দিন ধরে। মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে কোনোভাবে কিছু ঘটেছে কি না, সেই সন্দেহের কথা বলেন তারা।
প্রসঙ্গত : শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে এশার নামাজ চলাকালে শহরের তল্লা বাইতুস সালাম মসজিদে এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, সবার অবস্থা গুরুতর।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আরেফিন জানান, মসজিদের এসি বিস্ফোরণে অনেকে দগ্ধ হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস এখনও কাজ করছে।
- ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নেভানোর পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের নিচতলার এসিগুলো যেন পুড়ে, গলে গেছে। সবগুলো জানালার কাচ উড়ে গেছে, কোনো কোনো জানালা ফ্রেমসহ উপড়ে গেছে দেয়াল থেকে। ফ্যান, বিদ্যুতের তার ও প্যানেল বোর্ডও দেখা গেছে পোড়া অবস্থায়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মসজিদে এশার নামাজের পর মোনাজাত চলাকালে বিকট শব্দে এসির বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় মসজিদে প্রায় ৪০-৫০ মুসল্লি ছিলেন। বিস্ফোরণের পর হুড়োহুড়ি করে বের হওয়ার সময় অনেককেই বস্ত্রহীন এবং শরীর ঝলছে যাওয়া অবস্থায় দেখা গেছে।
খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন এবং পুলিশ সুপার জায়েদুল আলমসহ র্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আরেফিন বলেন, “ওই মসজিদের সামনে তিতাস গ্যাসের লাইনে লিকেজ আছে, এটা আমরাও দেখেছি। আসলে কী ঘটেছে, সেটা তদন্ত করে তারপর বলা যাবে।” সূত্র : বাসস, সময় টিভি