ক্রাইস্টচার্চে মুসলিম ‘হত্যাকারী’ খৃস্টান জঙ্গী ট্যারেন্টের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড 

প্রকাশিত: ১২:২২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২০
ক্রাইস্টচার্চে মুসলিম ‘হত্যাকারী’ খৃস্টান জঙ্গী ট্যারেন্টের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড 

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে লিনউড ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের আল-নূর মসজিদ ও পাশের আর একটি মসজিদে নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের হোতা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী খৃস্টান জঙ্গী ব্রেন্টন ট্যারেন্টের মামলার রায় হয়েছে আজ।

  • দীর্ঘ বিচার পক্রিয়া শেষে আজ (২৭ আগস্ট) তাকে বিনা প্যারোলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ৫১টি হত্যা, ৪০টি হত্যাচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড করার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর তাকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ১৫ মার্চ, শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরের আল নূর ও লিনউড মসজিদে এই বর্বরতম হামলা চালায় ঘৃস্টান জঙ্গী ২৯ রছর বয়সি অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারেন্ট।

বিচারক ক্যামেরন ম্যান্ডার চার দিনের (২৪ আগস্ট সোমবার থেকে ২৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার) একটি স্থায়ী শুনানি শেষে আজ তার সিদ্ধান্ত শুনিয়েছেন। তিনি ২৯ বছর বয়সি ট্যারেন্টকে বলেছিলেন, “আমি যা অনুমান করতে পারি সেখান থেকে মনে হচ্ছে আপনি ভুক্তভোগীদের প্রতি কোনও সহানুভূতি এখনও প্রকাশ করছেন না। তিনি ট্যারেন্টকে একজন ঘৃণাবাদী বর্ণনা করে বলেছেন, “আপনি যে লোকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন তা কেবল মানসিকভাবে বিকৃতরাই প্রকাশ করতে পারে”।

আরও পড়ুন :

ক্রাইস্টচার্চের শহীদ পরিবারের অশ্রুসজল ভাষ্য

ক্রাইস্টচার্চের আল-নূর মসজিদে হামলার এক বছর ও বিস্তারিত ঘটনা

ব্রেন্টনের বিচার : ক্রাইস্টচার্চে মসজিদ পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো এই সন্ত্রাসী

আজ বৃহস্পতিবার ক্রাইস্টচার্চের এই আদালতে তার সাজা প্রদানের পরে অস্ট্রেলিয়ান অধিবাসী এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ট্যারেন্ট নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যক্তি হয়ে প্যারোলের সম্ভাবনা ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হলেন।

রায় শোনানোর সময়, ট্যারেন্ট নীরবে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে ছিলেন এবং মাঝে মাঝে তাঁর ডান হাতটি রেখে মাথা নিচু করে রাখতেন।

– শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী খৃস্টান জঙ্গী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট।

  • ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ডে শাস্তিস্বরুপ ‘মৃত্যুদণ্ড’ বাতিল করে দেওয়ার পর থেকে সবচেয়ে কঠোর শাস্তি হিসেবে গন্য হচ্ছে এটি। কারণ নিউজিল্যান্ডে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন সাজার ইতিহাস নেই এর আগে। ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে সেই শাস্তিই দেয়া হলো। তবে তিনি মৃত্যুদণ্ড পেলে ন্যায়বিচার আরও প্রশ্নাতিত হতো বলেই মতামত অনেকের।

আজ বৃহস্পতিবার ক্রাইস্টচার্চ হাইকোর্টের বাইরে অনেকে ক্ষতিগ্রস্থ এবং তাদের পরিবারের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে। ট্যারেন্টকে তার শাস্তি শোনানোর পর যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন ক্ষতিগ্রস্থরা কাঁদতে কাঁদতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। ক্রাইস্টচার্চ সিটি সেন্টারে কোর্ট কমপ্লেক্সের বাইরে লোকজনের ভিড় জমেছিল, কিছু লোক ক্ষতিগ্রস্থ এবং তাদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতেও দেখা গেছে।

আইনজীবীরা বলেছিলেন যে ট্যারেন্ট তার এই কর্মের জন্য আফসোস করেননি। তিনি তার বিশ্বাস পরিবর্তন করেছিলেন বলেও মনে হয় না। তাছাড়া তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থদের সাথেও তিনি কথা বলেননি – যাদের মধ্যে অনেকেই আজ (বৃহস্পতিবার) আদালতে সাদা ফুল নিয়ে তাদের হারানো স্বজনদের স্বরণ করতে এসেছিলেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মার্ক জারিফ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কাছে ট্যারান্টের ব্যাপারে বলেছেন যে তিনি “একটি হিংসাত্মক প্রতিশোধের কাজ হিসাবে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চেয়েছিলেন।”

জারিফ বলেছেন, “প্যারোল ব্যতীত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তার জন্য উপযুক্ত ছিল। তার বন্দুকের তাণ্ডবের “চরম সহিংসতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা যেমন তাদের আফসোস বহন করবে তেমনি জেলখানায় ট্যারেন্টও আফসোস বহন করে জীবন কাঁটাবে”

  • অপরদিকে আদালতে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্টত্ববাদী খৃষ্টান সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে সামনে রেখে একে একে প্রায় সকল শহীদ পরিবারের ভাষ্য শোনা হয়েছে। সেখানে পরিবারগুলোর ভাষ্য ও আহতদের কথা শুনে অশ্রুসজল হয়েছেন সবাই।

এর মধ্যে আল-নূর মসজিদে ভয়াবহ এ হামলায় শহীদ হওয়া সর্বকনিষ্ঠ শিশু তিন বছর বয়সী ‘মুকাদ ইবরাহীম’ এর বাবা বিচারকের সামনেই ট্যারেন্টকে একজন ‘শয়তান মানব’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি ব্রেন্টনকে একজন ‘ভয়াবহ হত্যাকারী’ হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন।

তিনি বলেছেন – “জেনে রাখুন যে সত্যিকারের ন্যায়বিচার আপনার পরবর্তী জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে এবং এটি আরও কঠোর (কারাগারের চেয়েও বেশি) হবে আপনার জন্য। আপনি যা করেছেন তার জন্য আমি আপনাকে কখনও ক্ষমা করব না।” তিনি আরও বলেছেন – “আপনি আমার ছেলেকে হত্যা করেছেন এবং আমার কাছে এটাই যেন আপনি পুরো নিউজিল্যান্ডকে হত্যা করেছেন”। স্থির কণ্ঠে কান্নাজড়িয়ে মুকাদ ইবরাহীমের বাবা তাকে বলেছিলেন।

ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন – “আমি কখনই ভুলে যাবো না যে আমার ছেলে কীভাবে মসজিদে উপস্থিত হতো এবং বাচ্চাসূলভ দুষ্টুমি করতো। তার সাথে মসজিদে সবার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যেতো এবং সবাই তাকে পছন্দ করতো।”

– আল-নূর মসজিদে শহীদ হওয়া শিশু মুকাদ ইবরাহীম

এর আগে আদালতকে বলা হয়েছিল যে, সন্ত্রাসী ট্যারেন্ট আল নূর মসজিদে যখন হামলা করতে যান এবং নির্বিচারে গুলি করতে থাকেন তখন বাচ্চা মুকাদ তার বাবার পা আঁকড়ে ধরে ছিলেন এবং এ অবস্থাতেই ওই সন্ত্রাসী তাকে গুলি করেছিলো। সে ধারণা করেছিলো মুকাদের সাথে সাথে তার বাবাও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে সে বেঁচে গিয়েছিলো।

হাশিম মোহাম্মদ হোসেন যার ভাই মোহাম্মদকেও সেদিন শহীদ করা হয়েছিল, তারা ট্যারেন্টকে “একজন শয়তানের পুত্র” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন – “অনন্তকালের জীবনে আপনার জন্য চার দেয়ালে বন্দি একটি কঠোর নরকের জীবন অপেক্ষা করছে”।

আহমাদ নবী যার বাবা হাজী দাউদ নবী আল নূর মসজিদে শহীদ হয়েছেন, তারা ট্যারান্টকে একজন ‘কাপুরুষ’ বলে অভিহিত করে বলেছেন -“আপনি কারাগারে থাকাকালীন সময়ে বুঝতে পারবেন যে আপনি এখন জাহান্নামে রয়েছেন এবং আরও কঠোর জাহান্নামের আগুন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে”।

– আদালতের সামনে কথা বলছেন আহমদ নবী। ছবি : রয়টার্স।

তিনি তার বাবার হত্যাকারীকে দৃশ্যমান ক্রোধের সাথে সম্বোধন করার সময় ট্যারেন্টের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলেন, “আপনি যা করেছেন তার জন্য আমি আপনাকে ক্ষমা করবো না। ট্যারেন্টকে ‘আবর্জনা’ হিসাবে উল্লেখ করে তিনি আরও যোগ করেছেন, “আপনি পৃথিবীর মাটিতে কবরস্থ হওয়ারও উপযুক্ত নন।”

এছাড়াও জন মিলনে, যার ১৪ বছরের ছেলে সায়াদকেও শহীদ করা হয়েছিলো সেদিন। এ ঘটনার পর থেকে তাঁর মানসিক অসুস্থতা তৈরি হয়েছিলো এবং মানসিক চিকিৎসাও নিতে হয়েছিলো। তিনি বলেছেন – “আমার হৃদয়ে একটি বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে যা কেবল তখনই সেরে উঠবে যখন আমি সায়াদের সাথে আবার স্বর্গে দেখা করবো।” “আমি আশা করি, ব্রেন্টন তোমাকেও সেখানে দেখতে পাব এবং যদি তুমি সুযোগ পাও তবে আমি তোমাকে সায়াদের কাছে অন্তত ‘দুঃখিত’ বলার জন্য অনুরোধ করবো। আমি নিশ্চিত যে সে তোমাকেও ক্ষমা করে দিয়েছে।”

  • সায়াদের বাবা আদালতে তার পূত্রের ছবি দেখিয়ে সবাইকে অনুরোধ করেছিলো “দয়া করে, কেবল তার নামটি মনে রাখুন আপনারা।”

সেদিন পায়ে গুলিবিদ্ধ মোস্তফা বুজতাস ট্যারেন্টকে একটি “পঁচা কাপড়ের সাথে তুলনা করেছেন যা নোংরা কাজের পরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।” তিনি বলেছেন –  “আপনি মানুষ তো নন, এমনকি প্রাণীও নন, যেহেতু প্রাণী পৃথিবীর পক্ষে উপকারী কিন্তু আপনি ক্ষতিকর”।

নিউজিল্যান্ডের মসজিদে শহীদ পরিবারদের একজন সারা কাসেম তার পরিবারের অনেককেই আদালতে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে এই গণহত্যায় শহীদ হওয়া তার পিতাকে একজন “বীর” এবং একজন “উজ্জল ও ঝলমলে মানুষ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি ট্যারেন্টকে তার নামটি ভুলে যাবেন না বলেও জানিয়েছিলেন। “কান্না থামিয়ে থামিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন -“আমি আমার বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই, আমার বাবার আওয়াজ শুনতে চাই।”

'আমি বাবার আওয়াজ শুনতে চাই' : কান্নাজড়িত কন্ঠে ক্রাইস্টচার্চের শহীদের সন্তান

– আদালতে বক্তব্য দিচ্ছেন সারা কাসেম। ছবি : রয়টার্স

খৃস্টান জঙ্গী ট্যারান্ট কর্তৃক এই গণহত্যায় শহীদ হওয়া আত্তা এলায়ানের ‘মা’ মায়সুন সালামা বলেছিলেন, ট্যারেন্ট “পুরো নিউজিল্যান্ডকে কলূষিত করেছে এবং পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে”। তিনি কান্নাজড়িয়ে ট্যারেন্টকে বলেছেন – “আপনি নিজেকে ৫১ জন নিরপরাধ মানুষের হত্যাকারী হিসেবে প্রকাশিত করেছেন। তাদের একমাত্র অপরাধ – (আপনার চোখে) যে তারা মুসলমান। কিন্তু আপনি মনে রাখবেন “আপনি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলেছেন, আমি আপনাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।”

– শহীদ হওয়া আত্তা এলায়ানের ‘মা’ মায়সুন সালামা : ছবি : বিবিসি।

বিচারিক আদালতে প্রথম বক্তব্য রাখা আল-নূর মসজিদের ইমাম জামাল ফৌদা ট্যারেন্টকে সম্বোধন করে বলেছিলেন “তুমি একজন পথভ্রষ্ট ও বিকৃত চিন্তা লালন করা ব্যাক্তি”। তিনি আরও বলেছেন যে, তোমার মস্তিস্কে ঘৃণার বীজ রয়েছে। তোমার জন্য কেবল ঘৃণা প্রকাশই করা যায়”।

  • এছাড়াও তিনদিনের বিচারিক কার্যক্রমে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মধ্যে প্রায় ৬০ জনেরও বেশি লোক তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। যেখানে শহীদদের পরিবার এবং আহতরা কথা বলেছেন। ভুক্তভোগীদের কিছু আত্মীয় বিদেশ থেকে ভ্রমণ করে এসেছিলেন এবং এই বিচারিক কার্যক্রমে অংশ নিতে তাদেরকে দুই সপ্তাহের কোয়ারান্টিনেও থাকতে হয়েছিলো করোনাভাইরাস থেকে নিশ্চয়তার জন্য।

বিচারিক প্রক্রিয়া :

জানা যায় – চার দিন স্থায়ী হওয়া এই সাজার শুনানি সোমবার সকালে ক্রাইস্টচার্চের একটি উচ্চ আদালতে শুরু হয়েছিল। কোভিড -১৯ এর কারণে মূল আদালতের ঘর তুলনামূলকভাবে খালি রয়েছে। তবে সামাজিক দূরত্বের ব্যবস্থা গ্রহণ করে অন্য শহরের অন্যান্য আরো বেশ কয়েকটি কোর্টরুম থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শত শত মানুষ এই বিচারিক প্রক্রিয়া দেখেছেন।

[যে আদালতে বিচার হয়েছে সন্ত্রাসী ট্যারেন্টের।]

খৃস্টান জঙ্গী ব্রেন্টন ট্যারান্ট ধূসর রংয়ের কারাগারের পোশাক পরে তিনজন অস্ত্রধারী পুলিশের বেষ্টনিতে একটি কাচের ঘের দেওয়া রুমে বসেছিলেন। বিচারিক প্রক্রিয়ার সময় তাকে বেশিরভাগ সময়ই নির্লিপ্ত দেখা গেছে। তবে মাঝে মাঝে এই সন্ত্রাসী তার নির্মম গণহত্যার শিকার শহীদ পরিবারগুলো যে রুমে বসে ছিলো সেখানে তাঁকাচ্ছিলেন।

আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর বার্নার্ব হাউস আদালতকে বলেছিলেন যে এই সন্ত্রাসী বন্দুকধারী কয়েক বছর আগে থেকেই ‘মসজিদে হামলার’ পরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু করেছিলো এবং তার লক্ষ্য ছিল “যতটা সম্ভব প্রাণহানির ঘটনা ঘটানো”।

তিনি জানান- ট্যারেন্ট নিউজিল্যান্ডের মসজিদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন – মসজিদের অবস্থানসহ আরও বিশদভাবে সে এ বিষয়ে যাচাই করে নিয়েছিলো।হামলার আগের কয়েক মাস তিনি ক্রাইস্টচার্ট ভ্রমণ করেছিলেন এবং অনুসন্ধানের জন্য তার প্রাথমিক লক্ষ্য অনুসারে আল নূর মসজিদের উপরে একটি ড্রোন উড়িয়েছিলেন।

ব্রেন্টন আল নূর মসজিদ এবং লিনউড ইসলামিক সেন্টার ছাড়াও অ্যাশবার্টন মসজিদকেও টার্গেট করার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তৃতীয় মসজিদে যাওয়ার পথে তাকে আটক করা হয়েছিল। আক্রমণের দিন, তিনি আল নূর মসজিদ থেকে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে লোকজনকেও রাস্তায় গুলি করেছিলেন। এর মধ্যে আন্সি আলিবাভা নামে এক ভুক্তভোগী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

লিনউড ইসলামিক সেন্টারের দিকে যাওয়ার সময় তিনি থামলেন এবং পালাতে সক্ষম হওয়া আফ্রিকান বংশোদ্ভূত লোকদের দিকে গুলি করলেন। গ্রেপ্তারের পরে তিনি পুলিশকে বলেছিলেন যে তার পরিকল্পনা ছিল হামলার পরে মসজিদগুলি পুড়িয়ে ফেলার, এবং তিনি ইচ্ছা করেছিলেন যে তিনি এটি করবেনই।

সন্ত্রাসী ট্যারান্ট আদালতে নিজেই নিজের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি এর আগে তার উপর আরোপিত অভিযোগগুলি অস্বীকার করেছিলেন এবং গত জুন মাস থেকে বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তখন তার আবেদন ছিলো – তিনি সর্বনিম্ন ১ বছরের বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হবেন। তবে হাইকোর্টের বিচারপতি বিচারপতি ‘ক্যামেরন মান্ডার’ তাকে প্যারোলবিহীন আজীবন কারাদন্ড দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে এটি এমন একটি শাস্তি যা নিউজিল্যান্ডে আগে কখনও কাউকে দেওয়া হয়নি।

এদিকে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন গত সপ্তাহে বলেছেন, বেঁচে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারগুলোর পক্ষে এটি একটি কঠিন সপ্তাহ হবে। তিনি বলেন – “আমি মনে করি এবং বুঝতে পারি যে তাদের জন্য এই সময়টি কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে। এবে একটি উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে তাদের এই বেদনাহত সময় একটি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ সময়ে পরিণত হতে পারে।”

এর আগে গত বছর এই ভয়ানক হামলার পরপরই তিনি এই সন্ত্রাসীর নাম মুখে না বলার শপথ করেছিলেন এবং এখন পর্যন্ত তিনি এই সন্ত্রাসীর নাম মুখে নেননি।” অপরদিকে এই ঘটনার এক মাসেরও কম সময় পরে নিউজিল্যান্ডের সংসদে সামরিক ধাঁচের আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো।

প্রসঙ্গত : ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ শুক্রবার নিউজিল্যাণ্ডের ক্রাইস্টচার্চে লিনউড ইসলামিক সেন্টারে জুমার নামাজ চলাকালে অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করে নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যা চালান ২৯ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক শ্বেতাঙ্গ জঙ্গী ও সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট। হত্যা ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাঁর সাজা ঘোষণা করা হবে। ক্রাইস্টচার্চের ওই ঘটনায় বিশ্ববাসী শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

সে প্রথমে আল নূর মসজিদে যান এবং শুক্রবারের নামাজে অংশ নেওয়া লোকদের উপর গুলি চালান। এরপরে তিনি লিনউড মসজিদে প্রায় ৫ কিলোমিটার (৩ মাইল) গাড়ি চালিয়ে আরও লোককে হত্যা করেন। যেখানে তিনি ৫১টি হত্যা, ৪০টি হত্যাচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন আদালতে।

এমন বর্বরোচিত গুলির ঘটনায় দুজন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন বাংলাদেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। একটি দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে তামিম-মুশফিকরা তখন নিউজিল্যান্ডে। গুলির ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে ওই মসজিদে ঢুকতে যাচ্ছিলেন ক্রিকেটারদের অনেকেই। গুলি শুরু হওয়ার পর তারা দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে আসেন।

নিউজিল্যান্ডের দণ্ড আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, তাই দেশটির আইন অনুযায়ী তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু বিচারক প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলেছেন, অর্থাৎ কোনো কারণে ট্যারেন্ট প্যারোলেও কারগার থেকে বেরুতে পারবেন না।

নৃশংস এই ঘটনায় সেদিন ৫১ জন মুসলমান নিহত হয়েছিলেন এবং ৪০ জন আহত হয়েছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসল্লিদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত গুলি করে গেছেন ট্যারেন্ট। শুধু তাই নয়, হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনা ফেসবুকে লাইভ করেছিলেন তিনি। বিচার প্রক্রিয়ার সময় আদালতে কয়েকবার ট্যারেন্ট এমন হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি, এনডিটিভি, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস।

ঘটনাক্রম : নিউজিল্যান্ডে আল-নূর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন