সংবিধান থেকে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বাদ দিতে হিন্দু আইনজীবী কর্তৃক ১০ জনকে নোটিশ

প্রকাশিত: ৪:০৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২০

সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা চালু করার দাবিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১০ জনকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একজন হিন্দু আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ।

গতকাল রোববার (১৬ আগস্ট) এই আইনজিবী সংশ্লিষ্টদের প্রতি নোটিশটি পাঠান।

নোটিশে বিএনপি মহাসচিব, জাতীয় পার্টির মহাসচিব, গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননকেও বিবাদী করা হয়েছে।

নোটিশে বলা হয়েছে, ‘১৯৪৭ সালের পর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, নির্যাতন এবং বেআইনি কার্যকলাপের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টানসহ অন্যান্য নাগরিকরা এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ভারত, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সার্বিক সহযোগিতায় স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

আমাদের ১৯৭২ সালের পবিত্র সংবিধানে স্বাধীনতার চেতনাসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিসমূহ পরিবর্তন করা হয়। যা স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘু জনগণ মনেপ্রাণে গ্রহণ করেনি। সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের ফলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখন সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।’

‘বর্তমানে ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্য হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সাংবিধানিকভাবে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সুতরাং বিশ্ববাসীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে পরিগণিত করা আবশ্যক। সেজন্য পবিত্র সংবিধানে অর্থাৎ মূলনীতি ৮ম আর্টিকেলে ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকবে। কিন্তু কোনোক্রমেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে না।

নোটিশে আরও বলা হয়, জাতীয় সংসদে বিষয়টি বিল আকারে উত্থাপনসহ বিলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য দ্বারা পাস করাও আবশ্যক। অন্যথায় বাংলাদেশ চিরতরে সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর নিকট স্বীকৃতি পাবে। তাছাড়া জাতির পিতা ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর বহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।’

প্রসঙ্গত : বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম রয়েছে। তবে সব ধর্মের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিতের কথাও বলা হয়েছে সংবিধানে৷ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সার্বজনীন৷ আর প্রচলিত আইনে ধর্ম অবমাননা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷

বাংলাদেশের সংবিধান শুরু হয়েছে, বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে) দিয়ে৷ এবং সংবিধানের প্রথম ভাগেই রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের কথা বলা আছে৷

সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন৷ আর সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে –
(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে
(২) কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।

সংবিধানের প্রস্তাবনা শুরুর আগে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’, রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিয়ে যা বলা হয়েছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, সংবিধান সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে৷

তবে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১২ অনুচ্ছেদ ধর্ম নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে৷ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল – জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে৷” তাই সংবিধানের প্রস্তাবনা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির চতুর্থ নীতিটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা৷

সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’-র ব্যাপারে বলা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য –
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে৷
ধর্ম, ধর্মীয় স্বাধীনতা, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, ধর্ম নিরপেক্ষতা এ সব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে পরস্পর বিরোধিতা অস্বীকার করা যায় না৷

জানা যায় – বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম’ এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এ বিষয় দু’টি ছিল না৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম সংযোজন করা হয়৷ আর ১৯৮৮ সালে সাবেক জনপ্রিয় ও সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সময় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযুক্ত হয়৷

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পর ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফেরার কথা বলা হয়৷ ২০১১ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানে ফেরার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখে৷ এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মেজরিটির চাহিদা ও মানসা অনুসারে বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকেই রাখা হয়।

এছাড়াও এর আগে বেশ কয়েকবারই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের চেষ্টা করা হয়েছে সংবিধান থেকে কিন্তু দেশের ধর্মপ্রিয় জনগণ ও আলেম ওলামাদের প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয়নি। নতুন করে মিমাংসিত এ বিষয়টি আবার সামনে এলে বিতর্ক তৈরি হবে এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র : চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ডয়চে ভেলে।

আরআর/পাবলিক ভয়েস

মন্তব্য করুন