মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাবধানে বিদায় নিলেন পাঁচজন যুগশ্রেষ্ট আলেম

প্রকাশিত: ১২:২৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০২০

সারা পৃথিবীতেই চলছে মৃত্যুমিছিল। করোনায় মৃত্যুবরণ করছেন লাখো মানুষ। এই প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজারের বেশি। স্থবির হয়ে আছে পুরো পৃথিবী। দুঃখের এক বিষাদময় সময় কাঁটাচ্ছে পৃথিবী নামক এই গ্রহ।

বিশ্বব্যাপী এই দুঃখের মধ্যেও বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক বিষাদময় সময় ছিলো গত এক সপ্তাহ। ৮ এপ্রিল ২০২০ থেকে ১৭ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত হিসেব করলে এই ‘এক সপ্তাহ একদিনে’ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৫ জন প্রতিথযশা আলেমের ইন্তেকাল হয়েছে। কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে, কেউ পূর্ব অসুস্থতার কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন তারা। (ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহী রজিয়ুন)

এই এক সপ্তাহে এ দেশের যেসব আলেমরা মৃত্যুবরণ করলেন-

এক. আল্লামা আব্দুল মোমিন রহ.(শায়খে ইমামবাড়ি)

গত ৮ এপ্রিল বুধবার রাতে ইন্তেকাল করেছেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর খলিফা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি ও জামেয়া দারুল কোরআন সিলেটের শায়খুল হাদিস, প্রখ্যাত বুযুর্গ পীরে কামেল আল্লামা শাহ আব্দুল মোমিন (শায়খে ইমামবাড়ি)।

৮ এপ্রিল রাত ১২ টা ৪৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ গৃহে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৯ বছর। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগেছেন।

দুই. মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী রহ.

৮ এপ্রিল বুধবার বাদ মাগরিব ইন্তিকাল করেছেন, ইসলামী অর্থনিতিবিদ, শায়খুল হাদিস, মুফতি ড. আবদুল্লাহ বিক্রমপুরী। তিনি কর্মজীবনে ঢাকা ইসলামপুর তাতিবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। এছাড়াও তিনি ঐতিহ্যবাহী মোস্তফাগঞ্জ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। এবং তিনি জামালুল কুরআন মাদরাসা গেন্ডারিয়ায় বুখারীর দরস দিতেন । তিনি ছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফির শীর্ষস্থানীয় খলিফাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও তিনি সেন্ট্রাল শরিয়াহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ও ট্রাস্ট ব্যাংক শরিয়াহ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন ।

৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কুর্মিটোলা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬০ বছর। তাঁর মৃত্যু নিয়ে ‘করোনাভাইরাস জড়িয়ে’ কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হলেও মরহুমের পরিবার থেকে প্রমাণ্য উপস্থাপনার মাধ্যমে জানানো হয়েছে যে, তিনি দীর্ঘদিন হজমজনিত ও ডায়াবেটিকের পেশেন্ট ছিলেন। রাজধানীর আজগর আলী মেডিকেলে তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। পূর্ব অসুস্থতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।

তিন. মাওলানা মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী রহ.

১৪ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকাল ৪ টায় ইন্তেকাল করেছেন খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাওলানা সৈয়দ মুজিবুর রহমান পেশওয়ারী (মির্জাপুরের পীর সাহেব)।

মৃত্যুকালে মরহুমের বয়স হয়েছিলো ৭০ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে ও দীর্ঘদিন শারিরীক অসুস্থতায় ভুগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

চার. মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী রহ.

১৬ এপ্রিল ইন্তেকাল করেছেন মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রহীম বুখারী। তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মুহতামিম আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারীর ছোট ভাই। আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিস বাংলাদেশ-এর পরিদর্শক ও চকরিয়া ইমাম বোখারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। দার্শনিক রাজনীতিবিদ খতীবে আজম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ. এর একান্ত শিষ্য, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা, পাণ্ডিত্যের অধিকারী আলেম ও সুবক্তা ছিলেন।

তিনি ১৬ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার দুপুর ২ টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ডাক্তারের নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। তাঁর আনুমানিক বয়স হয়েছিলো ৭১। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, চার মেয়ে সন্তানসহ অসংখ্য শাগরিদ ও গুণগ্রাহী রেখে যান।

পাঁচ. আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনছারী রহ.

গতকাল ইন্তেকাল করেছেন, বিশ্ব নন্দিত মুফাচ্ছিরে কুরআন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির, বি-বাড়ীয়ার বেড়তলা জামিয়া রাহমানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনছারী।

তিনি ১৭ এপ্রিল মাগরিবের পূর্বে নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো আনুমানিক ৭০ বছর। মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি দেশ বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় আমেরিকায় ছিলেন। তার বেশ কয়েকবার অপারেশন এবং কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিলো। সর্বশেষ গত কয়েক মাস ধরে তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।

মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারী বাংলদেশের একজন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ। তিনি প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি দাওয়াতী ময়দানে কাজ করেছেন। দাওয়াতী কাজে সফর করেছেন ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাবধানে এতজন প্রতিথযশা আলেমের ইন্তেকাল বাংলাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য দুঃখজনক অধ্যয়।

এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী তাঁর ফেসবুক আইডিতে লেখেন, বিগত এই এক সপ্তাহ এদেশের আলেমসমাজের জন্য ছিল খুবই মর্মান্তিক ও বেদনার। এক সপ্তাহ সময়ে পাঁচজন বড় বড় হক্কানী বুযূর্গ আলেম ইন্তেকাল করেছেন৷ আমরা হারালাম দেওবন্দী কাফেলার প্রতিথযশা রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন যুগসচেতন পাঁচজন মুরুব্বিদেরকে। যারা ছিলেন পথপ্রর্দশক।

প্রত্যেকেই ওলামায়ে কেরামের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য কায়েম, কুরআনের শিক্ষা বিস্তার এবং দ্বীনের খেদমতে সারা জীবন ত্যাগ ও কুরবানী দিয়েছেন। শিরক বিদআত ও কুসংস্কারমুক্ত এবং সুন্নাতে রাসুলের সা. পরিপূর্ণ অনুসরণে আজীবন প্রচেষ্ঠা চালিয়েছেন। মানবতার কল্যাণে, ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্টীর মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

আমরা মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি আল্লাহ যেন সকল মরহুমিনদের দীনি খেদমত গুলোকে কবুল করে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। আমীন।

হাছিব আর রহমান/পাবলিক ভয়েস

মন্তব্য করুন