ত্রাণ আত্মসাত; হার্ডলাইনে সরকার

প্রকাশিত: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০২০

১. নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দেয়া ত্রাণের ১৩ বস্তা চালসহ মঙ্গলবার পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন শাহিন শাহ্ নামের এক ইউপি সদস্য। নাটোরের সিংড়া উপজেলার সুকাশ ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য তিনি। এ ঘটনায় আরো তিনজনকে আটক করে উপজেলা প্রশাসন। ওইদিন দুপুরে স্থানীয় বোয়ালিয়া বাজার থেকে চালসহ আটক করা হয় তাদের।

২.জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি আর গোডাউন যেন সরকারি চালের গোডাউনে রুপ নিয়েছে।  ১০ এপ্রিল, শুক্রবার সদর উপজেলার শাহবাজ ইউনিয়নেই দুটি অভিযানে ৮৫+৭৪=১৫৯ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে প্রশাসন। ৩. এছাড়াও চাল উদ্ধার হয়েছে বকশিগঞ্জ এবং মেলান্দহ থেকেও। বৃহস্পতি রাত থেকে শুক্রবার সন্ধা পর্যন্ত চারটি অভিযানে চাল উদ্ধার হয়েছে মোট ৩৮৯ বস্তা।

৪. জামালপুরে আরো ৩২৬ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়েছে। গতোকাল ১১ এপ্রিল, শনিবার সকালে জামালপুর সদর উপজেলার তুলশীরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তোফাকে ১২৬ বস্তা (৭৪৪০ কেজি ) চাল সহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ।জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে সদর থানা পুলিশ। সদর থানা পুলিশের বিশেষ সূত্র পাবলিক ভয়েসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

আটক তুলশীরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তোফাজ্জল (বামে) যুবলীগ নেতা রানার গোডাউন (ডানে)

৫.এদিকে জামালপুর সদর থানা যুবলীগের সদস্য রানা মিয়া খোকার গোডাউন থেকে ২০০ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে নরুন্দী তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ।

৬.বিয়ার বাজারে অভিযানের আগে ১০ এপ্রিল, শুক্রবার সকালে (বেলা ১১টার দিকে) শাহবাজপুরের  চিকারপাড়া থেকে সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৮৫ বস্তা চাল উদ্ধার করে উপজেলা প্রশাসন।উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফরিদা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে এসব চাল জব্দ করা হয়। তবে এসময় কাউকে আটক করা যায়নি।

জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান ও উদ্ধারকৃত চাল, ইনসেটে আওয়ামী লীগ নেতা দুলাল

৭.পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কুলইতলী গ্রাম থেকে শুক্রবার চালসহ আটক হয়েছেন স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. আবুল কালাম সুতার ও গোলাম মোস্তফা। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত চাল অর্ধেক দিয়ে বাকিটা বিক্রি করে দিচ্ছিলেন তারা। এ সময় স্থানীয়রা তাদের আটক করে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে তাদের থানায় নিয়ে যায়।

৮. একই অপরাধে আটক হয় জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সাইদুর ও তার শ্যালক আনোয়ার হোসেন। সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) চাল অবৈধভাবে বিক্রি ও সরবরাহ করার সময় র‌্যাব সদস্যরা তাদের হাতেনাতে আটক করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে সাত বস্তা ওএমএসের চাল উদ্ধার করা হয়।

সারাদেশে দীর্ঘ লকডাউন ও সরকারি ছুটির কারণে অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। নিদারুণ কষ্টে দিনযাপন করছে নিম্ন আয়ের লাখ লাখ মানুষ। কাজ নেই, রোজগার নেই। দিনমজুরদের ঘরে খাবার নেই। এই শ্রেণির মানুষের তালিকা করে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খাবারের জন্য ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছেন সমাজের বিত্তবানসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তারাও ঘরে ঘরে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। ঠিক তখনই বেশকিছু এলাকায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন ত্রাণের চাল আত্মসাতে। সুযোগের অপব্যবহার করে গরিবের খাবার আত্মসাৎ করছেন তারা। অনেক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ত্রাণের চালের বস্তা। পুলিশ আটক করছে তাদের। কেউ কেউ রয়েছেন পলাতক। প্রায় প্রতিদিনই এ

ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের। কারণ আটককৃতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন। কিন্তু অপরাধী যেই হোক তাকে ছাড় না দেয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ত্রাণে অনিয়মকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিষয়ে আওয়ামী লীগও কঠোর অবস্থানে। অনিয়মকারীদের ফৌজদারি মামলা ও বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য দেয়া বরাদ্দ যেন সঠিক ব্যবহার হয়, তা নিশ্চিত করতে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম অনিয়ম ও নয়ছয় বরদাস্ত না করার কথাও উচ্চারণ করেছেন তিনি। গত মাসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে, করোনা পরিস্থিতি ও প্রণোদনা ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়েও এমন কথা বলেন তিনি। কিন্তু এরপরও থেমে নেই ত্রাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া সরকারি চাল চুরির ঘটনা।

ত্রাণের চাল চুরি, বিতরণে অনিয়ম ও আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা জোরদারের দাবি জানিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বারবার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পরও করোনা ভাইরাস সংকটকালে লকডাউন পরিস্থিতিতে হঠাৎ কর্মহীন নিরুপায় অসহায় মানুষের জন্য সরকার যে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে, সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে অনেক জায়গাতেই প্রকৃত খাদ্য সহায়তা প্রার্থীর তালিকা প্রণয়ন ও খাদ্য বিতরণে সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ হয়েছে। ওএমএসের চাল কালোবাজারে বিক্রি, ত্রাণের চাল আত্মসাৎ ও চুরি এবং মজুদদারির ঘটনার খবর আসছে। মুখ না দেখে এসব দুর্নীতিবাজ, চোর, আত্মসাৎকারী, কালোবাজারি, মজুতদারদের মোবাইল কোর্টে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

একের পর এক এ ধরনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও। দলটির সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ত্রাণ বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাণ নিয়ে যারাই ছিনিমিনি খেলবে, তারা যে-ই হোক কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

আর দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ত্রাণ আত্মসাৎকারীদের জানোয়ার আখ্যা দিয়ে বলেছেন, অসহায় মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল যারা আত্মসাৎ করছে, কারা এসব অমানুষ? যারা এই রোগের সময়ও এই অসহায় মানুষের ত্রাণ আত্মসাৎ করতে পারে? এদের মানুষ বলা যায় না, এরা মানুষরূপী জানোয়ার। এদের প্রতি আমি তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা জানাচ্ছি। হানিফ বলেন, প্রশাসনকে অনুরোধ করব, আপনাদের উপজেলা পর্যায়ের সব কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিন। এই ত্রাণ যাতে কেউ আত্মসাৎ করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিন। যদি কোনো ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ত্রাণ আত্মসাতের, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। ত্রাণ জালিয়াতি আমরা বরদাস্ত করব না। আমরা কঠোরভাবে এটা দমন করতে চাই।

আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা ত্রাণ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়ার পর গতকাল বিকালে ত্রাণ নিয়ে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ও আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। সেইসঙ্গে এ ঘটনায় যেসব জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যেসব কর্মী জড়িত, তাদের বরখাস্তের পাশাপশি আইনের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে। বিকালে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম এক ভিডিও বার্তায় এ নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করার কথাও জানান তিনি। আদেশটি জেলা প্রশাসকদের কাছেও পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিদেরও তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, কোথাও কোথাও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এরূপ অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্তসহ তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু ও কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট খবর: জামালপুরে চোরের খনি: ব্যবসায়ী ও নেতাদের গুদাম থেকে উদ্ধার ৩৮৯ বস্তা!

জামালপুরে আরো দুই আওয়ামী লীগ নেতার গোডাউন থেকে ৩২৬ বস্তা উদ্ধার

পটুয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যানের ব্যপারে চাল চুরির অভিযোগ মিথ্যে

এমএম/পাবলিকভয়েস

মন্তব্য করুন