

হাছিব আর রহমান
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মুসলমানদের লাশ দাফন-কাফন করতে না দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মানুসারে তা পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপর। এমনকি লাশের গোছলও করাতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় গত মঙ্গলবার করোনাভাইরাস সংক্রান্ত এক নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছে যে, করোনাআক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা যে কোন ব্যাক্তির ‘শেষকৃত্য’ হতে হবে লাশ ‘দাহ্’ করা। এমনকি তারা নির্দেশিকায় আরও বলেছেন যে, মৃতব্যাক্তিকে কোনরুপ গোছল বা জানাযা পড়ানো যাবে না। যা স্পষ্টতই মুসলিম ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ।
আরও পড়ুন : করোনা আতঙ্কে হিন্দু বৃদ্ধের সৎকারে নেই স্বজনরা, শ্মশানে মুসলিম যুবক
ইসলামী ধর্মে মৃতব্যাক্তিদের লাশ দাফনের নিয়ম থাকলেও সে নিয়ম অবজ্ঞা করে শ্রীলঙ্কায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা দু’জন মুসলমানের লাশ পুড়িয়ে ফেলার পর এটি মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। অনেকে এটিকে শ্রীলঙ্কা সরকার ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের ‘ইসলামফোবিয়া’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

মুসলমানদের লাশ ‘সৎকার’ করার বিষয়টিকে ‘রেসিজম’ আখ্যা দিয়ে কার্টুন প্রকাশ করেছেন এক কার্টুনিস্ট। ছবি : টুইটার
আল জাজিরার খবরে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর ৭৩ বছর বয়সী বিশরুল হাফি মোহাম্মদ জুনুস (যিনি কোভিড -19-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন) তিনি দ্বিতীয় মুসলিম ছিলেন, যাকে ভারত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মানুসারে ‘দাহ্’ করা হয়েছিল। এর আগেও মৃত্যুবরণ করা একজন মুসলমানকে ‘দাহ্’ করা হয়েছিলো বলে জানিয়েছে তারা।
শ্রীলঙ্কা কোভিড -19 আক্রান্ত হয়ে কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ করলে তাদের লাশ ‘দাহ্’ করতে বাধ্য করার বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে সে দেশের মুসলিম কমিউনিটি এবং মানবাধিকার কর্মীরা।
তারা বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা কোন ব্যক্তির দেহ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রামিত হয় না। এবং আন্তর্জাতিক এই স্বাস্থ্য সংস্থাটি বলেছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া যে কোন ব্যক্তির লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেয়ে দাফন করা ভালো।
অধিকারকর্মী এবং মুসলিম নেতাকর্মীরা সরকারকে ডব্লুএইচও-র নির্দেশনা অবলম্বন করে ‘করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মুসলিমদের লাশ দাফনের অনুমতি দিতে’ জোর দাবি জানিয়েছেন।
শ্রীলংকায় সৎকার করা এক মুসলিমের সন্তান ‘ফায়াজ আহমেদ জানিয়েছেন, সংক্রমণের ভয়ে তারা তার বাবার জানাযা নামাজ আদায় করতে পারেননি।
“মৃত্যুর পর আমার বাবাকে পুলিশ বাহিনীর তত্ত্বাবধানে জোর করে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাকে ‘দাহ্’ করা হয়েছিল’ বলছিলেন তিনি। তবে মর্গের বাইরে আমরা বাবার লাশ কল্পনা করে জানাযা পড়েছিলাম যা আমাদেরকে ব্যথিত করেছে। ‘
‘বাবা হারানোর শোক এবং বাবাকে দাফন করতে না পারার শোক দুটোই আমাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছে’ বলছিলেন ফায়াজ। কান্নাবিজড়িত কন্ঠে তিনি বলছিলেন “আমাদের ইসলামিক দাফনের বিধি অনুসারে মুসলমানদের তাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।
তিনি আল জাজিরাকে আরও বলেন, “যদি লাশ কবরস্থ করার অন্য কোনও বিকল্প থাকে তবে আমাদের সরকারের তা ব্যবস্থা করা উচিত। দাহ্ করাই একমাত্র বিকল্প হতে পারে না, আমরা ইসলামিক পদ্ধতি অনুসারে আমাদের প্রিয়জনকে দাফন করতে চাই।”
ফায়াজ বলেছিলেন, তিনি তার মাকে বাবার মৃত্যু এবং লাশ দাহ্ করার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেননি। কারণ “তার হৃদরোগ আছে এবং তিনি এটি সহ্য করতে পারবেন না। আমরা তাই ঝুঁকি নিতে চাই না। বলেন তিনি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবাদ :
শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ ও মুসলিম নেতাদের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে জোর করে মুসলমানদের ‘শ্মশানকর্ম’ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) মহামারীজনিত কারণে মারা যাওয়া মানুষের লাশ ‘বিনাশর্তে’ দাফনের অনুমতি দেয়।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষকে মুসলমানদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুসারে “মৃতব্যাক্তির শেষকর্মের ব্যাপারে মুসলিমদের নিয়ম-নীতিকে সম্মান করার” প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক বিরাজ পট্টনায়েক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই কঠিন সময়ে কর্তৃপক্ষের উচিত সকল সম্প্রদায়কে একত্রিত করা এবং তাদের মধ্যে বিভাজনকে আরও গভীর না করা।”
তিনি আরও বলেন, “COVID-19-এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া লোকদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের প্রিয়জনদের তাদের ইচ্ছা মতো বিদায় জানানোর পথ করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব যেহেতু এটি আন্তর্জাতিক এবং ধর্মীয় সকলের কাছেই অনুমোদিত।”
মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ :
শ্রীলঙ্কার বিশিষ্ট আইনজীবী আলী সাবরি মুসলমানদের লাশ দাফনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে একটি ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন যে, এটি ডাব্লুএইচওর নির্দেশিকাগুলির স্পষ্ট লঙ্ঘণ যা একটি দেশের সরকার করতে পারে না।
অপরদিকে “মুসলিম সম্প্রদায় এটিকে চরমপন্থী বৌদ্ধ শক্তির বর্ণবাদী এজেন্ডা” হিসাবে দেখছেন বলে জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার মুসলিম কাউন্সিলের সহ-সভাপতি হিলমি আহমেদ।
তিনি বলেন, “ডব্লুএইচওর জারি করা নির্দেশিকা ব্রিটেন, বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং সমগ্র বিশ্বই অনুসরণ করছে সেখানে শ্রীলঙ্কা কেন মুসলমান উপর এই বিষয়টি জোর করে চাঁপিয়ে দিচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় এই বিষয়টিতে ‘ইসলামফোবিয়া’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা :
মৃতদেহ ‘দাহ্’ করার পদ্ধতিটি শ্রীলঙ্কায় একটি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমের একটি অংশের বিরুদ্ধে “মুসলিমবিরোধী অপপ্রচার” চালানো এবং ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য মুসলমানদের দিকে আঙুল তুলে ধরার অভিযোগ উঠেছে।
শ্রীলঙ্কায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু। সেখানের ২১ মিলিয়ন জনসংখ্যার মোট ১০ শতাংশ মুসলমান। তবে ২০০৯ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির পরের বছরগুলিতে সিংহল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। এই সময়ে কট্টরপন্থী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনাস্থলে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। তখন থেকেই শ্রীলঙ্কায় এই ‘ইসলামবিরোধী অনুভূতি’র শুরু বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
একজন গণমাধ্যম বিশ্লেষক ‘নলক গুণওয়াডেন’ বলেছেন, কোভিড -19 মহামারীর মধ্যে ইসলামবিরোধী অনুভূতি এবং মুসলিমবিরোধী বিভিন্ন ঘৃণাত্মক বক্তব্য “শ্রীলঙ্কায় আবারও ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করছে” যা খুব বিরক্তিকর ও হতাশাজনক।
তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস জাতীয় এবং বিশ্বব্যাপী একটি জরুরি অবস্থা যা বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষকেই আক্রান্ত করছে এখন এই মূহুর্তে আমাদের সাংস্কৃতিক বিভাজনকে হাইলাইট করার সময় নয়। করোনাভাইরাস আমাদের জাতিগত বা ধর্মীয় পার্থক্য সম্পর্কে চিন্তা করে না। আমাদের ভাইরাসকে ভয় করতে হবে – একে অপরকে নয় – এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তবে এসব বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যম শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সরকারী কর্মকর্তাদের মতামত নিতে চাইলে তারা সাড়া দেননি।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় এখন পর্যন্ত ১৫১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়। যার মধ্যে মারা গেছেন ৪ জন। দু’জন মুসলমান এবং দু’জন অন্য ধর্মাবলম্বী।
সূত্র : আল জাজিরা থেকে অনুবাদ