

প্রায় দু বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সদ্য সম্পাদিত হওয়া আফগান তালেবানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘যুদ্ধাবসান চুক্তি’র বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
দীর্ঘ ১৯ বছরের তালেবান-আমেরিকা যুদ্ধের ইতি ঘটিয়ে যে যুদ্ধবিরতির শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে জাতিসংঘ ও ন্যাটোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উচ্ছাসিত এবং আনন্দিত।
জাতিসংঘের মহাসচিব এই চুক্তিটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তিনি জানিয়েছে ন্যাটো তাদের ‘শান্তিচুক্তি’ বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আমেরিকা-তালেবানের দীর্ঘতম এই যুদ্ধের অবসানের জন্য ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ১৮ মাসের আলোচনার পরে কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান ও মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিরা এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনারা সরে যাওয়াসহ চারটি পয়েন্ট রয়েছে। এবং আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও আমেরিকার পক্ষ থেকে এই নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে যে, আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে আমেরিকার স্বার্থ বিঘ্নিত হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।
গতকাল শনিবার আন্তর্জাতিক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সে ব্যাপারে আল জাজিরা একটি দীর্ঘ প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। আল জাজিরা থেকে প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন পাবলিক ভয়েস টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর নির্বাহী সম্পাদক হাছিব আর রহমান।
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই চুক্তিকে আফগানিস্তানে স্থায়ী ও রাজনৈতিক সমঝোতা অর্জনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন বলে অভিহিত করেছেন এবং আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধাবস্থায় দেশটির যে ক্ষতি হয়েছে তা সংস্কার করায় জোর দিয়েছেন।
অন্তোনিও আশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এটি আফগানিস্তানে ‘স্থায়ী রাজনৈতিক সমঝোতা’ অর্জনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা। আমেরিকা এবং তালেবানের এই চুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আখ্যা দিয়ে, “জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক এক বিবৃতি দিয়েছেন।
এছাড়াও ইউএন মহাসচিব আফগান জনগণের স্বার্থে দেশব্যাপী সহিংসতা হ্রাস করাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি আফগানিস্তানের আন্তঃদেশীয় আলোচনার জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিবেশ তৈরি এবং একটি বিস্তৃত শান্তি প্রক্রিয়া তৈরির জন্য সকল পক্ষের অব্যাহত প্রচেষ্টা করার আহবান জানিয়েছেন।
কাতারের প্রতিক্রিয়া : আমেরিকা তালেবানের মধ্যে সংগঠিত হওয়া চুক্তির সর্বোচ্চ কৃতিত্বের দাবিদার দেশ কাতার তাদের প্রতিক্রিয়ায় চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল থানি বলেন, কাতার এই চুক্তি স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছে এবং তারা উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য বড় সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
চুক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি যে এই ঐতিহাসিক চুক্তিটি এ অঞ্চল ও বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখবে।
সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া : প্রতিক্রিয়া বিষয়ে এক বিবৃতিতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে_ তারা আশা করে যে এই চুক্তিটি আফগানিস্তানে একটি ব্যাপক ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও দেশব্যাপী সর্বোচ্চ শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে পরিচালিত করতে সহায়তা করবে।
ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া : আফগানিস্তানে তালেবানের সাথে যুদ্ধ করা ন্যাটোবাহিনী তাদের অফিসিয়াল বিবৃতিতে জানিয়েছেন, এই চুক্তিটিকে তারা সর্বোচ্চ স্বাগত জানায় এবং তারা ঘোষণা করেছে যে এই চুক্তির মাধ্যমেই আফগানিস্তানে ন্যাটো জোটের দীর্ঘকালীন সামরিক উপস্থিতি হ্রাস করা হবে।
ন্যাটো আরও বলেছে, এই চুক্তিটি শান্তির বিষয়ে সাম্প্রতিক অগ্রগতি, আফগানিস্তানে সহিংসতা হ্রাস ও আন্তঃ-আফগানিস্তানের আলোচনার একটি সুস্পষ্ট শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর পথ সুগম করেছে। ন্যাটো আরও বলেছে, আমরা তালেবানকে শান্তির এই সুযোগটি গ্রহণ করার আহ্বান জানাই।
নাটোর মিত্ররা আরও বলেন, আমরা এখন আফগানিস্তানে সকল সহিংসতা বন্ধ করে একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তির দিকে যাওয়ার প্রত্যাশা করি এবং যা মানবাধিকার রক্ষা করে, আইনের শাসনকে সমর্থন করে “এবং নিশ্চিত করে যে আফগানিস্তান কখনও সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহারিত হবে না।
এদিকে, ন্যাটো সেক্রেটারি-জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ এই চুক্তিকে “স্থায়ী শান্তির প্রথম পদক্ষেপ” হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, “শান্তির পথ দীর্ঘ এবং কঠোর” “আমাদেরকে অবশ্যই আঘাত পাওয়ার এবং কষ্ট সহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন যে এটি একটি ঐতিহাসিক ‘শান্তি ও পুনর্মিলন প্রক্রিয়া’ এর সূচনা।
তিনি এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘আমরা মার্কিন ও তালেবানদের মধ্যে স্বাক্ষরিত দোহা চুক্তিটিকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই এবং আফগান জনগণের কয়েক দশকের যুদ্ধ ও দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে এটি একটি শান্তি ও পুনর্মিলন প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করি। ইমরান খান বলেন, আমি সর্বদা বিশ্বাস রেখেছি যে, ‘যত জটিলই হোক না কেন শান্তির একমাত্র ও অর্থবহ পথ হলো যুদ্ধাবস্থার অবসান ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ৪ দশক ধরে রক্তপাতের শিকার হওয়া আফগান জনগণের জন্য আমার শান্তির প্রার্থনা করি এবং “এই চুক্তিটি আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে। আফগানিস্তানের যে কোন সাফল্য অর্জনে পাকিস্তান সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও জানান ইমরান খান।
তালেবানের প্রতিক্রিয়া : কাতারে তালেবান রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান মোল্লা আবদুল গণি বারদার সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে বলেছিলেন যে উভয় গ্রুপই “এই চুক্তি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।
তিনি আফগান জনগণকে লক্ষ করে বলেন, “আমি আফগানিস্তানের সকল জনগণকে সততার সাথে শান্তির জন্য কাজ করার এবং শান্তির আলোচনার জন্য এক বিন্দুতে অবস্থানের আহবান জানাই। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের পরে আফগানিস্তানে অবস্থান করা সকলকেই “ইসলামী আইনের অধীনে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন” করতে দেওয়া হবে।
আবদুল গণি বারদার আরও বলেন, “আফগানিস্তান থেকে সমস্ত বিদেশী শক্তির পুরোপুরি প্রত্যাহার এবং ভবিষ্যতে কখনই আফগানিস্তানে তাদের হস্তক্ষেপ না করার এই চুক্তি নিঃসন্দেহে একটি দুর্দান্ত ও ঐতিহাসিক অর্জন ও আফগান জনগণের বিজয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া : একটি টেলিভিশন বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তির প্রশংসা করে বলেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে “খুব কাছাকাছি সময়ে” তালেবান নেতাদের সাথে দেখা করবেন।
হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে ট্রাম্প বলেছেন, আফগানিস্তানের প্রতিবেশীদের এই চুক্তির পরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সর্বোচ্চ সহায়তা করা উচিত।
“এত বছর পরে আমাদের লোকদের ঘরে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা আমাদের লোকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই। তিনি বলেন, “আমরা সবেমাত্র চুক্তি স্বাক্ষর করেছি এবং আফগানিস্তান থেকে আমাদের সেনাদের ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আমরা এই চুক্তির বাস্তবায়ন করবো। তবে ট্রাম্প তার স্বভাবজাত বৈশিষ্টে হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, চুক্তির ব্যত্যয়ে খারাপ কিছু হলে আমরা আবার ফিরে যাব এমনকি তখন এমন শক্তি নিয়ে ফিরে যাবো আমরা যা আগে কখনও দেখেনি কেউ।
এর আগে কাতারের দোহায় এক অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তালেবানদের প্রতি সকলকে সম্মান করার আহবান জানিয়েছেন।
পম্পেও আরও বলেছিলেন, “আমি জানি বিজয়ের ঘোষণা দেওয়ার একটা প্রলোভন থাকবে, তবে আফগানদের পক্ষে জয় তখনই অর্জন করা সম্ভব হবে যখন তারা শান্তিতে ও সমৃদ্ধিতে থাকতে পারবে।
পম্পেও বলেছিলেন যে, ১১ ই সেপ্টেম্বরের আক্রমণকে তিনি এখনও স্মরণ করেন এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী অর্জন করেছে তাতে হিসেব-নিকেশের প্রয়োজন হলেও তিনি জোর দিয়েছিলেন যে আমেরিকাকে অবশ্যই তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বাস্তবতা থেকেই চিন্তা করতে হতে হবে।
চুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে আজ যে চুক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তা আমরা নষ্ট হতে দেবো না।
এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তালেবানের সাথে আমেরিকার মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোড়ালো ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে।
আমেরিকা তালেবান চুক্তি : তালেবান প্রধানের বিশেষ বার্তা
তালেবান আমেরিকা চুক্তি : বৈশ্বিক জিহাদের ঐতিহাসিক বিজয়
গুয়ান্তানামো কারাগারে বন্দি থাকা সেই ৫ তালেবান নেতাও আছেন শান্তি আলোচনায়
এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস