বাবরি মসজিদ মামলার রায়ের কিছু পয়েন্ট : যা বললেন মাহমুদ মাদানী

প্রকাশিত: ৫:১১ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০১৯

বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় সম্পর্কে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে এটিকে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে অন্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ভারতীয় মুসলমানদের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন জমিয়তে উলামা হিন্দের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা সাইয়্যিদ মাহমুদ মাদানী।

রোববার ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ের ভিত্তি বিচারহীনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাবরি মসজিদ বিষয়ে সত্য ও বাস্তবতা উপেক্ষা করে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বৈষম্যমূলক রায় দিয়েছে। ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশে মাহমুদ মাদানী বলেন, আগামীতে মিথ্যা সান্ত্বনায় নিশ্চিন্ত হওয়ার মাশুল স্বরূপ আরও বড় বিপদ মোকাবেলা করার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাওলানা মাহমুদ মাদানি আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্টের এ রায় ও বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতি মুসলমানদের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষার সময়। এজন্য আমাদের জরুরি কর্তব্য হচ্ছে,সবর ও ধৈর্যের মাধ্যমে পরিবেশ পরিস্থিতির মোকাবেলা করা এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা।

বাবরি মসজিদ মামলায় সুপ্রিমকোর্টের ‘বিতর্কিত’ রায়ে সাইয়্যেদ মাওলানা মাহমুদ মাদানি দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর সমালোচনা ও তীব্র নিন্দা জানান।তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের মহামান্য পাঁচ বিচারপতি তাদের রায়ে একদিকে বাবরি মসজিদের ভেতরে মূর্তি স্থাপন করা, অতঃপর পুনরায় তা ভাঙার বিষয়টিকে ভুল এবং অন্যায় আখ্যা দিয়েছেন, অপরদিকে মসজিদের জায়গা ওইসব লোকদের দিয়ে দিয়েছেন যারা অত্যন্ত অন্যায়ভাবে মসজিদকে শহীদ করেছিল।

তিনি আরো বলেন, এটি একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিখুঁত ঘোর বৈষম্য। এই রায়ের মধ্যদিয়ে আদালতের ওপর থেকে সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস উঠে গেছে এবং তাদের সঙ্গে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে অবিচার করা হয়েছে। মাওলানা মাদানী বলেন, দেশ যখন স্বাধীন হয় এবং যখন দেশের সংবিধান তৈরি করা হয়, ওই সময়ও এখানে মসজিদ ছিল, বংশপরম্পরায় মানুষ দেখে আসছে যে,এখানে একটি মসজিদ ছিল এবং মানুষ মসজিদে নামাজও পড়তো।

কিসের ভিত্তিতে আদালত এই বিতর্কিত রায় দিলো? জানা যায় অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের নিচে ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় হাজারবার খুঁড়েও কোনো মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ওই এলাকায় বেশ কয়েকবার খোঁড়াখুঁড়ি চালানো হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকই মন্দির পাননি।

এমনকি সর্বশেষ ভারতের প্রত্নতত্ব বিভাগ ‘দ্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র (এআইএ) প্রত্নতাত্ত্বিক খননেও কোনো মন্দির মেলেনি। অথচ কেবল বিশ্বাসের ওপর ভর করে বির্তকিত সেই স্থানে মন্দির নির্মাণের নির্দেশনা দিয়ে রায় দিল ভারতের সুপ্রিমকোর্ট।

এদিকে এ রায় ঘোষণার পর যে নামটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন তিনি হলে কারিঙ্গামান্নু কুঝিয়ুল মুহাম্মদ। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনরা তাকে ‘কেকে’ নামে ডাকেন। তিনি একজন ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানে মন্দির বানানোর পক্ষে সুপ্রিমকোর্ট শনিবার যে রায় দিয়েছেন, তার পেছনে এই প্রত্নতাত্ত্বিকের দেয়া রিপোর্টটির বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।

বিবিসি জানিয়েছে, কে কে মুহাম্মদের অধীনে করা ওই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা মেনে নেন যে, বাবরি মসজিদের স্থাপনার নিচে বহু পুরনো আরো একটি কাঠামোর ছিল। যে কাঠামো ‘ইসলামিক কাঠামো’ নয়। এ বিষয়ে কে কে মুহাম্মদের দাবি, বাবরি মসজিদের নিচে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ত্ব ছিল।

বস্তুত ওই রিপোর্টেই প্রথম স্পষ্টভাবে দাবি করা হয়েছিল, বাবরি মসজিদ চত্ত্বরে মসজিদ প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ত্ব ছিল। এদিকে কে কে মুহাম্মদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে তিরস্কৃত করছেন ভারতের মুসলিমরা। একজন মুসলমান হয়ে কী করে বাবরি মসজিদের নিচে মন্দির ছিল বলে যুক্তি দিয়ে গেছেন কে কে মুহাম্মদ, তা ভাবতেই পারছেন না ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।

যদিও সেদিকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছেন না কেকে মুহাম্মদ। বরং এই রায়ে তার রিপোর্টটিকে চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেয়ায় নিজেকে ধন্য মনে করছেন কে কে। একে জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সম্মান’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় কে কে মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এটা একেবারে সঠিক বিচার। আমি মনে করি, এর চেয়ে ভালো রায় আর কিছুই হতে পারে না। এ রায়ের মধ্যে দিয়ে আমার দীর্ঘদিনের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও পরিশ্রমই স্বীকৃতি পেল।’

বাবরি মসজিদের নিজে মন্দির ছিল এমন বক্তব্যের পেছনে বেশ কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছিলেন কে কে মুহাম্মদ। ভারতের একটি গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বাবরি মসজিদ চত্বরে খোঁড়াখুঁড়িতে ‘মন্দির প্রণালী’, ‘অভিষেক পানি’ বা ‘কুমির প্রণালী’র মতো বিভিন্ন চিহ্ন বা স্মারক দেখা যায়। আর এগুলো তো হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয়েই থাকে। কুমির প্যাটার্নের ওই ধরনের স্থাপনা কখনও মসজিদে থাকে না। তাছাড়া মানুষ ও পশুপাখির বহু টেরাকোটা মোটিফও আমরা সেখানে পেয়েছিলাম, যেগুলো মুঘল আমলের কোনো মসজিদে কখনওই দেখা যায় না।’

তবে কে কে মুহাম্মদের ওই প্রতিবেদনকে ভুল বলে দাবি করেছেন ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের মধ্যে অন্যতম ইতিহাসবিদ আরফান হবিব। সেসব দাবি অনুযায়ী এটাই প্রমাণিত যে, বাবরি মসজিদের নিচে প্রাচীন কাঠামো থাকলেও তা হিন্দু ধর্মীয় কোনো মন্দির ছিল না। এমন রায়ের পর কে এই কারিঙ্গামান্নু কুঝিয়ুল মুহাম্মদ, সে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের কেরালা রাজ্যের কালিকটের বাসিন্দা তিনি। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করা প্রত্নতত্ত্ববিদ।

১৯৭৬ সালে বাবরি মসজিদকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হলে তখন র্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। সেই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ড. বি বি লাল। তার অধীনেই একজন তরুণ গবেষক হিসেবে যোগ দেন এই কে কে মুহাম্মদ। ৪৩ বছর ধরে এই বিষয়ে গবেষণা করার পর উত্তর ভারতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আঞ্চলিক অধিকর্তা হিসেবে অবসর নেন কে কে মুহাম্মদ। এই সময়ের মধ্যে বাবরি মসজিদ নিয়ে যে রিপোর্টটি তৈরি হয় তার মূল প্রণেতা হলেন কে কে মুহাম্মদ। প্রত্নতত্ত্বে অবদানের জন্য চলতি বছর ভারত সরকার তাকে বেসামরিক খেতাব পদ্মশ্রীতে ভূষিত করেছে।

জানা গেছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ ভারত সফরে গেলে তাকে আগ্রাসহ তাজমহল ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল কে কে মুহাম্মদের ওপর। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারত সফলে এলে তারও ‘ট্যুর গাইড’ ছিলেন তিনি।

কে দিয়েছেন রায়? অপরদিকে ঐতিহাসিক ও স্পর্শকাঁতর এই মামলার রায় দিয়েছেন একজন বিতর্কিত বিচারক। যিনি অনেক আগেই যৌন কেলেঙ্কারীর মত অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। ‘যৌন কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছেন ভারতের প্রধান বিচারপতি’ চলতি বছরের এপ্রিলে এমন শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছিল ভারতসহ আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে। আর সেই গুরুতর দোষে অভিযুক্ত বিচারপতি আর কেউ নন, বাবরি মসজিদের রায় ঘোষণাকারী বিচারপতি রঞ্জন গগৈ।

সে সময় উৎসব সিং বাইন্স নামের এক আইনজীবী রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযোগ আনেন। গত ২৫ এপ্রিল ভারতের সুপ্রিমকোর্টে এক হলফনামায় তিনি এই অভিযোগ করেন। রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেন সুপ্রিমকোর্টের ৩৫ বছর বয়সী এক সাবেক নারী কর্মী। তিনি প্রধান বিচারপতির বাড়ির অফিসে জুনিয়র কোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। তার অভিযোগ, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে গগৈ তাকে যৌন হেনস্তা করেছেন।

প্রতিবাদ করায় তাকে প্রথমে ওই অফিস থেকে সরিয়ে দেয়া হয়, পরে চাকরি থেকেও। এই অভিযোগ জানিয়ে ওই নারী সুপ্রিম কোর্টের ২২ জন বিচারপতির কাছে হলফনামা পেশ করেন। যৌন কেলেঙ্কারীর বিষয়টি অস্বীকার করে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে বড় কোনো শক্তি এই চক্রান্ত করেছে বলে দাবি করেন বিচারপতি গগৈ। আর সেই বিচারকের কলমেই শনিবার ঘোষিত হলো হাইপ্রোফাইল বাবরি মসজিদ রায়।

কে এই বিচারপতি রঞ্জন গগৈ? ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ৪৬তম প্রধান বিচারপতি তিনি। তবে বাবরি মসজিদের রায় দিয়েই অবসরে যাচ্ছেন এই বিচারপতি। আগামী ১৭ নভেম্বর অবসর নেবেন তিনি। রঞ্জন গগৈয়ের জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৮ নভেম্বর আসামের ডিব্রুগড়ে। তার বাবা কেশবচন্দ্র গগৈ ১৯৮২ সালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হন।

দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন গগৈ। ১৯৭৮ সালে বার কাউন্সিলে যোগ দেন। ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই হাইকোর্টেরই স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে যোগ দেন। ২০১২ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। তার ছয় বছর পর ২০১৮ সালে দীপক মিশ্র অবসর নেয়ার পর তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন।

সূত্র : যুগান্তর, বিবিসি বাংলা, আনন্দবাজার

মন্তব্য করুন