

ভিনদেশে গিয়ে নিজ দেশের নাক কেটেছেন। ভিনদেশি মোড়লের কাছে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ক্ষুন্ন করেছেন দেশের সুনাম। দেশ জুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে সর্বমহলে। যেই সংগঠনের নাম ব্যবহার করে মার্কিন মুল্লুকে গিয়েছিলেন সেই ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ এর কেন্দ্রীয় নেতারাও তার বক্তব্যের সমালোচনা করছেন।
প্রিয়া সাহার নিন্দিত বক্তব্যের সমালোচনা করছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী থেকে শুরু করে তার নিজ এলাকার স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনও। ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যও। মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে কতটা নির্লজ্জভাবে নিজ দেশে ভাবমূর্তি নষ্ট করার পায়তারা করেছেন, দেশের বিরুদ্ধে বিশ্বের চরম আগ্রাসী দেশের উদ্ভট মস্তিস্কের প্রেসিডেন্ট এর কাছে গিয়ে দয়া ভিক্ষা চেয়েছেন, সাহায্য চেয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন নিজের জন্মভূমিকে; অথচ এরপরও নেই কোনো অনুশোচনা।
নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত না হয়ে বরং চরম দাম্ভিকতার সাথে নিজের বক্তব্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে কৌশলে অনেকটা দোষ চাপানোর মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে উদ্ভট বক্তব্য দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন দেশের প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ ও গবেষক অধ্যাপক আবুল বারাকাতের ওপর। এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমেরিকা থেকেই ভিডিও বার্তায় প্রিয়া দাবি করেন, অধ্যাপক আবুল বারাকাতের দেয়া তথ্যমতে তিনি এ কথা বলেছেন। যা সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোতেও আছে। নিজেকে অধ্যাপক বারাকাতের সহযোগী বলেও দাবি করেন প্রিয়া।
এদিকে প্রিয়ার এ দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছেন অধ্যাপক আবুল বারাকাত। তিনি বলেছেন, ‘আমার গবেষণায় যা আছে তা হলো- আমার হিসেবে প্রায় পাঁচ দশকে (১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত) আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন (উৎস: আবুল বারকাত, ২০১৬, বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃ:৭১)। অর্থাৎ আমি কোথাও ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন-এ কথা বলিনি। উপরন্তু তিনি কোথাও বললেন না যে, আমার গবেষণা তথ্যটির সময়কাল ৫০ বছর(১৯৬৪-২০১৩)’।
অধ্যাপক বারাকাত আরো বলেন, ‘প্রিয়া সাহা কখনোই আমার সহ-গবেষক, গবেষণা সহযোগী অথবা গবেষণা সহকারী ছিলেন না। আমি ২০১১ সালে সরকারি আদম শুমারির তথ্যের ভিত্তিতে ১৯০১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট জনসংখ্যায় বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার উল্লেখ করেছি মাত্র। একজন সমাজ গবেষক হিসেবে আমি নিশ্চিত হতে চাই যে, প্রিয়া সাহা আমার নাম উল্লেখপূর্বক যেসব বিভ্রান্তিমূলক ও নীতি গর্হিত বক্তব্য দিয়েছেন তিনি অতি দ্রুত তা প্রত্যাহার করবেন’।
দেশের এই অর্থনীতিবিদকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য যাই হোক দিয়েছেন। তারচে বড় কথা হলো- সবচে স্পর্ষকাতর এবং গুরুতরভাবে নিজের অন্যায় কাজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে প্রিয়া দৃষ্টান্ত টেনেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িযে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর ৯৪ দিন ধরে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছিলো। সে সময় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরেছিলেন। সব জায়গায় বক্তব্য দিয়েছেন। আমি তার কথায় অনুপ্রাণিত। যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধ কথা বলা যায় আমি তার থেকে শিখেছি।
প্রিয়া আরো বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সফলতা দেখিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই আমি চেয়েছি, মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের সরকার একসঙ্গে কাজ করুক যাতে দেশে মৌলবাদের উত্থান না হয়। বাংলাদেশ মৌলবাদের কবলে না পড়ে, একসঙ্গে কাজ করতে পারে সেজন্য আমি মার্কিন প্রশাসনকে এ কথা বলেছি’।
একে তো প্রধানমন্ত্রীর ওপর মিথ্যারোপের মতো ধৃষ্টতা এবং অধ্যাপক আবুল বারাকাতের গবেষণার তথ্য বিকৃতি। তার ওপর দাবি করছে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে মৌলবাদ বিরুধী যুদ্ধ করার হুমকি। এটা হুমকি এজনই যে, মার্কিন প্রশাসন যেখানে নাক গলাবে সেখানে কী হতে পারে তা বিশ্ববাসী আন্দাজ করতে পারে খুব সহজেই। সম্প্রতি মিয়ানমারকে বাংলাদেশের করার প্রস্তাব প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ বিষয়ে বলেছিলেন এক সংবাদ সম্মেলনে। তার ওপর আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কতটা ভয়ঙ্কর ও উর্বর মস্তিস্কের পাগল সেটা তাবত পৃথিবীর মানুষ জানে। এ অবস্থায় নিজের অবস্থানে অটল থেকে ফের মার্কিন প্রশাসনকে নিয়ে মৌলবাদ বিরুধী যুদ্ধ করার কথা পুনর্ব্যক্ত করা দেশের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন হুমকি বলেই মনে করে দেশের সচেতন মহল।
তার এমন অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করছেন জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্যিক, সরকারি, চুকুরে, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আলেম ওয়ায়েজ, বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে একজন সাধারণ ফেসবুকারও। প্রায় সবার ভাষ্যই হলো প্রিয়া নিজের অপরাধকে লঘু করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অধ্যাপক আবুল বারাকাতের মতো বিশিষ্ট গবেষককে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধম্যে, লেখক, আলোচক ও প্রখ্যাত তরুণ আলেম, জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ বলেন, ‘প্রিয়া সাহা প্রথমত: চরমভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে রাষ্ট্রকে ছোট করেছে। দ্বিতীয়ত: মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সাহায্য চেয়ে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে, তৃতীয়: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বক্তব্য দিয়ে নিজের অপরাধ ঢাকতে চেয়ে প্রকারান্তে প্রধানমন্ত্রীকে অবমূল্যায়ন করেছেন। পরোক্ষভাবে সংখ্যালঘু রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর অতিত আন্দোলনকে নিজের অপকর্মের সাথে তুলনা করে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তার এহেন দৃষ্টতা পুরো বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। এর জন্য তাকে জবাবদিহিতার আওয়াতায় এনে রাষ্ট্রীয় আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত’।
জনপ্রিয় লেখক ও বিশ্লেষক, পিনাকী ভট্টাচার্য নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে এনিয়ে বিস্তর আলোচনায় বলেন, প্রিয়া সাহার অভিযোগ তো সত্য। হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে। কিন্তু কথা হলো যখন নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠী উল্লেখ্য করে অর্থাৎ বলা হবে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে তার মানে তখন এটা বুঝা যায় যে, এদেশে অন্য কোনো জাতি গোষ্ঠীর লোক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। অথচ নির্যাতন হচ্ছে সবাই। সংখ্যাগুরু মুসলিমরাও নির্যাতন হচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড় হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশনের ঘটনা হচ্ছে ক্রস ফায়ারে বিচার বহির্ভূত মৃত্যু। ২০১০-২০১৮ সালে ক্রসফায়ারে দেশে মোট মৃত ১৭৬৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের। অর্থাৎ, ক্রসফায়ারের ভিকটিমদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা ০.০৫%-এর কাছাকাছি বাংলাদেশে, যেখানে জনসংখ্যার অন্ততঃ ১০% হিন্দু’।
এদিকে, ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবী করেছে ২০১৯ সালের প্রথম চার মাসে ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী। ওই একই সময়ে বাংলাদেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৩৯৬ নারী ও শিশু। তার অর্থ, ধর্ষণের শিকার যারা তাদের মধ্যে আন্দাজ ২% হলো হিন্দু’। এর মানে হলো- ‘সংখ্যাগুরু মুসলমানেরা বেশী সংখ্যায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশে’ বলছিলেন পিনাকী।
‘হিন্দু নির্যাতন’ ডিফাইন এবং আলাদা ব্যাখ্যা করা রাষ্ট্রগঠনের সমস্যা কিনা প্রশ্ন তুলে পিনাকী বলেন, ‘হিন্দুরা হিন্দু পরিচয়ে বিশেষ সুরক্ষার দাবী না তুলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক পরিচয়ে ‘হিন্দু অধিকারের’ বদলে নাগরিক অধিকারের জন্য যতক্ষণ লড়াই না করতে পারবে ততদিন এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই’।
/এসএস