

শাহনূর শাহীন:
দীর্ঘ ৯ বছর দেশ শাসন করেছিলেন এক সময়ের সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৫২ সাল থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং একই বছরের ডিসেম্বরে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব বুঝে নেন এরশাদ। ১৮৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ক্ষমতায় আসে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন এরশাদ। ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি করেন বিচারপতি আ ফ ম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে। এরপর ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ নিজে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং দলীয় মনোনয়নে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এরশাদ।
১৯৮৩ সাল থেকেই এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। খালেদার নেতৃত্বে ৭ দলীয় ঐক্যজোট তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে এরশাদের বিরুদ্ধে। এই সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল যৌথভাবে খালেদা জিয়ার সাথে ঐক্যবদ্ধ পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন করে। ৮৬ সালে নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে (২১ মার্চ) এরশাদের অধিনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। এ ঘোষণা বয়কট করে হাসিনা নেতৃত্বাধীন ৫ দল। নির্বাচন বয়কট করে খালেদার সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামে তারা। পরবর্তীতে ৮৭ সাল থেকে ‘এরশাদ হটাও’ এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা। দীর্ঘ আন্দোলনে এরশাদ সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এরপর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। খালেদা জিয়া হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দূর্নীতির মামলা হয়। কিছু মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত হন এরশাদ। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর খালেদা জিয়ার ৯৬ এর দ্বিতীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়ে শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন এরশাদ। কারারুদ্ধ থাকাকালীন নির্বাচনে অংশ নিয়ে রংপুর থেকে ৫টি আসনে জয়ী হয় এরশাদ। এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়াী লীগ। প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এরপর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারামুক্তি পান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
কারাগারে থাকাকালীন কারাগারে বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগান এরশাদ। ওই সময় কারাগার অভ্যন্তরে একটা বরই গাছ লাগিয়েছিলেন এরশাদ। জনশ্রুতি আছে এরশাদ সেসময় কারাগারের জেলার, সুপারভাইজার সহ সবাইকে বলেছিলেন, এই গাছে যখন ফল হবে তখন খালেদা জিয়া জেল খাটবেন। তখন তিনি এই বরই গাছের ফল খাবেন।
- জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ ও ৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন খালেদা জিয়া। অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে খালেদার সাজা বেড়ে ৫ থেকে ১০ বছর হয়। দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার জায়গা হয় পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। একসময় এই কারাগারেই ছিলেন এইচ এম এরশাদ।
খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর সংসদে এ বিষয়ে কথা বলেন সিলেট-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নির্বাচিত ইয়াহইয়া চৌধুরী। সংসদে তিনি বলেন, ‘বেগম জিয়া একদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে বিনা অপরাধে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই জেলখানায় এখন খালেদা জিয়া! ২৮ বছর আগে কারাগারে থাকা অবস্থায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি বরই গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছে এখন বরই ধরেছে। কারাবিধান অনুযায়ী, এই বরই খাওয়া যাবে কিনা জানি না। সুযোগ থাকলে খালেদা জিয়াকে সেই বরই খেতে দেওয়া হোক’।
তবে খালেদা জিয়াকে সেই গাছের বরই খেতে দেয়া হয়েছিলো কিনা কিংবা আদৌ সেই গাছের অস্তিত্ব আছে কিনা সেটা জানা না গেলেও স্বয়ং এরশাদও বিষয়টা অস্বীকার করেছেন। এরশাদ তার নিজ এলাকা রংপুর সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ওটা আমি ঠাট্টা করেছি। রোপন করা সেই কথিত বড়ই গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। কোন রুমে ছিলাম মনে নেই’।
ঠাট্টা হোক আর যাই হোক এরশাদ এর কথায় এটা স্পষ্ট ছিলো যে, তিনি সেসময় জেলারদের সামনে তার সেই আলোচিত বক্তব্য দিয়েছিলেন। মানুষ মরে যায় কিন্তু ইতিহাস রয়ে যায়। কথা বলে নতুন করে। ইতিহাস নতুনভাবে আলোচিত হয়ে ওঠে নিত্য নতুন ঘটনা-অনুঘটনা ও উপলক্ষ্যেকে কেন্দ্র করে। অতঃপর এভাবেই আলোচিত হয়। স্মরণ করিয়ে দেয় পেছনের অতিত।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, পাবলিক ভয়েস
/এসএস