চাঁদ দেখা কীভাবে নিশ্চিত করে জাতীয় কমিটি? এবার কেন ব্যর্থ হলো?

প্রকাশিত: ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ৫, ২০১৯

প্রশ্ন এটাও যে- ব্যর্থতা আসলে কার? জাতীয় কমিটির নাকি আবহাওয়া স্টেশনের কিংবা জেলা কমিটির। তথ্য সরবরাহ বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা যারই হোক দায়ভার জাতীয় কমিটিকেই নিতে হবে। এবং বিষয়টি তদন্ত করে এ ব্যাপারে জটিলতা নিরসন করে পুরো ব্যাপারটিকে খোলাসা করতে হবে।


সোমবার সন্ধায় জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠক হয় বাইতুল মোকারমে ইসলামী ফাউন্ডেশনে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের আকাশে কোথায় শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি সুতরাং বৃহস্পতিবার ঈদুুল ফিতর উদযাপন করা হবে।

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এই ঘোষণা দেরি হওয়ায় সারাদেশে তারাবী নামাজ পড়া না পড়া নিয়ে ইমাম-মুসুল্লিরা, দ্বিধা-দ্বন্ধে ভোগে। কোথাও কোথাও এশার নামাজ পড়েই মুসুল্লিরা চলে গেছেন যে যার মতোই।

কেননা, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রচ্যের প্রায় অনেক দেশেই আজ মঙ্গলবার ঈদ উদযাপন হয়েছে। সৌদি আরবে যেহেতু আজকে ঈদ হয়েছে অনুমিতভাবেই সবার ধারণা আগামীকাল বাংলাদেশে ঈদ হবে। এটাই দেখে আসছে মানুষ যুগ ‍যুগ ধরে।

আকাশে চাঁদ ওঠা এবং সেটার স্থায়ীত্বের উপর নির্ভর করে সময়ের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে বাংলাদেশের চাঁদ দেখায় একদিনের ব্যবধান হয়ে থাকে। যদি এই ব্যবধানটা তৈরি হয় সামান্য সময়ের জন্যই। আর এমনটাই হয়ে আসছে প্রতিবছর।

দেখা যায় সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেলে পরেরদিন বাংলাদেশের আকাশে খালি চোখে না হলেও আবহাওয়া স্টেশন থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে চাঁদ দেখা যায়। সারাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা ভিত্তিক চাঁদ দেখা কমিটি খালি চোখে চাঁদ দেখার খবর পেলে জাতীয় কমিটিকে অবহিত করে।

এছাড়া আবহাওয়া অধিদফতরের ৭৪টি স্টেশন থেকেও তথ্য নেয় চাঁদ দেখা কমিটি। এরপরই চাঁদ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত হলে জাতীয় কমিটি তা ঘোষণা দেয়। নিয়ম অনুযায়ী এবারও তাই হয়েছে। কিন্তু ফলাফল খুবই বাজেভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে সারাদেশে।

জাতীয় চাঁদ দেখো কমিটির কাজ কী?

প্রত্যেক আরবাী মাসের সম্ভাব্য শেষ দিনে অর্থাৎ ২৯ এবং ৩০ তারিখে বৈঠকে বসে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। ২৯ তারিখে দেশের কোথাও চাঁদ দেখার খবর পাওয়া গেলে পরেরদিন থেকে নতুন মাস গণনার ঘোষণা দেওয়া হয়। নুতবা ৩০ দিন পূর্ণ করে পরবর্তী বৈঠকে নতুন মাসের ঘোষণা করা হয়।

সারাবাছর এই কাজটি হাঁকডাক ছাড়া হয়ে গেলেও শাবান এবং রমজান মাসে বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এসময় মিডিয়া সংবাদকর্মী থেকে শুরু  সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষ তাকিয়ে থাকে এই কমিটির দিকে।

চাঁদ দেখার মূল দায়িত্ব পালন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দীনি দাওয়াত ও সস্কৃতি বিভাগ। বিভাগটির বর্তমান পরিচালক মোজাহারুল মান্নান। মোজাহেরুল মান্নান জানান, এই বিভাগের পরিচালনায় ধর্মমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় চাঁদ দেখো কমিটি থাকে। কমিটির সদস্য সচিব থাকেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক।

তিনি জানান, চাঁদ দেখার জাতীয় কমিটির পাশাপাশি সারাদেশে জেলা ভিত্তিক একটি করে কমিটি থাকে। জাতীয় কমিটি সারাদেশে জেলা কমিটি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা গেলে জেলা কমিটি দ্রুত সময়ে সেটি জাতীয় কমিটিকে অবহিত করে থাকে।

স্থানীয় অনেকে চাঁদ দেখেছে কি-না কিংবা স্থিরচিত্র বা ভিডিও চিত্র এসব দ্রুত সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়ে থাকে স্থানীয় প্রশাসন। এসবের পরেই তারা জাতীয় কমিটিকে তথ্য সরবরাহ করে। একই সাথে সারাদেশে ৭৪টি আবহাওয়া স্টেশন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জাতীয় কমিটি।

মোজাহেরুল মান্নান বলেন, ‘চাঁদ উঠলে সেটি কোথাও না কোথাও দেখা যায় সাধারণত। মানুষের চোখে বা মেশিনের (আবহাওয়া স্টেশনের) সাহায্যে এটি নিশ্চিত হলেই কেবল ঈদ উদযাপনের ঘোষণা দেয়া হয়’ (বিবিসি বাংলা ১৩ জুন ২০১৮)।

আবহাওয়া অধিদপ্তর যেভাবে অংশ নেয় চাঁদ দেখায়

চাঁদ উঠলে সেটি কোথায় কত ডিগ্রিতে অর্থাৎ তার অবস্থান কি হবে এবং কতক্ষণ সময় ধরে দেখা যেতে পারে সেজন্য আবহাওয়া অফিসের একটি বিভাগ আগে থেকেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই হিসেব নিকেশ করে স্টেশনগুলোকে জানিয়ে থাকে।

তার ওপর ভিত্তি করে সবগুলো স্টেশন কাজ করে এবং সম্ভাব্য সময়টিতে সম্ভাব্য স্থানে খালি চোখে ও যন্ত্রের সাহায্যে দেখা হয়। বিবিসি বাংলাকে এমনটিই জানিয়েছেন ঢাকা আবহাওয়া অফিসে কর্মরত আবহাওয়াবিদ আয়েশা খাতুন।

তিনি জানান, যেহেতু একটি নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হতে বেশ কিছুক্ষণ (প্রায় ৩০ ঘণ্টাও হতে পারে) সময় লাগে সেক্ষেত্রে যন্ত্রের সাহায্য নেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি এও জানান অপটিক্যাল থিওডিলাইট নামক একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ দিয়ে আবহাওয়া স্টেশনগুলো কাজ করে থাকে।

‘তবে চাঁদ উঠলে সেটি কোথাও না কোথাও খালি চোখে না হলেও টেলিস্কোপে ধরা পড়বেই। আর সেটি দেখা মাত্রই আবহাওয়া বিভাগ সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিয়ে থাকে’ বলে দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ আয়েশা খাতুন (সূত্র: বিবিসি বাংলা ১৩ জুন ২০১৮)।।

এবার কেন ব্যর্থ হলো? এই দায় কার?

নিয়ম অনুযায়ী এবারই নিশ্চয়ই ধারাবাহিকভাবে এই কাজটি করেছে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। কিন্তু শুরু থেকেই জাতীয় কমিটি একটি বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলো।

প্রতিবছর ২৯ রোজা শেষে জাতীয় কমিটির ঘোষণা দিকে তাকিয়ে থাকে সারাদেশের মুসুল্লিরা। কেন্দ্রীয়ভাবে ঘোষণা হলেই মিডিয়া মারফত খবর পেয়ে ৩০তম তারাবী অথবা এশার নামাজ পড়ে ঈদের প্রস্তুতি নেয় দেশবাসী।

এবারই সেরকমই দেশবাসী তাকিয়েছিলো জাতীয় কমিটির দিকে। কিন্তু বরাবরের মতো ধারাবহিকতা লঙ্ঘন করে অধিক সময় নেয় জাতীয় কমিটি। এশার নামাজ শুরুও প্রায় ২০মিনিট পর জাতীয় কমিটি ঘোষণা দেয় দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে কোথাও তারাবীর নামাজ পড়া হয় কোথাও আবার এশার নামাজ শেষে মুসুল্লিরা বিদায় নেয়।

কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। এরইমধ্যে মাদারীপুর ও লালমনিরহাটে চাঁদ দেখা গেছে এমন খবর ভাইরাল হতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

মাদারীপুর থেকে একজন মাদরাসা শিক্ষক তার মাদরাসার ছাত্র ও ৬জন মুসুল্লিসহ চাঁদ দেখার কথা ঘোষণা দেয়। এবং তিনি এলাবাসীকে বুধবার ঈদ উদযাপনের নির্দেশ দেন।

লালমনিরহাট থেকেও বিশ্বস্ত সুত্রে চাঁদ দেখার কথা জানা যায়। দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর। এরপর বাংলাদেশের অন্যতম দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাটহাজারী মাদরাসায় এ নিয়ে বৈঠক হয়।

বৈঠকে মাদারীপুর ও লালমনিরহাটে চাঁদ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ঈদ উদযাপনের ঘোষণা দেয়। এর আগে দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ দরবার ও মাদরাসা চরমোনাই জামিয়া কর্তৃপক্ষও মাদারীপুরে চাঁদ দেখার সত্যতা জেনে ঈদের ঘোষণা দেয়।

এরমধ্যে খবর আসতে থাকে কুড়িগ্রামেও কোথাও কোথাও চাঁদ দেখা গেছে। এরপরই রাত প্রায় সোয়া ১১টায় ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভাপতি শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে বলে ঘোষণা দেন। এসময় তিনি জানান, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন থেকে চাঁদ দেখার কথা জানানো হয়েছে।

প্রশ্ন হলো লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন যদি নিশ্চিত করেই থাকেন তবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কী করেছে? বর্তমান যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে এই খবরটি জাতীয় কমিটিকে জানাতে তো এতো সময় লাগার কথা না। কেননাম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তথ্য সরবারহ করা তো প্রত্যেক জেলা কমিটিরই দায়িত্ব। কিন্তু তারা কী করেছে? কেন তারা ব্যর্থ হয়েছে?

আবহাওয়া অধিদপ্তর সারাদেশের ৭৪টি আবহাওয়া স্টেশন থেকেও জাতীয় কমিটি তথ্য নিয়ে থাকে। আবহাওয়া বিভাগ এটা দিতে বাধ্য। বরাবরই তারা এটা করে থাকে। কিন্তু এবার কেন পারলোনা? এবার কি তারা দায়িত্ব পালন করেনি? আবহাওয়া স্টেশনগুলো কি বন্ধ ছিলো?

যদি তাই না হয় তাহলে কেন তারা চাঁদ দেখার তথ্য দিতে পারেনি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও আবহাওয়া স্টেশন থেকে  টেলিস্কোপ দিয়ে তো চাঁদ দেখতে পাওয়া কিংবা চাঁদ উঠেছে কিনা সেই তথ্য জানার কথা।

কিন্তু এবার কেন তারা চাঁদ দেখার তথ্য দিতে পারলো না এই প্রশ্নটি এখন বড় করে দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন এটাও যে- ব্যর্থতা আসলে কার? জাতীয় কমিটির নাকি আবহাওয়া স্টেশনের কিংবা জেলা কমিটির।

তথ্য সরবরাহ বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা যারই হোক দায়ভার জাতীয় কমিটিকেই নিতে হবে। এবং বিষয়টি তদন্ত করে এ ব্যাপারে জটিলতা নিরসন করে পুরো ব্যাপারটিকে খোলাসা করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

/এসএস

মন্তব্য করুন