

শীর্ষ তিন গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঝুঁকিতে পড়বে ২২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি ছয়টি ব্যাংক লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা হারাবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৮ পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ২২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। এতে ব্যাংকিং খাতের মূলধন সক্ষমতার সূচক (ক্যাপিটাল এডুকেসি) ১০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশে নেমে আসবে।
যদি সাত শীর্ষ গ্রহীতা ঋণ পরিশাধে ব্যর্থ হন তাহলে ন্যূনতম সক্ষমতার হার নেমে আসবে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশে। প্রতিবেদন অনুসারে, ১০ শীর্ষ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ন্যূনতম সক্ষমতার হার হবে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে। বর্তমানে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন (সিআরএআর) ১০ শতাংশ রাখার বিধান থাকলেও ব্যাংকগুলো ১০ দশমিক ৫ শতাংশ হারে রাখছে।
শীর্ষ গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা নিরূপণে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সহনক্ষমতা পরীক্ষা (স্ট্রেস টেস্টস) করেছে, তাতে এমন চিত্র উঠে এসেছে। যদিও প্রতিবেদনে শীর্ষ ঋণগ্রহীতা কিংবা কোনো ব্যাংকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোনো ব্যাংক যদি মূলধন সক্ষমতার হার পরিপালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এজন্য মূলধন সক্ষমতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তারা জানান, এই পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, ব্যাংকের সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশই কয়েকজন ব্যক্তি বা গ্রুপের কাছে ঋণ হিসেবে গচ্ছিত রয়েছে। ওইসব ঋণগ্রহীতারা যদি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে পুরো দেশের বাংকিং খাত ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ও ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা আবশ্যকীয় ন্যূনতম হারের চেয়ে বেশি। ব্যাসেল-৩ মূলধন কাঠামোর আওতায় ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফারের (সিসিবি) নির্ধারিত মাত্রা ১ দশমিক ৮৭৫ এর বিপরীতে ব্যাংকিং খাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ সংরক্ষণ করেছে।
গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং খাতে ২০১৮ সালে মোট শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ ও প্রকৃত শ্রেণিকৃত ঋণের (রক্ষিত প্রভিশন সমন্বয়ের পর) হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট শ্রেণিকৃত ঋণের হার ৬০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে দেওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের সম্পদ ১১ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে ঋণ বেড়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। একই সময়ে আমানত ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আমানতের তুলনায় ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাংকিং খাতে তারল্য সংকট দেখা দেয়, যা এখনো রয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের মধ্যে এখনো ১৪টি ব্যাংক তারল্য সংকটে রয়েছে।
সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের তারল্য পরিস্থিতি ২০১৮ সালে তুলনামূলক চাপের মুখে ছিল বলে জানান গভর্নর ফজলে কবির। গতকাল প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ২০১৮ সাল শেষে অগ্রিম আমানত অনুপাত (এডিআর) বেড়ে ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির নির্ধারিত সীমার মধ্যেই ছিল। ২০১৮ সালে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশি ছিল, যা ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অর্থায়নে স্থিতিশীল উৎস হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ পরিমাণের ঋণ পুনঃতফসিলের পরও ২০১৮ সালে দেশের ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা কমেছে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় চলতি হিসাবের ঘাটতি প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
গভর্নর দেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের মধ্যে ঋণ ঝুঁকির পরিমাণ ছিল ৮৮ শতাংশ।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের ঋণমান অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ছিল এবং ব্যাংকিং খাতে সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার, ইক্যুইটি মূল্য এবং তারল্যের ওপর স্ট্রেস টেস্টের অভিঘাত সহনীয় ছিল। ২০১৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মূলধন পর্যাপ্ততার হার ছিল ১৩.৯ শতাংশ যা ন্যূনতম আবশ্যিক হারের (১০ শতাংশ) তুলনায় বেশি।
জিআরএস/পাবলিক ভয়েস