

আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ভারত সরকার একতরফা গঙ্গার জল অপসারণের মাধ্যমে পদ্মা নদীকে জলশূন্য করে ফেলার বিরূদ্ধে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটিবাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ওমুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে বিহার-পশ্চিম বঙ্গ সীমান্তে। ১৯৭০ সালে শেষ হয় বাঁধটির গঙ্গা নদীতে নির্মাণকাজ। তখন পরীক্ষামূলকভাবে ভারত কিছু কিছু পানি ছেড়েছিল।
১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় ‘পরীক্ষামূলকভাবে’। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ক’টি গেট খুলে দেয় ভারত। ১৯৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চাহিদানুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিতই রয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে, শুষ্ক মওসুমেও পদ্মা নদী থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত পানি পেত বাংলাদেশ। এই বাঁধ চালু করার কয়েক মাসের মধ্যে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের পরিবেশে ফারাক্কার সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে মাওলানা ভাসানী এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদের জন্য জাতির প্রতি আহবান জানান।
এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে পদ্মা নদীর তীরবর্তী বিভাগীয় শহর রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান থেকে মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখী এই অভিযাত্রা শুরু করা হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে মারণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণে ভারতের উদ্দেশে বলেন, “তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। আজ যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।”
ভারতবিরোধী নানা স্লোগানে মুখরিত লাখো মানুষের স্রোতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণে ভারতের উদ্দেশে বলেন, “তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। আজ যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।”
লংমার্চে মাওলানা ভাসানী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পর্যন্ত পদযাত্রার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের পরামর্শে এই পদযাত্রা ১৭ মে অপরাহ্নে ভারতীয় সীমান্তের কাছে কানসাটে গিয়ে শেষ করা হয।ঐ দাবি উত্থাপনের নিমিত্তেই আজকের এই দিনে ফারাক্কা লংমার্চ দিবস পালিত হয়।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ তথা উত্তরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। ফারাক্কা দিন দিন গ্রাস করছে এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার। সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে; তেমনি নিঃস্ব মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছে শোকাবহ পরিবেশের।
ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ঢুকে পদ্মা নাম ধারণ করে। এই নদীকে কেন্দ্রে করেই একসময় আবর্তিত হতো এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা। তবে সময়ের ব্যবধানে এই নদী এখন এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কারণ। ১৯৭৫ সালে ভারত এই নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। আবার বর্ষা মৌসুমে ছেড়ে দেওয়া পানিতে একদিকে যেমন নদীগর্ভে বিলীন হয় গ্রামের পর গ্রাম, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল পরিণত হয় ধূ-ধূ বালু চরে।

এক সময়ের উত্তাল পদ্মা এখন ধূ ধূ বালুচর
বর্তমানে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হওয়া এই নদী যেন মাঝে মাঝেই তাড়া করে বেড়ায় এখানকার বাসিন্দাদের। ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, ফল-ফসলসহ সবকিছু। বিরূপ আবহাওয়ায় প্রতিবছর যেমন বাড়ছে তাপমাত্রা তেমনি, বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে এ অঞ্চল। আর নদী পানিশূন্য হওয়ায় কর্মসংস্থান হারাচ্ছে নদী পাড়ের মানুষেরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আহসানুল হক জানান,‘ ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে নদী পানিশূন্য থাকায় মাইলের পর মাইল বালুর চর জেগে ওঠায় তাপমাত্রা প্রতিবছরই বাড়ছে। যা সহ্য করা এখন আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাপমাত্রা বাড়ায় নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়ও।’
এমন আরও অনেক সমস্যা মিলিয়ে ফারাক্কা বাধ এসব অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি মরণফাঁদ হয়ে আছে। বাংলাদেশের সরকারের দুর্বল কুটনীতি ও ভারতের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা ফারাক্কা থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায়নি।