

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদরাসাছাত্রী আলেম পরিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফীকে নৃশংসভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে রাজধানী ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সচেতন কওমী মাদরাসা ছাত্রদের আয়োজনে “কওমী প্রজন্মের” ব্যানারে মানববন্ধন পালন করা হয়েছে। “অপরাধীর পরিচয় শুধুই অপরাধী” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে সভাপতির বক্তব্যে প্রখ্যাত ওয়ায়েজ, লেখক ও সমাজকর্মী মুফতী হাবিবুর রহমান মিছবাহ বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি। কিন্তু আজকে অপরাধ এত সতেজ হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে আমরা শঙ্কায় থাকি বিচার হবে কী না! বরং বিচার হবে না এটাই আমাদের ধরে নিতে হয়। কারণ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি আজ বিচার না হওয়ার সংস্কৃতিতে দাঁড়িয়েছে। তনু হত্যার আজ পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। সিলেটের খাদিজার ওপর হামলাকারীর বিচার হয়েছে তবে তা প্রত্যাশিত ও দৃষ্টান্তমূলক হয়নি। এভাবেই লম্পট ধর্ষক এবং যৌন হয়রানির হোতারা সহজে পার পেয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা আজকের এই মানববন্ধন থেকে নুসরাত এবং শিশু মনির হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার কার্যকরের জোর দাবি জানাচ্ছি এবং এই কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সকল অপরাধীর শাস্তি হোক এবং এর বিচার দ্রুত কার্যকর হোক। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এ জন্যই আমাদের আজকের স্লোগান- অপরাধী যেই হোক না কেন, তার পরিচয় যাই হোক না কেন সে শুধুই অপরাধী। তার কোনো ধর্ম বর্ণ নেই, তার কোনো গোষ্ঠী নেই। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যখনই কোনো দিকভ্রান্ত দাড়ি-টুপি ওয়ালার মাধ্যমে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তখনই আমরা দেখতে পাই- একটি মহল সেই অপরাধকে কেন্দ্র করে সমস্ত মাদ্রাসা অঙ্গনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, এটা কোনো বিবেকবান ব্যক্তির কাজ নয়। কারণ, যে অপরাধ করে তার লেবাস যাই হোক, তার পরিচয় যাই হোক, সে অপরাধী। তাকে অপরাধী হিসেবেই বিবেচিত করা হবে।
এছাড়াও মানবন্ধন থেকে বক্তারা সোনাগাজীর ও ডেমরার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, এটা কোনোভাবে সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থীকে যৌন নিপিড়ন করে প্রতিবাদ করার কারণে তাকে পুড়িয়ে মারার এ ঘটনা হতবাক করে দেওয়ার মতো। মাদরাসাঅধ্যক্ষের নামে যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তা খতিয়ে দেখাসহ এ ঘটনার সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন তারা। অপরদিকে ডেমরার ঘটনায় মসজিদের ইমাম কর্তৃক শিশু মনিরকে নৃশংসভাবে হত্যার কঠোর শাস্তি দাবিও করা হয় মানববন্ধন থেকে।
কলরবের যুগ্মনির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ বদরুজ্জামানের পরিচালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন— কলরবের প্রধান পরিচালক রশিদ আহমাদ ফেরদাউস, মুফতী আবু ইউসুফ মাহমূদী, মুফতী ছাকিবুল ইসলাম কাসেমী, মুফতী আব্দুর রহমান কোব্বাদী, মুফতী রেজাউল করীম আবরার, হাফেজ ক্বারী ইলিয়াস লাহোরী, ক্বারী আব্দুল কাইয়ুম মোল্লা, ক্বারী নুর মোহাম্মাদ, মাওলানা নজির আহমাদ শিবলী প্রমুখ। মানববন্ধনে লিখিত প্রস্তাবলী পাঠ করেন পাবলিক ভয়েস টোয়েন্টিফোর এর নির্বাহী সম্পাদক হাছিব আর রহমান।
সরকারের প্রতি মানববন্ধনে গৃহীত প্রস্তাবাবলী :
১. নারীর প্রতি নিপিড়নরোধে তাদের জন্য পর্দাবিধান পালন করার স্বাভাবিক ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
২. নারীকে ভোগ্যপন্য হিসেবে চিন্তা করার মানসিকতা দুর করতে নারীকে পন্যরূপে উপস্থাপনের বিপক্ষে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে
৩. নারীর প্রতি নিপিড়নরোধে ইসলামের মূল্যবোধসহ ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।
৪. দেশে নারীর প্রতি নিগৃহের বিপক্ষে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে
৫. ধর্ষণের শাস্তির বিধান মৃত্যুদন্ড করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৬. ধর্ষণের টেষ্টের নামে “টু ফিঙ্গার টেষ্ট” বন্ধ করার আদালতের আইন বাস্তবায়ন করতে হবে
৭. থানায় মামলা নিতে গড়িমসি করার বিপক্ষে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৮. ধর্ষণ মামলা পরিচালনার জন্য পুলিশ ছাড়াও সরকারীভাবে স্পেশাল বাহিনী তৈরি করতে হবে।
প্রসঙ্গত : নুসরাত জাহান রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিমের পরীক্ষার্থী। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এর আগে তাকে যৌন নিপীড়ন করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগে নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এসময় তাকে কৌশলে একটি বহুতল ভবনে ডেকে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। সেখানে তার গায়ে দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন দেওয়া হয়।
বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত মারা যান। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনার পর গত ৮ এপ্রিল নুসরাতের বড়ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ১০।