

আফগান মার্কিন যুদ্ধে যে নামটা ভয়ানক হয়ে বিশ্বের কাছে প্রকাশিত হয়েছিল তা ছিলো ভয়াবহ “গুয়ান্তানামো বে” কারাগার। পৃথিবীর জাহান্নাম হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছিলো এই কারাগারটিকে। এখানে আমেরিকার সেনারা তালেবানের অসংখ্য নেতাদের ধরে এনে বন্দি করে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিলো।
সেই ভয়ানক কারাগারে ১৩ বছর কাঁটিয়ে মুক্তি পাওয়া তালেবানের পাঁচ নেতা এখন কাতারের রাজধানী দোহায় আমেরিকার সাথে শান্তি আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়ার আগে আগে ১৩ বছর ধরে গুয়ান্তানামোতে তালেবানের এই পাঁচজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে আটক করে রাখা হয়েছিল। চালানো হয়েছিলো ভয়ানক নির্যাতন।
তারা হলেন, মোল্লা মুহাম্মাদ খায়রুল্লাহ খাইখওয়া, আবদুল হক ওয়াসিক, মোল্লা ফজেল মাজলুম, মোল্লা নূরুল্লাহ নূরী ও মোহাম্মদ নবী ওমারী। মোল্লা খৈরওয়া তালেবান সরকারের গভর্নর এবং অভ্যন্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আবদুল হক ওয়াসিক ছিলেন ডেপুটি মিনিস্টার। মোল্লা মাজলুম উত্তর আফগানিস্তানে তালেবানের নেতা ছিলেন। এছাড়া বাকি দুজনও ছিলেন আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ নেতা।
এই পাঁচজনই তাদের জীবনের একটি ভয়ানক সময় অতিক্রম করেছেন গুয়ান্তানামো বে কারাগারে। আর এখন তারাই আমেরিকার সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। এ নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছে বিশ্ব গণমাধ্যম আল জাজিরা ও নিউইয়র্ক টাইমস।
সাবেক বন্দী মোল্লা খায়রুল্লাহ বলেছেন; “গুয়ান্তানামোতে আমাদের সময়কাল, অনুভূতি ছিলো অন্যরকম। আফগানিস্তান থেকে আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবেই আনা হয়েছিল এবং আমাদের বলা হয়েছিলো আমরা মুক্তি পেয়ে যাব,” কিন্তু এরপর গুয়ান্তানামোতে আমরা ভয়ানক সময় পার করেছি। এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, নিজেদের প্রতি নিজেরাই মায়া হারিয়ে ফেলছিলাম “কিন্তু এটা আমার কাছে কখনো মনে হয়নি যে, একদিন তাদের সাথে আলোচনা হবে, এবং আমি এক পাশে ও অন্যদিকে অন্যপাশে তারা বসে থাকবে।”
তবে তিনি এ আলোচনার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “এই আলোচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে আমার নিজের ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কথা মনে হয় না।” “আমি আসলে আমার কাছ থেকে কে বসে আছে এবং তারা আমার সাথে যা করেছে তা নিয়ে চিন্তা করছি না।” বরং “আমরা কী বিষয়ে কথা বলছি যা গুরুত্বপূর্ণ,” এবং “আমাদের লক্ষ্য এবং আমাদের দেশের জন্য আমাদের জাতীর স্বার্থের জন্য আমরা কথা বলছি।”
আফগান তালেবান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে বা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে দাবি করে তালেবানের সাথে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি দলের আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব চলছে। প্রথম পর্বের আলোচনা মার্চের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হয়েছিলো। কাতারের রাজধানী দোহার দক্ষিণ অংশে সমুদ্র তীরবর্তী পাঁচ তারকা রিটজ-কার্লটন হোটেলের ব্যাংকোয়েট হলে তালেবান ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের মধ্যে ১৬ দিন ধরে সেই রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়েছিলো।
কাতারের রাজধানী দোহার দক্ষিণ অংশে সমুদ্র তীরবর্তী পাঁচ তারকা রিটজ-কার্লটন হোটেলের ব্যাংকোয়েট হলে তালেবান ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের মধ্যে রুদ্ধদ্বার আলোচনা
কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত সেই আলোচনায় তালেবানের রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা আবদুল গণি বারাদার ও মার্কিন দলের নেতৃত্বে বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ ছিলেন। আলোচনার পর মার্কিনীদের পক্ষ থেকে খলিলজাদ এবং তালেবান মূখপত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বেশ কিছু বিষয় প্রকাশ করেছিলেন তখন। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ আবদুল গনী বারাদারের পক্ষ থেকে জানিয়েছিলেন, বিদেশি বাহিনীগুলোর প্রত্যাহার ও ভবিষ্যতে আফগানিস্তান থেকে অন্যান্য দেশে হামলা বন্ধ করার মতো ইস্যুগুলোতে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে। তবে যুদ্ধবিরতি বা আফগান সরকারের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে কোনো সমঝোতা হয়নি বলেও জানিয়েছিলেন তারা।
অপরদিকে খালিলজাদ বলেছিলেন, আমেরিকা তালেবানের কাছে সন্ত্রাসবাদ বিরোধীতার বিষয়ে নিশ্চয়তা এবং তালেবান আমেরিকার কাছে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে জোরদার আলোচনা করেছে এবং এ দু পয়েন্টে আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে। আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া এ মার্কিন কূটনীতিক খলিলজাদ তার টুইটার অ্যাকাউন্টে এক টুইট করে জানিয়েছেন, “শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলোর উন্নতি হয়েছে। সব পক্ষই যুদ্ধের শেষ চায় এটা পরিষ্কার। উত্থান-পতন সত্বেও আমরা বিষয়গুলোকে এক রেখায় রাখতে পেরেছি এবং বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পেরেছি, এটাই আশার বানী। তবে “সৈন্য প্রত্যাহারের সময় ও কার্যকর সন্ত্রাসবাদবিরোধী পদক্ষেপের বিষয়ে সমঝোতার খসড়া যখন চূড়ান্ত হবে তখন তালেবান সরকারসহ অন্যান্য আফগানরা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে আন্তঃআফগান মধ্যস্থতা শুরু করবে,” বলেও বলেছেন তিনি।
তবে খলিলজাদের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দলের সাথে তালেবান শান্তি আলোচনার বেশ কয়েকটি পর্বে অংশ নিলেও আফগানিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে তারা। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির এক মুখপাত্র টুইটারে বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধবিরতির সমঝোতা এবং তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে সরাসরি আলোচনার শুরু দেখার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
এবার সে আলোচনার পরবর্তি অংশ চলছে কাতারে। এ পর্বে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসে কি না তা জানা যাবে খুব শীগ্রই।
২০১৩ সাল থেকেই কাতারে তালেবানদের রাজনৈতিক দপ্তরের যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি আফগান অঞ্চলের উত্তেজনা নিরসনে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
এইচআরআর/পাবলিক ভয়েস