

মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস এবং ইতিহাসবিদ হলেন ইবনে কাসির রাহ.। ‘আন নিহায়া ওয়াল ফিতান’ নামে তিনি একটি কিতাব লিখেছেন। সেখানে তিনি গাজওয়ায়ে হিন্দ সংক্রান্ত হাদিসগুলো উল্লেখ করে সেগুলোর উপর আলোচনা করেছেন।
ইমাম ইবনে কাসির রাহ. বলেন,
إشارة نبوية إلى أن الجيش المسلم سيصل إلى الهند والسن
‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশারা করে গেছেন মুসলমানদের একটি বাহিনী অতি শীঘ্রই হিন্দ এবং সিন্দে পৌঁছবে।’ এরপর তিনি আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত দুটি হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন,
وقد غزا المسلمون الهند في سنة أربع وأربعين في إمارة معاوية بن أبي سفيان رضي الله عنه فجرت هناك أمور فذكرناها مبسوطة، وقد غزاها الملك الكبير السعيد المحمود بن شنكنكير صاحب بلاد غزنة وما والاها في حدود أربعمائة ففعل هنالك أفعالاً مشهورة وأموراً مشكورة وكسر الصنم الأعظم المسمى بسومنات وأخذ قلائده وسيوفه ورجع إلى بلاده سالماً غانماً،
‘মুসলমানরা হিন্দে মুয়াবিয়া রা.-এর যুগে ৪৪ হিজরিতে যুদ্ধ করেছে। সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আমি পূর্বে করে এসেছি। এছাড়া সুলতান মাহমুদ গাজনবি রাহ. হিন্দের গজনবিতে অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান মাহমুদের অভিযান ছিল ৪০০ হিজরিতে। সেখানে তিনি অনেক প্রসিদ্ধ কাজ এবং ঘটনা জন্ম দিয়েছেন। সেখানের সবচে বড় মন্দির সোমনাথ মন্দির ভেঙ্গেছিলেন। সেখানের সম্পদ এবং তারবারি দখল করেন। এরপর তিনি অনেক গনিমতের সম্পদ অর্জিত করে সহিহ সালামতে নিজের দেশে ফিরে আসেন। (আন নিহায়া ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম: ১২-১৩)
গাজওয়ায়ে হিন্দ সংক্রান্ত আবু হুরায়রা রা.-এর দুটি হাদিস উল্লেখ করার পর এ মত পেশ করেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় যে, ইবনে কাসির রাহ.-এর মতে গাজওয়ায়ে হিন্দের হাদিসগুলো কিয়ামতের আগের যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট না; বরং মুয়াবিয়া রা.-এর যুগে হিন্দে যে যুদ্ধ হয়েছিল।
এরপর সোমনাথ মন্দিরে সুলতান মাহমুদ গজনবি রাহ.-এর অভিযানও গাজওয়ায়ে হিন্দের হাদিসের মাঝে শামিল। অর্থাৎ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিন্দের যুদ্ধের বাহিনীর যে সুসংবাদ দিয়েছেন, সে সুসংবাদের মধ্যে হিন্দুস্তানে মুসলমানরা যতগুলো অভিযান পরিচালনা করেছে, সবগুলোই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুসংবাদের মাঝে শামিল। এর থেকে বোঝা যায় যে, হিন্দুস্তানে যুগে যুগে মুসলমানরা বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করবে।
সবগুলো অভিযান রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের সুসংবাদের মাঝে শামিল। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লামা ইবনে কাসির রাহ. কিয়ামতের আগের সংঘটিত গাজওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে আলোকপাত করেননি। বাকী কিয়ামতের আগের সংঘটিত হাদিসগুলো সম্পর্কে তিনি কোনো কথা বলেননি। এজন্য আল্লামা ইবনে কাসির রাহ.-এর মতে কিয়ামতের আগে গাজওয়ায়ে হিন্দ বলতে কোনো যুদ্ধ হবে না—এ কথা বলার অবকাশ নেই। হ্যাঁ, এতটুকু বোঝা যায় যে, ইমাম ইবনে কাসির রাহ.-এর মতে, হিন্দুস্তানের ইতিহাসে সংঘটিত সবগুলোই যুদ্ধই গাজওয়ায়ে হিন্দের সবগুলো হাদিসের সুসংবাদের মাঝে শামিল।
পাকিস্তানের মাওলানা উমায়ের মাহমুদ সিদ্দিকি সাহেব ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’ নামে উর্দু ভাষায় একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখেছেন। ইমাম ইবনে কাসির রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করার পর তিনি বলেন, ‘আল্লামা ইবনে কাছির রাহ. গাজওয়ায়ে হিন্দের হাদিসগুলো উল্লেখ করার পর সাথে সাথে তার ঐতিহাসিক এবং ফিতনা সম্পর্কিত লিখিত বইয়ে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন হামলা উল্লেখ করার দ্বারা এ কথা বোঝা যায় যে, তাঁর নিকট হিন্দুস্তানের সবগুলো যুদ্ধই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুসংবাদের শামিল। স্মরণ রাখতে হবে, উলামায়ে কেরাম গাজওয়ায়ে হিন্দকে কিয়ামতের আগের একটি নিদর্শন হিসাবে গণ্য করেছেন। সুতরাং তাদের মতে এ সুসংবাদের পূর্ণতা এখনো হয়নি।’ (গাজওয়ায়ে হিন্দ : ৪৮, ইসলামি রুহানি মিশন থেকে প্রকাশিত।) মুহাম্মাদ বিন কাসিম ভারত অভিযান থেকে শুরু করেন।
তিনি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা দাহিরকে পরাজিত করে হিন্দুস্তানে ইসলামের বিজয়কেতন উড়িয়েছেন। এরপর কালের আবর্তে বহু সময় পেরিয়েছে। ইসলাম পত্র-পল্লবে আরও সুশোভিত হয়েছে। একের পর এক এলাকা বিজিত হয়েছে। দলে দলে মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে। হিন্দুস্তানের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি সিক্ত হয়েছে মুসলানদের তাজা খুনে। মুসলমানদের অশে^র খুরের ধ্বনিতে থরথর করে কেঁপে উঠেছে হিন্দুস্তানের জমি।
শুধু সুলতান মাহমুদ গজনবির কথা ধরুন। অনেকবার তিনি আক্রমণ করেছেন হিন্দুস্তানে। মুজাহিদদের তাকবির ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দের ইথারে ইথারে। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের মাধ্যমে হিন্দুস্তানে মুসলমানদের যে বিজয়কেতন উড়ানো শুরু হয়েছিল, সুলতান মাহমুদ গজনবির মাধ্যমে সেটা অনেকাংশে পূর্ণতা পেয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসিরের মতে, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিন্দের যুদ্ধ এবং সে বাহিনীর ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে যে সুসংবাদ দিয়েছেন, সেটা শুধু একটি অভিযানের সাথে নির্দিষ্ট নয়; বরং হিন্দুস্তানে মুসলমানরা যতগুলো অভিযান পরিচালনা করেছে, সবগুলো অভিযানের সৈন্যরাই সে ক্ষমাপ্রাপ্ত সুসংবাদের মাঝে শামিল’।
বাকি গাজওয়ায়ে হিন্দের সবগুলো হাদিস সামনে রাখলে বোঝা যায় যে, কিয়ামতের আগে মুসলমান আর কাফেরদের মাঝে আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ হবে হিন্দুস্তানে। যে যুদ্ধে আল্লাহ মুসলমানদেরকে বিজয় দান করবেন। মুসলমানরা হিন্দুস্তানের বাদশাহকে বন্দি করে নিয়ে আসবে গলায় শিকল লাগিয়ে। তারা যখন সিরিয়ায় ফিরে আসবে, তখন ঈসা আ.-এর সাথে তাদের দেখা হবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।