দীনের দাওয়াতে চরমোনাই এগিয়ে

প্রকাশিত: ৯:০৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯
১৯২৪ সালে বরিশাল সদর থানার “চরমোনাই” নামক একটি গ্রামে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন জনাব মুন্সী আহছানুল্লাহ। এক পর্যায়ে এখানে আরো বড় ধরনের মাদ্রাসা করার দায়িত্ব পান তাঁর জামাতা সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক রঃ। তিনি কুমিল্লার উজানী থেকে ক্বারী ইব্রাহীম (রঃ)  এর থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা নিয়ে চরমোনাই ফিরেছেন। চরমোনাইতে ফিরে তিনি স্বীয় মুরশিদ থেকে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক ইলেম ও আমল গুটিকয়েক অনুসারীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। ক্রমশঃ তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বদৌলতে চরমোনাই মাদরাসা ও দরবারের পরিচিতি বাড়তে থাকে। তাঁর জীবনী ঘাটলে দেখা যায়- বেনামাজীকে মসজিদে ফেরাতে চুঙ্গা ফুঁকিয়ে আহ্বান করতেন। আর হালকায় জিকিরের শামিল করতে নিজেই চুঙ্গায় মুখ দিতেন। সারা বছর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করে ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করতেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা আদৌ ভালো ছিল না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সর্বত্র তিনি বোটে চলাফেরা করতেন। তাঁর কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে চিশতিয়া সাবেরিয়া তরিকার  খেদমত সর্বত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। বিশেষ করে দক্ষিনাঞ্চলে তাঁর মুরীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। বৃহত্তর বরিশালের পটুয়াখালী, বরগুনা,ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিতে চরমোনাইর ভিত অনেক মজবুত সে কারণে।
চরমোনাইর মূল দর্শন হলো- আল্লাহ- রাসুলকে পেতে হলে দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। হ্যাঁ সেই জ্ঞাণ হাছিল করার অন্যতম একটা মাধ্যম চরমোনাই ময়দান।চরমোনাই মাহফিল। বছরে দুটো মাহফিলের পাশাপাশি শায়েখগন সারা দেশে হাজার হাজার মাহফিলের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে দ্বীনের তালীম দেন।
সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক (রঃ) উজানীর পীর ক্বারী ইব্রাহীম ছাহেব (র)’র একজন পছন্দের ছাত্র ও শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁকে নিজ এলাকায় গিয়ে ইসলাম প্রচারে নিজেকে মনোনিবেশ করতে পাঠিয়ে দেন। এ প্রক্রিয়াকে “খেলাফত প্রদান” বলা হয়। তৎকালীন সময়ে এতদাঞ্চলের শীর্ষ আধ্যাত্মিক বুযুর্গ হিসেবে ক্বারী ইব্রাহীম সাহেবের পরিচিতি ছিল। তাঁর হাতে গড়া মুরীদ সৈয়দ এছহাককে প্রয়োজনীয় ফায়েজ ও দোয়া দিয়ে নিজ এলাকায় প্রেরণ করেছিলেন।
সৈয়দ মুহাম্মাদ এছাহাক (রঃ) প্রতিষ্ঠা করেন চরমোনাই আলীয়া মাদ্রাসা ও লিল্লাহি বোর্ডিং। প্রতিষ্ঠা করেন চরমোনাই তরীকার।
তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে “বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি” নামে একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যারা হররোজ নিজ নফছ ও শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তি পেতে লড়াই করেন। এ সংগঠনটি চরমোনাইর যা কিছু আছে সবই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
১৯৭৩ সালে পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ এছহাক সাহেবের ইন্তেকালের পর চরমোনাই দরবারের দায়িত্ব পান তাঁরা দ্বিতীয় পুত্র মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম (রঃ)। তিনি তাঁর পিতার ধারা অব্যাহত রেখে সারা দেশে সফর করে ইবাদাতে গাফেল লোকজনকে সঠিক পথ ধরাতে সহায়তা করেন। তিনি চরমোনাই আলীয়া মাদরাসার ব্যাপক উন্নতি ঘটান। স্বীয় মুরীদদের থেকে গৃহীত অর্থ দিয়ে হাজার হাজার ছাত্রদেরকে লিল্লাহি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। যা এখনো চলছে আরো বৃহত্তর পরিসরে।
তিনি আশির দশকে চরমোনাইতে কওমী শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। চরমোনাই এমনি একটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র, যেখান থেকে প্রতি বছর কামিল ও দাওরার সনদ নিয়ে বের হয় শত শত মাওলানা ও মুফতী।
সৈয়দ মুহাম্মাদ ফজলুল করীম (রঃ)’র জীবদ্দশায় তিনি চরমোনাই তরিকা ও জামেয়ার ব্যাপক উন্নতি করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড স্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য হলো ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার কুরআন শিক্ষার মাদ্রাসার স্থাপন করা। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় বিশ হাজারেরও অধিক মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়েছে।
তাঁর আরেকটি মিশন, এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা।এ লক্ষ্যে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। প্রথমে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’ যা পরবর্তীতে ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হয়। এটি বর্তমানে ইসলামী রাজনীতিতে  সাড়া ফেলানো রাজনৈতিক শক্তি।
২০০৬ সাথে চরমোনাইর পীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম (রঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁকে দাফন করার আগেই তাঁর সকল খলীফা ও বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির শীর্ষ ব্যক্তিরা পরবর্তী নেতা নির্বাচন করেন। মরহুম পীর সাহেব (রঃ)’র সাত পুত্রের মধ্যে দু’জনকে তিনি খেলাফতি প্রদান করেন।
তাঁর সুযোগ্য তৃতীয় পুত্র মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমকে মূল পীর হিসেবে আর চতুর্থ পুত্র মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
তাঁরা যথাক্রমে পীর সাহেব চরমোনাই ও শায়েখে চরমোনাই নামে পরিচিত। অনুরূপ বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির মুহতারাম আমীর ও সিনিয়র নায়েবে আমীর পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
উভয়ের ব্যাপক পরিশ্রমের ফলে আজ চরমোনাইর তরিকার খেদমত সারা দেশব্যাপী বিস্তৃত। স্বীয় পিতা ও দাদার ন্যায় তাঁরা উভয়েই বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চলে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত অব্যাহত রাখেন। যার ফলে আপনি সারা দেশের মসজিদ-মাদরাসায় চরমোনাইর অনুসারী কমবেশী দেখতে পাবেন‌।
চরমোনাই মাহফিলে প্রতি বছর লোক সমাগম বেড়েই চলছে। বছরে দুটো মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অগ্রহায়ণ ও ফাল্গুনে। ফাল্গুন মাহফিলের বিশালতা আজ পৃথিবীর বড় জমায়েতগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
সদ্য শেষ হওয়া চরমোনাই  মাহফিলে লোক হাজিরের বিষয়টি ইতোপূর্বের সকল রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। মূল মাঠই ছিলো পাঁচটি।পাঁচটা মাঠের আয়তন যোগ করলে দেখা যায় মোট আয়তন প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশী।
মাঠের বাইরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরতদের হিসাব যোগ করলে কত বর্গ কিলোমিটার হতে পারে তা জানার উপায় নাই। আগত মুসল্লিদের একটি বড় অংশ মাদ্রাসা ভবন, আল কারীম মাসজিদ, নোঙ্গর করা শত শত লঞ্চ, বাজার ও এলাকাবাসীর বাড়ীঘরে অবস্থান করেছিলেন।
গত শনিবার ভোরে পীর সাহেব চরমোনাইর বয়ান ও বিদায়ী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তিনদিন ব্যাপী ফাল্গুন মাহফিলের সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। এরপর থেকে শুরু হচ্ছে বছরব্যাপী সারা দেশে চরমোনাইয়ের শায়েখদের সফর। তাঁদের সফরকেন্দ্রিক ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে লাখো মানুষ মাওলার হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। যা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে নিঃসন্দেহে গালিব।
লেখকঃ কলামিস্ট, এক্টিভিস্ট, বিশ্লেষক।

মন্তব্য করুন