

[লেখাটি বয়ান আকারে লিখিত। পড়ার আগে পাঠক মনে মনে বিবেচনা করে নেবেন যে, এই কথাগুলো কারো সামনে বসে শুনছি।]
মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমী :
আমরা গুনাহ করে থাকি, পাপে জড়িয়ে পড়ি, আল্লাহর নাফরমানি করি। করি না? কেউ দাড়ি রাখছে না, কেউ নামায ছেড়ে দিচ্ছে, কেউ অন্যের জমি দখল করে রাখছে, কেউ পরনারীর দিকে যৌন-লালসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, এভাবে আমাদের অনেকেই কোনো না কোনো গুনাহে বা পাপকাজের সাথে জড়িয়ে আছি। গুনাহ, পাপ বা নাফরমানি বলতে কী বুঝায়? এ বিষয়ে আমাদের জানা দরকার আছে। আমরা শুনেছি সগিরা ও কবিরা গুনাহ আছে, সেগুলো কাকে বলে, এসব জানা দরকার।
আমরা কিন্তু সওয়াবের কাজও করছি। আমরা নামায পড়তে যাই, বয়ান শুনতে আসলাম, পিতা-মাতার সেবা করি, পাড়াপ্রতিবেশীর উপকার করি; এভাবে আমরা সওয়াবের বা পুণ্যের কাজের সাথে লেগেও আছি। আমরা সওয়াব অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিলেও সওয়াব ধরে রাখার প্রতি তেমন গুরুত্ব আরোপ করি না।
আপনারা মাঝেমধ্যে মাছ ধরতে যান না? একলোক মাছ ধরতে গেছে জাল নিয়ে। মাছ রাখার জন্য বাঁশ দিয়ে ডোলা বানানো হয়। মাথায় বা কোমরে বেঁধে রাখতে হয়। মাছ ধরে ধরে সেখানে রাখে। আপনার জালে মাছ উঠতেছে। মাছ ধরে ডোলার মধ্যে রাখতেছেন; কিন্তু ডোলার নিচ দিয়ে ছিদ্র। আপনি যতই মাছ ধরেন সব মাছ তো বেরিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি এসে দেখবেন একটা মাছও নেই। কারণ, মাছ ধরলেও মাছ সংরক্ষণ করেননি। তদ্রুপ আমরা সওয়াব, পুণ্য ও নেকি অর্জন করলেও সেগুলো হেফাজত করি না, সংরক্ষণে গাফলতি করি।
- আসুন, আজকে আমরা পাপ ও গুনাহ নিয়ে কিছু আলোচনা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাপের পরিচয় জেনে সেগুলো থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন।
পাপ ও গুনাহ কাকে বলে? :
আল্লাহ তাআলা বান্দাদের ওপর যেসব বিধান আবশ্যক করেছেন সেগুলো না করা এবং যেসব বিষয় থেকে বারণ করেছেন সেগুলো করাই হচ্ছে পাপ, গুনাহ ও নাফরমানি। কুরআন ও হাদিসে পাপ-গুনাহের জন্য কয়েকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এসব শব্দ এবং বাক্যের আশপাশ ও অন্যান্য বিষয়াবলি দ্বারা জানা যায়, পাপের মধ্যেও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। সকল গুনাহ সমা অপরাধ না। গুনাহে গুনাহে বেশকম আছে। কুরআন ও হাদিসে গুনাহ বুঝানোর জন্য নিম্নের শব্দগুলোর কোথাও একবচন কোথাও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে।
الْمَعْصِيَةُ ، الْعِصْيَانُ ، ذَنْب ، خَطِيئَةٌ ، إِثْمٌ ، سَيِّئَة
কবিরা ও সগিরা :
গুনাহ দুই প্রকার : ১. কবিরা গুনাহ। ২. সগিরা গুনাহ। কবিরা গুনাহ মানে বড় গুনাহ। কবিরা গুনাহের পারিভাষিক সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন :
هِيَ مَا كَانَ حَرَامًا مَحْضًا، شُرِعَتْ عَلَيْهِ عُقُوبَةٌ مَحْضَةٌ، بِنَصٍّ قَاطِعٍ فِي الدُّنْيَا وَالآْخِرَةِ.
“যা কেবল হারাম গুনাহের মধ্যেই সীমিত। যে গুনাহের কারণে অকাট্য প্রমাণের আলোকে দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তির প্রচলন রয়েছে।”
কেউ কেউ বলেন :
إِنَّهَا مَا يَتَرَتَّبُ عَلَيْهَا حَدٌّ، أَوْ تَوَعَّدَ عَلَيْهَا بِالنَّارِ أَوِ اللَّعْنَةِ أَوِ الْغَضَبِ
“যে গুনাহের কারণে হদ কায়েম করা হয় অথবা যে গুনাহের কারণে জাহান্নামের ধমকি রয়েছে কিংবা অভিশম্পাত অথবা ক্রোধ পতিত হওয়ার হুমকি রয়েছে।”
কিছু কিছু পাপকে কুরআন ও হাদিসের স্পষ্ট প্রমাণের আলোকে কবিরা গুনাহ হিসেবে শনাক্ত করা যায়, যেমন, আল্লাহর সাথে অংশিদারিত্ব সাব্যস্ত করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা, অন্যায় হত্যা, যাদু, মিথ্যা সাক্ষ্য ইত্যাদি।
আর যেসব গুনাহ সম্পর্কে কবিরা হিসেবে স্পষ্ট ঘোষণা কুরআন বা হাদিসে আসেনি এরূপ পাপসমূহের কোনটি কবিরা তা নির্ণয় করার জন্য ফুকাহায়ে কেরাম একটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন।
তারা বলেন, যে পাপ কুরআন ও হাদিসের দলিল দ্বারা কঠোরভাবে হারাম হওয়া প্রমাণিত, যার ব্যাপারে লানত ও গজবের ঘোষণা এসেছে, কিংবা জাহান্নামের হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, অথবা দুনিয়াতে শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে সেটাই ইসলামের পরিভাষায় কবিরা গুনাহ বলা হয়।
সগিরা গুনাহ
সগিরা মানে ছোটো। যে গুনাহ কবিরা নয় তাই সগিরা। সগিরা গুনাহের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে :
كُل ذَنْبٍ لَمْ يُخْتَمْ بِلَعْنَةٍ أَوْ غَضَبٍ أَوْ نَارٍ.
“প্রত্যেক ওই গুনাহ যার ব্যাপারে অভিশম্পাত, ক্রোধ অথবা জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়নি।”
আর কেউ কেউ বলেন :
الصَّغِيرَةُ هِيَ مَا لَيْسَ فِيهَا حَدٌّ فِي الدُّنْيَا وَلاَ وَعِيدٌ فِي الآْخِرَةِ.
“সগিরা এমন গুনাহকে বলা হয়, যেসব গুনাহ করলে দুনিয়াতে কোনো শাস্তি নেই এবং আখেরাতে আজাবের কোনো ধমকি নেই।”
যেমন আযান হওয়ার পর মসজিদ থেকে বের হওয়া, দাওয়াত পাওয়ার পর তাতে কোন কারণ ব্যতীত অংশ গ্রহণ না করা, সালামের উত্তর না দেয়া, হাঁচি দিয়ে যে আল্হামদুল্লিাহ বলল তার উত্তর না দেয়া ইত্যাদি।
- গুনাহ দুই প্রকারে বিভক্ত হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য দলিল প্রমাণ রয়েছে। কিছু নিম্নরূপ:
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ
“নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর মাঝে যা গুরুতর, তা হতে যদি তোমরা বিরত থাক, তবে তোমাদের ছোটো পাপগুলো ক্ষমা করে দিব।” [সূরা নিসা : ৩১]
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :
الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ
“যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্য হতে, ছোটো পাপের সম্পৃক্ততা সত্তে¡ও।” [সূরা নাজম : ৩২]
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
الصَّلَاةُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُنَّ، مَا لَمْ تُغْشَ الْكَبَائِرُ
“পাঁচওয়াক্ত নামায ও এক জুমুআ থেকে অপর জুমুআর মধ্যবর্তী সময়ে কৃত পাপের কাফফারা হয়ে যায়, যদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩৩)
সকল গুনাহ থেকেই বেঁচে থাকা আবশ্যক :
গুনাহ ছোটো হোক বা বড় হোক সকল গুনাহ থেকেই বেঁচে থাকা আবশ্যক। সগিরা গুনাহ মনে করে সেগুলোর মধ্যে নিপতিত হওয়া যাবে না।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল করতে নিষেধ করেছেন, ব্যাস সেসব আর করা যাবে না। কার হুকুম সেটাই মূল বিবেচনার বিষয়। দুনিয়াতে প্রধানমন্ত্রীর একটা ছোট্ট নির্দেশও আমরা গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করে থাকি, সামান্য বিষয়ে নিষেধ করলেও আমরা তা করার সাহস রাখি না। প্রখ্যাত তাবেয়ি বেলাল ইবনে সাদ রহ. বলেন, ‘তুমি ছোটো অপরাধ করলে না বড় অপরাধ করলে তা ধর্তব্য নয়। মূল দেখার বিষয় তুমি কার কথার অবাধ্য হচ্ছো।’
হাদিসে এসেছে :
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ فَإِنَّمَا مَثَلُ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ كَقَوْمٍ نَزَلُوا فِي بَطْنِ وَادٍ، فَجَاءَ ذَا بِعُودٍ، وَجَاءَ ذَا بِعُودٍ حَتَّى أَنْضَجُوا خُبْزَتَهُمْ، وَإِنَّ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ مَتَى يُؤْخَذْ بِهَا صَاحِبُهَا تُهْلِكْهُগ্ধ
“হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা ছোটো ছোটো গুনাহ থেকে দূরে থাকো। ছোটো গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ার দৃষ্টান্ত সেই পর্যটক দলের মত, যারা একটি উপত্যকায় বিশ্রাম নিতে বসল। অতঃপর তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি একটি লাকড়ি নিয়ে উপস্থিত হল, অপর ব্যক্তি আরেকটি; পরিণতিতে তাদের রুটি প্রস্তুত হয়ে গেল। এবং ছোটো গুনাহের কারণে যদি কাউকে পাকড়াও করা হয়, তবে সন্দেহ নেই তা তার ধ্বংসের কারণ হবে।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৮০৮)
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
مَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ، فَاجْتَنِبُوهُ وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَافْعَلُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ، فَإِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ كَثْرَةُ مَسَائِلِهِمْ، وَاخْتِلَافُهُمْ عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ.
“তোমাদেরকে যেসব বিষয় থেকে বারণ করি, সেগুলো থেকে বিরত থাকো। আর যেসব বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করি সেগুলো যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করো। তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে অতিরিক্ত প্রশ্ন করা এবং তাদের নবী-রাসুলদের নিয়ে অযথা মতবিরোধ করার কারণে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৩৭)
শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ সগিরা গুনাহ করতে করতে একসময় কবিরা গুনাহেও লিপ্ত হয়ে যায়। তাই সগিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকতে হবে। সগিরা গুনাহও শয়তানের একটি পথ। শয়তান একেকজনকে একেক ভাবে ধোঁকা দেয়। সগিরা গুনাহ শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণার জাল।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ وَمَنْ يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ.
হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। আর যারা শয়তানের পথ অনুসরণ করে; জানা উচিত শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দকাজের নির্দেশ দেয়।” (সূরা আন-নূর : ২১)
সগিরা যখন কবিরা হয়ে যায় :
অনেক মানুষ সগিরাকে তুচ্ছ মনে করে থাকে; অথচ সে জানে না যে, সগিরা গুনাহ অনেক সময় কবিরা হয়ে যায়। যেসব স্থানে সগিরা গুনাহ কবিরা গুনাহ হয়ে যায় :
- ১. বারবার সগিরা গুনাহে লিপ্ত হলে অথবা সগিরা গুনাহ অভ্যাসে পরিণত হলে তা আর সগিরা গুনাহে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা কবিরা গুনাহে পরিণত হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, গুনাহ হওয়ার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে কবিরা গুনাহ থাকে না। তবে বারবার সগিরা গুনাহ করে গেলে তা আর সগিরা গুনাহ থাকে না, কবিরা হয়ে যায়।
- ২. প্রকাশ্যে সগিরা গুনাহ করলে অথবা সগিরা গুনাহ করার পর দুঃখ না পেয়ে আনন্দিত হলে অথবা সগিরা গুনাহ করার পর গুনাহ নিয়ে গর্ব করলে এই গুনাহ আর সগিরা থাকে না, কবিরা হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ، وَإِنَّ مِنَ المُجَاهَرَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ، فَيَقُولَ: يَا فُلاَنُ، عَمِلْتُ البَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ.
“আমার উম্মতের সকল সদস্য ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে, কেবল যারা প্রকাশ্যে পাপ করে যায় তারা ব্যতীত। প্রকাশ্যে পাপ করার অর্থ হল, কোনো ব্যক্তি রাতে খারাপ কাজ করল; আল্লাহ তার এ কাজটি গোপন রাখলেন কিন্তু দিনের বেলায় সে লোকদের বলতে থাকল, হে শুনেছ! আমি গতরাতে এই এই করেছি। রাতে তার প্রতিপালক যা গোপন করলেন দিনের বেলায় সে তা প্রকাশ করে দিল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৯)
অন্যকে গুনাহের কথা বলার দ্বারা গুনাহের সাক্ষী হয়ে যায়। তাই গুনাহ হয়ে গেলে কাউকে বলা উচিত না। আল্লাহর কাছে তাওবা করা আবশ্যক।
- ৩. যিনি সগিরা গুনাহ করলেন, তিনি যদি মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য হয়ে থাকেন, তাহলে মানুষ তার কারণে এ গুনাহকে গুনাহ মনে করবে না। মনে করবে, তার মত মানুষ যখন এ কাজ করতে পারে, তাহলে আমরা করলে দোষ কি? ফলে তাদের এ গুনাহের অংশ তারও বহন করতে হতে পারে। তাই ওলামায়ে কেরাম ও নেতৃস্থানীয় লোকদের অনেক সতর্কতার সাথে চলা উচিত। তাদের একটি ছোট্ট গুনাহের কারণে আরও অনেক মানুষ এই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে তার জন্য এই সগিরা গুনাহটি কবিরা গুনাহে পরিণত হয়ে যেতে পারে।
বান্দার হক, আল্লাহর হক :
গুনাহ দুই ধরনের হয়ে থাকে। হয়তো আল্লাহর হক নষ্ট করার কারণে গুনাহ হবে কিংবা বান্দার হক নষ্ট করার কারণে হবে। আল্লাহর হককে বলা হয় হুকুকুল্লাহ; আর বান্দার হককে বলা হয় হুকুকুল ইবাদ। কেউ নামায পড়ল না, রোযা রাখল না, হজ করল না তাহলে সে আল্লাহর হক নষ্ট করার গুনাহে লিপ্ত হল। আরেক ব্যক্তি মানুষের টাকা চুরি করল, অন্যের জমি অবৈধভাবে দখল করে রাখল; তাহলে সে বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহে লিপ্ত হল। আল্লাহর হকের চেয়ে বান্দার হকের গুরুত্ব বেশি। কারণ, আল্লাহ তাআলা নিজের হক ইচ্ছে করলে মাফ করে দিতে পারেন; কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করলে আল্লাহ তাআলা নিজে মাফ করবেন না। এটা আল্লাহর নিয়ম ও নীতি না। যার জক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করলে আল্লাহও মাফ করে দিবেন। দুনিয়াতে বান্দার হকের মাফ করাতে না পারলে আখেরাতে মাফ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ, আখেরাতের ভয়াবহ দিনে আপন মা নিজ সন্তানকে চিনবে না, এমন মারাত্মক অবস্থা হবে। তখন কোনো মানুষ নিজে বিপদে পড়লে অন্য কারও কথা ভাবতে পারবে না। সে নিজের পাওনা মাফ করবে না। বরং পাওনা পুরোপুরি ভাবে উসুল করবে।
হাদিসের মধ্যে এসেছে :
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রأَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ؟ قَالُوا: المُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রالمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي مَنْ يَأْتِي يَوْمَ القِيَامَةِ بِصَلَاتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا فَيَقْعُدُ فَيَقْتَصُّ هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْتَصّ مَا عَلَيْهِ مِنَ الخَطَايَا أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
“হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জানো প্রকৃত দরিদ্র কে? সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের মাঝে দরিদ্র তো হল সে ব্যক্তি যার কোনো দিনার-দিরহাম টাকাপয়সা ও সম্পত্তি নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমার উম্মতের মুফলিস হল সে ব্যক্তি যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন নামায, সাওম যাকাত বহু আমলসহ উপস্থিত হবে, এরই সঙ্গে ওকে সে গালি-গালাজ করেছে, তাকে সে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের মাল আত্মসাৎ করেছে, তমুককে খুন করেছে, কাউকে মেরেছে ইত্যাদি ধরনের অপরাধসহ সে উপস্থিত হবে। অনন্তর তার নেক আমল থেকে অমুককে তমুককে বদলা দেওয়া হতে থাকবে। তার জিম্মায় যেসব অপরাধ আছে সেসবের বদলা নেওয়া শেষ হওয়ার পূর্বেই যদি তার নেক আমল ফুরিয়ে যায় তবে ঐসব মজলুম ব্যক্তিদের গুনাহসমূহ এনে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। শেষে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ২৪১৮)
আল্লাহর হকসমূহ ইচ্ছা করলে তিনি মাফ করে দিতে পারেন; কিন্তু বান্দার হকসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বান্দার অনুমতি ছাড়া মাফ করবেন না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন :
يُؤْتَى بِالعَبْدِ يَوْمَ القِيَامَةِ أَوْ الأَمَةِ يَوْمَ القِيَامَةِ، فَيُنَادِي مُنَادٍ عَلَى رُؤُوسِ الأَوَّلِينَ وَالآخِرِينَ: هَذَا فُلانُ بنُ فَلانٍ مَنْ كَانَ لَهُ حَقٌّ فَليَأْتِ إِلَى حَقِّهِ، فَتَفْرَحُ المَرْأَةُ أَنْ يَكُونَ لَهَا الحَقُّ عَلَى أَبِيهَا أَوْ أُمِّهَا أَوْ أَخِيهَا أَوْ زَوْجِهَا ثُمَّ قَرَأَ: {فَلَا أَنسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءلُونَ} فَيَغْفِرُ الله مِنْ حَقِّهِ مَا يَشَاءُ، وَلا يَغْفِرُ مِنْ حُقُوقِ النَّاسِ شِيْئًا فَيُنْصَبُ لِلنَّاسِ، فَيَقُولُ: ائْتُوا إِلَى النَّاسِ حُقُوقَهُم، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ فَنِيْتْ الدُّنْيَا، مِنْ أَيْنَ أُوتِيهُمْ حُقُوقَهُمْ؟ فَيَقُولُ: خُذُوا مِنْ أَعْمَاله الصَّالِحَةِ فَأَعْطُوا كُلَّ ذِي حَقِّ حَقَّهُ بِقَدْرِ مَظْلَمَتِهِ، فَإِنْ كَانَ وَلِيًّا للهِ فَفَضَلَ لَهُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ ضَاعَفَهَا الله لَهُ حَتَّى يُدْخِلَهُ بِهَا الجَنَّةَ، ثُمَّ قَرَأَ: {إِنَّ اللهَ لاَ يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا} وَإِنْ كَانَ عَبْدًا شَقِيًّا قَالَ المَلِكَ: رَبِّ فَنِيَتْ حَسَنَاتُه وَبَقِيَ طَالِبُونَ كَثِيرٌ، فَيَقُولُ: خُذُوا مِنْ سَيَّئَاتِهِم فَأَضِيفُوهَا إِلَى سَيِّئَاتِهِ، ثُمَّ صُكُّوا لَهُ صَكًّا إِلَى النَّارِ.
“কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর সকল বান্দা-বান্দিকে একত্রিত করা হবে। এরপর একজন ঘোষক পৃথিবীর সূচনা থেকে শেষপর্যন্ত সকল মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করবে, এই ব্যক্তি অমুকের ছেলে অমুক। তার কাছে কারও পাওনা থাকলে সামনে এসে পাওনা নিয়ে যাও। তখন নারী খুশি হবে, তার পিতার কাছে, তার মায়ের কাছে, তার ভাইয়ের কাছে বা তার স্বামীর কাছে তার পাওনা রয়েছে। এরপর তিনি কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন فَلَا أَنسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلَا يَتَسَاءلُونَ যার অর্থ : ‘সেদিন পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অন্যের খোঁজখবর নেবে না।’ [সূরা মুমিনুন : ১০১] তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের হকসমূহ যতটুকু তাঁর ইচ্ছা তিনি মাফ করে দিবেন; তবে বান্দার হকসমূহ থেকে তিনি কিছুই মাফ করবেন না। অতঃপর মানুষের বিচারের নিক্তি দাঁড় করানো হবে। আল্লাহ বলবেন মানুষের কাছ থেকে মানুষের হকসমূহ দিয়ে দাও। ফেরেশতারা বলবে, তাদের দুনিয়ার অর্থসম্পদ ফুরিয়ে গেছে, কোত্থেকে পাওনাদারদের হক দেবো? তখন আল্লাহ বলবেন, তাহলে তাদের নেক আমলসমূহ পাওনাদারদের তাদের জুলুমের পরিমাণ অনুযায়ী দিতে থাকো। ওই লোক যদি আল্লাহর বন্ধু হয় তাহলে তার সামান্য পরিমাণ সওয়াব বাকি থাকলেও আল্লাহ তাআলা এই সওয়াবকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। অতঃপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন : إِنَّ اللهَ لاَ يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا ‘নিশ্চয় আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। আর কোনো পুণ্য কাজ থাকলে আল্লাহ সেটাকে বহুগুণ বর্ধিত করেন।’ [সূরা নিসা : ৪০]
আর যদি সে দুর্ভাগ্যবান হয়ে থাকে, তাহলে ফেরেশতারা বলবে, হে আমাদের রব! তার সওয়াব শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু তার পাওনাদার এখনও বাকি রয়ে গেছে। তখন আল্লাহ বলবেন, পাওনাদারদের গুনাহগুলো তার গুনাহের সাথে যুক্ত করে দাও। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করো।” (ইমাম যাহাবি রচিত আল-কাবায়ের : ১০৯)
তাই আল্লাহর হকের চেয়ে বান্দার হকের গুরুত্ব অনেক বেশি। কোনো বান্দার হক নষ্ট হয়ে গেলে দুনিয়ায় তার হক পরিশোধ করতে হবে, পরিশোধ করতে না পারলে তার কাছ থেকে মাফ নিতে হবে। মাফ নিতে না পারলে আখেরাতে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও ভুলে যাবে। যে মা সন্তানকে পেটে ধারণ করেছে, সেও সন্তানকে ভুলে যাবে। বলবে, আমার নসন্তান আসবে কোত্থেকে? আমি তো বিয়েই করিনি। সবাই পলায়ন করবে। কেউ কাউকে সামান্য সহযোগিতা করবে না। দুনিয়াতে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ালেও আখেরাতে কেউ কারও জন্য দাঁড়াবে না।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে :
يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (৩৪) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (৩৫) وَصاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (৩৬) لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ
“সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও তার বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও তার সন্তানসন্ততি থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকবে।” (সূরা আবাসা, আয়াত : ৩৪-৩৭)
আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না :
গুনাহ ও পাপের শাস্তি না দেখে আনন্দিত ও নির্ভার হওয়ার কিছু নেই। অনেক মানুষ বলে বেড়ায়, কত পাপ করলাম কই কিছু তো হল না। হতে পারে আল্লাহ তাআলা তাকে ঢিল দিচ্ছেন, আরও সুযোগ দিচ্ছেন; যখন ধরবেন একসাথে ধরবেন। পাপ করতে থাকলে আর ওদিকে নেয়ামত বন্ধ না হলে এই আশঙ্কা রয়েছে যে, আল্লাহ তাকে ছাড় দিচ্ছেন। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ধৃত-পাকড়াও করার কৌশল মাত্র। কারণ, আল্লাহ তাআলা ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। আজ হোক কাল হোব বিচার হবেই। হতে পারে এখন তাকে ঢিল দেওয়া হচ্ছে।
পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে এ প্রসঙ্গে বক্তব্য এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে :
فَذَرْنِي وَمَنْ يُكَذِّبُ بِهَذَا الْحَدِيثِ سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ.
“অতএব ছেড়ে দাও আমাকে এবং যারা এ বাণী প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে। আমি তাদেরকে ধীরে ধীরে এমনভাবে পাকড়াও করব যে, তারা জানতে পারবে না। আর আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে থাকি, আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ।” (সূরা কলম, আয়াত : ৪৪-৪৫)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে :
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ خَيْرٌ لِأَنْفُسِهِمْ إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ لِيَزْدَادُوا إِثْمًا وَلَهُمْ عَذَابٌ مُهِينٌ.
“কাফিরগণ যেন কখনো মনে না করে, আমি অবকাশ দিই তাদের মঙ্গলের জন্য; বরং আমি অবকাশ দিয়ে থাকি যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়। তাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৭৮)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
عَنْ أَبِي مُوسَى رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُগ্ধ قَالَ: ثُمَّ قَرَأَ: {وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ القُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ}
“হযরত আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা অত্যাচারীকে অবকাশ দেন। যখন তাকে পাকড়াও করা হয়, তখন সে দিশেহারা হয়ে যায়। অতঃপর তিনি কুরআনের এ আয়াত তেলাওয়াত করলেন : ‘এ রকমই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি। তিনি শাস্তি দান করেন জনপদসমূহকে, যখন তারা জুলুম করে। (সূরা হুদ, আয়াত : ১০২। সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৬৮৬)
এরপরও কি গুনাহের পাল্লা ভারি হবে! : বান্দার নেকি-বদী লিপিবদ্ধ করা হয়; কেয়ামতের দিন বান্দার সামনে তা মেলে ধরা হবে। ছোট বড় সবকিছু লেখা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার দয়া দেখুন- নেক কাজের ইচ্ছা করলেই একটি নেকি লেখা হয় আর সে নেক কাজটি করলে দশ থেকে সাতশটি পর্যন্ত নেকি লেখা হয়; কখনো আল্লাহ আরো বাড়িয়ে দেন। পক্ষান্তরে কেউ যদি কোনো গুনাহের ইচ্ছা করে, তো যতক্ষণ গুনাহটি না করে ততক্ষণ কোনো গুনাহ লেখা হয় না। তারপর যদি গুনাহটি করে ফেলে তখন মাত্র একটি পাপ লেখা হয়।
مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ.
“কেউ কোনো সৎ কাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু একটি পাপের শাস্তিদেওয়া হবে। আর তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।” (সূরা আনআম ৬ : ১৬০)
হাদিসে কুদসীতে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
إِذَا هَمّ عَبْدِي بِحَسَنَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا، كَتَبْتُهَا لَهُ حَسَنَةً، فَإِنْ عَمِلَهَا كَتَبْتُهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ إِلَى سَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ، وَإِذَا هَمّ بِسَيِّئَةٍ وَلَمْ يَعْمَلْهَا، لَمْ أَكْتُبْهَا عَلَيْهِ، فَإِنْ عَمِلَهَا كَتَبْتُهَا سَيِّئَةً وَاحِدَةً.
“বান্দা যখন কোনো নেক কাজের ইচ্ছা করে, উক্ত নেক কাজ না করলেও (এ ইচ্ছার কারণে) একটি নেকি লেখা হয়। যদি সে নেক কাজটি করে তাহলে দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত নেকি লেখা হয়। আর যখন কোনো গুনাহের ইচ্ছা করে, কিন্তু ওই পাপ কাজটি করে না; তখন (এ ইচ্ছার কারণে) কোনো গুনাহ লেখা হয় না। হাঁ, যদি ওই পাপ কাজটি করে বসে তখন মাত্র একটি পাপ লেখা হয়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১২৮)
কোথায় এক আর কোথায় দশ থেকে সাতশ! এছাড়া গুনাহ মাফ হওয়ার বিভিন্ন প্রসঙ্গ তো রয়েছেই। এই আমল করলে পিছনের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়। ওই আমল করলে গুনাহ মাফ। এর পরও কি নেকির পাল্লা ভারি হবে না!
পৃথিবী-ভর্তি পাপও তিনি ক্ষমা করেন :
বান্দা নিজের পাপ দেখে নিজেই নিরাশ হয়ে যায়- আমি যত পাপ করেছি, আমার ক্ষমা নেই। বান্দার পাপের সীমা আছে, কিন্তু রহমানুর রাহীমের ক্ষমার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একটি হাদিসে কুদসীতে এরই একটা উদাহরণ টেনেছেন আল্লাহ তাআলা। বান্দা! কত গুনাহ করেছ? তোমার গুনাহ দ্বারা পৃথিবী পূর্ণ হয়ে গেছে, আসমান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তোমার পাপরাশি! শিরক থেকে মুক্ত হয়ে, তওবা করে ফিরে আস আমার কাছে, সকল পাপ ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না!
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেছেন :
يَا ابْنَ آدَمَ إِنّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السّمَاءِ ثُمّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمّ لَقِيتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.
বনি আদম! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকতে থাকবে, আমার কাছে (ক্ষমার) আশা করতে থাকবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না। বনি আদম! তোমার পাপরাশি যদি মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও আমি ক্ষমা করে দিব; কোনো পরোয়া করব না। বনি আদম! তুমি যদি পৃথিবী-ভর্তি পাপ নিয়ে আমার কাছে আস এবং শিরক থেকে মুক্ত হয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর আমি পৃথিবী-ভর্তি ক্ষমা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব। (সুনানে তিরমিযি, হাদিস ৩৫৪০)
নিরাশ হয়ো না, তিনি সব গুনাহ মাফ করে দেন :
পাপের বোঝায় ন্যুব্জ কোনো বান্দা মনে করতে পারে- আমার গুনাহ তো অনেক বেশি; কয়েক পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যাবে আমার পাপ দ্বারা। মদ, যিনা, হত্যা, লুণ্ঠন কোন পাপ নেই যা আমি করিনি; জীবনটাই কেটেছে পাপের মাঝে। এখন আর তওবা করে কী হবে? তাছাড়া আমার মত পাপীকে কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন!
তো এমন পাপীর জন্যও আল্লাহ ক্ষমার ঘোষণা দিলেন- তুমিও নিরাশ হয়ো না আল্লাহর রহমত থেকে; তোমারও সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত-
কিছু মুশরিক নবীজির কাছে এল, যারা মানুষ হত্যা করেছে; অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে। যারা যিনা করেছে; প্রচুর পরিমাণে যিনা করেছে। তারা বলল, আপনি যা বলেন এবং যেদিকে আহ্বান করেন তা তো খুব সুন্দর ও উত্তম। যদি আপনি আমাদের বলতেন যে, আমাদের অতীত পাপের কাফফারা আছে! তখন নাযিল হল-
وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ يَلْقَ أَثَامًا (৬৮) يُضَاعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَيَخْلُدْ فِيهِ مُهَانًا (৬৯) إِلَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ عَمَلًا صَالِحًا فَأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا.
“এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না। এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে বধ করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। কেয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে। এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সর্বদা থাকবে। তবে কেউ তওবা করলে, ঈমান আনলে এবং সৎকর্ম করলে, আল্লাহ এরূপ লোকদের পাপরাশিকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা ফুরকান ২৫ : ৬৮-৭০)
এবং নাযিল হল-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
বলে দাও, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর অবিচার করেছ- আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার ৩৯ : ৫৩)
সূরা যুমারের ৫৩ নং আয়াতের তাফসীরে ইবনে কাসীর রাহ. কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করেন। এরপর বলেন-
فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ كُلّهَا دَالّةٌ عَلَى أَنّ الْمُرَادَ: أَنّهُ يَغْفِرُ جَمِيعَ ذَلِكَ مَعَ التّوْبَةِ…
এসকল হাদিস থেকে বুঝা যায়, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য, আল্লাহ সকল গুনাহ ক্ষমা করেন- তওবার শর্তে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা যুমার, ৫৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
আল্লাহ ক্ষমা করার জন্য বাহানা তালাশ করেন :
দেখুন, বান্দা যখন তওবা করে ফিরে অসে তখন আল্লাহ শুধু ক্ষমাই করেন না, বরং ক্ষমার জন্য বাহানা তৈরি করেন। বনি ইসরাঈলের নিরানব্বই হত্যাকারীর ঘটনা অনেকেরই জানা। সে তওবা করে ফিরে এল এবং নেককারদের এলাকার দিকে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে যখন তার মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে এল তখন রহমত ও আযাবের ফিরিশতা এল এবং প্রত্যেকে তার জান কবয করতে চাইল। এক পর্যায়ে ফয়সালা হল, সে যদি নেককারদের এলাকার কাছাকাছি হয় রহমতের ফিরিশতারা তাকে নিয়ে যাবে, অন্যথায়…। উক্ত ঘটনার যে দিকটি আমাদের আলোচ্য বিষয় তা হল-
فَأَوْحَى الله إِلَى هَذِهِ أَنْ تَقَرّبِي، وَأَوْحَى الله إِلَى هَذِهِ أَنْ تَبَاعَدِي، وَقَالَ: قِيسُوا مَا بَيْنَهُمَا، فَوُجِدَ إِلَى هَذِهِ أَقْرَبَ بِشِبْرٍ، فَغُفِرَ لَهُ.
আল্লাহ নেককার লোকদের ভূমিকে বললেন, তুমি নিকটবর্তী হও। আর অপর ভূমিকে বললেন, তুমি দূরবর্তী হও। তারপর যখন ভূমির দূরত্ব মাপা হল, দেখা গেল সে নেককারদের এলাকার দিকে এক বিঘত এগিয়ে রয়েছে। তখন তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল (এবং রহমতের ফিরিশতা তার জান কবয করল)। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৪৭০)
একটু লক্ষ্য করুন, ঘটনার বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, সে নেককারদের ভূমির দিকে এগিয়ে ছিল না। আল্লাহর আদেশে তা নিকটবর্তী হয়েছে। অর্থাৎ সে যখন তওবা করে ফিরে এসেছে তো আল্লাহ তার ক্ষমার জন্য নিজ রহমতে বাহানা তৈরি করে দিয়েছেন! হ্যাঁ, আল্লাহ এমনই গাফুরুর রাহীম। প্রয়োজন শুধু একটু এগিয়ে আসা। এ যেন ঐ হাদিসেরই একটি বান্তব উদাহরণ, যে হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ تَقَرّبَ إِلَيّ بِشِبْرٍ تَقَرّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا…
বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে আমি বান্দার দিকে এক হাত এগিয়ে আসি…। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৭৪০৫)
পাপের পর করণীয় কী? :
গুনাহ ও পাপ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানুষের দ্বারা গুনাহ হতেই পারে। তবে অস্বাভাবিক ও আশ্চর্যের ব্যাপার হল গুনাহের পর হঠকারিতা করা, গুনাহের জন্য অনুতপ্ত না হওয়া এবং আল্লাহর দিকে ফিরে না আসা। ক্লাসের কোনো ছাত্র অপরাধ করার পর যদি শিক্ষককের সাথে বাদানুবাদ করে, তার অপরাধকে অপরাধ মনে না করে তাহলে তাকে আর বিদ্যালয়ে রাখা যায় না। এই অপরাধ অমার্জনীয়। তদ্রুপ আল্লাহ তাআলার নাফরমানি করার পর অনুতপ্ত না হয়ে আনন্দিত হওয়া হঠকারিতার তুল্য। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করার নামান্তর। তো গুনাহ হলে গেলে কিছু করণীয় রয়েছে। এর দ্বারা গুনাহের ক্ষতি কম হবে এব গুনাহের পরিণামও বন্ধ হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তাআলা গুনাহ ক্ষমাও করে দিতে পারেন। গুনাহের পর কিছু করণীয় উল্লেখ করা হল :
- এক. গুনাহের পরপর নেক কাজ করা :
عَنْ أَبِي ذَرٍّ قَالَ: قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اتَّقِ اللهِ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ.
“হযরত আবু যর গিফারি রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তুমি যেখানেই থাকো না কেন আল্লাহকে ভয় করো। গুনাহের পরপর নেক কাজ করো, তাহলে নেকি গুনাহকে দূরীভূত করে দিবে। মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করো।” (সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ১৯৮৭)
গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো নেককাজ করা উচিত। দানসদকা, কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামায, জিকির আজকার যে কোনো ইবাদত করলে পাপকাজ মাফ হয়ে যায়। তবে কবিরা গুনাহ হলে তাওবা করতে হবে। কারণ, কবিরা গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না।
- দুই. গুনাহের পর ইস্তেগফার পড়া, তাওবা করা :
আমরা জানি, কবিরা গুনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না। সগিরা গুনাহ তাওবা ছাড়াই নেক আমলের মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। তবে গুনাহ সগিরা হোক বা কবিরা সকল গুনাহের পরেই ইস্তেগফার করা উচিত এবং খাঁটি মনে তাওবা করা আবশ্যক। বিশেষত কবিরা গুনাহের ক্ষেত্রে তাওবা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। তাওবার নিয়ম ও শর্ত মেনে তাওবা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সূরা নূর : ৩১)
আল্লাহ তাআলা আরও ইরশাদ করেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত, নবী ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না। তাদের আলো তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের আলো পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন; নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে সর্বক্ষমতাবান।” (সূরা তাহরিম, আয়াত : ৮)
তাওবা করলে আল্লাহ তাআলা তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। তাকে পছন্দ করেন। বান্দার তাওবায় আল্লাহ তাআলা কেমন খুশি হয়ে থাকেন, একটা হাদিসে তার নমুনা দেওয়া হয়েছে।
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ الْمُؤْمِنِ، مِنْ رَجُلٍ فِي أَرْضٍ دَوِّيَّةٍ مَهْلِكَةٍ، مَعَهُ رَاحِلَتُهُ، عَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَنَامَ فَاسْتَيْقَظَ وَقَدْ ذَهَبَتْ، فَطَلَبَهَا حَتَّى أَدْرَكَهُ الْعَطَشُ، ثُمَّ قَالَ: أَرْجِعُ إِلَى مَكَانِيَ الَّذِي كُنْتُ فِيهِ، فَأَنَامُ حَتَّى أَمُوتَ، فَوَضَعَ رَأْسَهُ عَلَى سَاعِدِهِ لِيَمُوتَ، فَاسْتَيْقَظَ وَعِنْدَهُ رَاحِلَتُهُ وَعَلَيْهَا زَادُهُ وَطَعَامُهُ وَشَرَابُهُ، فَاللهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ الْعَبْدِ الْمُؤْمِنِ مِنْ هَذَا بِرَاحِلَتِهِ وَزَادِهِ .
“আল্লাহ তার বান্দার তাওবায় ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি আনন্দিত হন, যে তার উট হারিয়ে ফেলেছে এক জনমানবশূন্য ভয়ংকর প্রান্তরে। উটের পিঠে ছিল খাদ্য ও পানীয়। এরপর সে ঘুমিয়ে পড়ল। জাগ্রত হয়ে সে আবার উটের খোঁজে বের হল। একসময় তার তৃষ্ণা পেল। সে মনে মনে বলল, যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাই। অতঃপর মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি। মৃত্যু অবধারিত জেনে বাহুতে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ল। জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল, হারিয়ে যাওয়া উট তার পাথেয় ও খাদ্য-পানীয় নিয়ে তার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ব্যক্তি তার উট ও পাথেয় ফিরে পেয়ে যতটুকু খুশি হয়েছে তার থেকেও অধিক খুশি হন আল্লাহ তাআলা বান্দার তাওবায়।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৪৭)
যতবার পাপ ততবার তওবা :
পাপ যতবার তাওবাও ততবার। পাপ হলেই তাওবা করা উচিত। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
إِنَّ عَبْدًا أَصَابَ ذَنْبًا – وَرُبَّمَا قَالَ أَذْنَبَ ذَنْبًا – فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ – وَرُبَّمَا قَالَ: أَصَبْتُ – فَاغْفِرْ لِي، فَقَالَ رَبُّهُ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي، ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ أَصَابَ ذَنْبًا، أَوْ أَذْنَبَ ذَنْبًا، فَقَالَ: رَبِّ أَذْنَبْتُ – أَوْ أَصَبْتُ – آخَرَ، فَاغْفِرْهُ؟ فَقَالَ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي، ثُمَّ مَكَثَ مَا شَاءَ اللَّهُ، ثُمَّ أَذْنَبَ ذَنْبًا، وَرُبَّمَا قَالَ: أَصَابَ ذَنْبًا، قَالَ: قَالَ: رَبِّ أَصَبْتُ – أَوْ قَالَ أَذْنَبْتُ – آخَرَ، فَاغْفِرْهُ لِي، فَقَالَ: أَعَلِمَ عَبْدِي أَنَّ لَهُ رَبًّا يَغْفِرُ الذَّنْبَ وَيَأْخُذُ بِهِ؟ غَفَرْتُ لِعَبْدِي ثَلاَثًا، فَلْيَعْمَلْ مَا شَاءَ .
“এক বান্দা পাপ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো অপরাধ করে ফেলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি অবগত তার একজন প্রতিপালক আছে, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন? আচ্ছা আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। এরপর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলে সে আরেকটা পাপে জড়িয়ে পড়ল; এবং বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমার দ্বারা পুনরায় অপরাধ সংঘটিত হয়ে গিয়েছে, আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি অবগত তার একজন প্রতিপালক আছেন, যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন? আচ্ছা আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। এরপর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলে আবার সে একটি পাপ করে বসল, ও বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তো অপরাধ করে ফেলেছি আমাকে ক্ষমা করুন। এ কথা শুনে প্রতিপালক বললেন, আমার বান্দা কি জানে তার একজন প্রতিপালক আছেন যিনি অপরাধ ক্ষমা করেন এবং শাস্তি দেন? আচ্ছা আমি আমার বান্দাকে তিনবার ক্ষমা করলাম। এরপর যা ইচ্ছে সে করতে পারে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫০৭)
তাই পাপ যতবারই হোক ততবারই তাওবা করতে থাকুন।
- তিন. পাপের কথা প্রকাশ না করা :
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
كُلُّ أُمَّتِي مُعَافًى إِلَّا المُجَاهِرِينَ، وَإِنَّ مِنَ المُجَاهَرَةِ أَنْ يَعْمَلَ الرَّجُلُ بِاللَّيْلِ عَمَلًا، ثُمَّ يُصْبِحَ وَقَدْ سَتَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ، فَيَقُولَ: يَا فُلاَنُ، عَمِلْتُ البَارِحَةَ كَذَا وَكَذَا، وَقَدْ بَاتَ يَسْتُرُهُ رَبُّهُ، وَيُصْبِحُ يَكْشِفُ سِتْرَ اللَّهِ عَنْهُ.
“প্রকাশ্যে পাপকারীরা ব্যতীত আমার সকল উম্মত ক্ষমাপ্রাপ্ত। প্রকাশ্যে পাপ করার মধ্যে এটাও যে, রাতে কোনো ব্যক্তি খারাপ কাজ করল। আল্লাহ তার এ কাজটি গোপন রাখা সত্তে¡ও সে দিনের বেলায় বলে বেড়াল শুনছেন! আমি গত রাতে এই-এই করেছি। সে রাত কাটাল এ অবস্থায় যে, তার প্রতিপালক তার পাপ গোপন করে রাখলেন; আর তার সকাল হল এ অবস্থায় যে, আল্লাহ যা গোপন করলেন সে তা ফাঁস করে দিল।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৬৯; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৯০)
সুতরাং কারও পাপ হয়ে গেলে তার উচিত হবে গোপন করে রাখা। কেননা, আল্লাহ তা গোপন রেখেছেন। পাশাপাশি পাপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। পাপের সম্পৃক্ততায় আসার পর কীভাবে তার প্রতিকার সম্ভব, এ ব্যাপারে প্রাজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তবে প্রশ্ন করার সময় গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশে এভাবে বলতে হবে যে, যদি কোনো ব্যক্তি এই ধরনের পাপ করে বসে তাহলে তার প্রতিকার কী?
- চার. প্রকাশ্য পাপ হলে সম্মিলিত প্রতিবাদ আবশ্যক :
অনেক পাপ আছে প্রকাশ্যে করা হয়। কেউ ব্যক্তিগতভাবে পাপ করলে সেটার দায়িত্ব তার। কিন্তু কোনো পাপ সমাজে ছড়িয়ে পড়লে এবং প্রকাশ্যে পাপ হতে থাকলে সম্মিলিত প্রতিবাদ করা আবশ্যক। পাপকাজ থেকে পাপীদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করা না হলে সমাজের সকলেই গুনাহগার হবে। মনে করুন, আপনি গাড়িতে চড়ে কোথাও যাচ্ছেন। কেউ কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু গাড়ির মধ্যে লাউড স্পিকার দিয়ে গান বাজানো হচ্ছে। সকলেই গুনাহগার হচ্ছে। তাই প্রকাশ্যে সকলে মিলে প্রতিবাদ করতে হবে। এলাকায় গানবাদ্যের আয়োজন চলছে। সকলের সম্মিলিত প্রতিবাদ আবশ্যক। সৎকাজের আদেশের সাথে সাথে অসৎকাজের নিষেধও জরুরি। এ ব্যাপারে অলসতা ও গাফিলতি প্রদর্শন প্রকারান্তরে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য সমূহ বিপদ ডেকে আনবে, সন্দেহ নেই। পাপ নির্মূলের চেষ্টা না করে যদি পাপের সাথে সহাবস্থানের মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে তবে শাস্তি নাযিল হওয়া অবধারিত। ইরশাদ হয়েছে :
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (৭৮) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
“বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফুরি করেছিল, তারা দাউদ ও মারইয়াম-তনয় ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত হয়েছিল এ এজন্য যে, তারা ছিল অবাধ্য ও সীমালংঘনকারী। তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা হতে তারা একে অন্যকে বারণ করত না। তারা যা করত, তা অতীব নিকৃষ্ট।” (সূরা মায়েদা :৭৮-৭৯)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “যারা আল্লাহ তাআলার সীমারেখার ভিতরে এবং যারা সীমারেখা লংঘন করে তাদের দৃষ্টান্ত ঠিক এমন, কিছু লোক একটি জাহাজের যাত্রী। কিছু সংখ্যক উপর তলায় আর কিছু সংখ্যক নিচতলায় আরোহণ করেছে। কিন্তু নিচের তলার যাত্রীদের পানির জন্য উপর তলায় যেতে হয়। তারা চিন্তা করল আমরা উপরে পানি আনার জন্য গেলে উপর তলার লোকজন বিরক্ত হয়, তাই আমরা যদি জাহাজ ফুটো করে আমাদের জন্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করি তাহলে ভালোই হয়। এমতাবস্থায় যদি উপর তলার লোকজন নিচতলার এই অবুঝ লোকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা না দেয়, তাহলে জাহাজ ডুবে গিয়ে উভয় তলার যাত্রীগণ প্রাণ হারাবেন নিঃসন্দেহে। আর যদি তারা বাধা প্রদান করে, তাহলে উভয় তলার যাত্রীরা বেঁচে যাবেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩১৩)
এমনিভাবে সমাজের ভালো লোকেরা যদি পাপাচারে লিপ্তদের পাপ কাজে বাধা না দেন, তাহলে এ পাপের কারণে যে দুর্যোগ নেমে আসবে, তা থেকে কেউ রেহাই পাবে না।
- পাঁচ. পাপকে ছোটো ও তুচ্ছ মনে না করা :
পাপ হয়ে গেলে পাপকে ছোটো ও তুচ্ছ মনে করা যাবে না। কেউ পাপকে তুচ্ছ মনে করলে ওই পাপ ছেড়ে দেওয়া এবং পাপ থেকে তাওবা করতে পারবে না। বরং ওই পাপে সে বারংবার লিপ্ত হবে।
হাদিসে এসেছে :
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্রإِيَّاكُمْ وَمُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ فَإِنَّمَا مَثَلُ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ كَقَوْمٍ نَزَلُوا فِي بَطْنِ وَادٍ، فَجَاءَ ذَا بِعُودٍ، وَجَاءَ ذَا بِعُودٍ حَتَّى أَنْضَجُوا خُبْزَتَهُمْ، وَإِنَّ مُحَقَّرَاتِ الذُّنُوبِ مَتَى يُؤْخَذْ بِهَا صَاحِبُهَا تُهْلِكْهُগ্ধ
“হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা অীত সামান্য গুনাহ থেকেও বিরত থাকো। ক্ষুদ্র গুনাহে লিপ্ত হওয়ার উদাহরণ ওই পর্যটক দলের মতো, যারা একটি উপত্যকায় অবতরণ করল। অতঃপর তাদের একজন একটি কাষ্ঠখন্ড নিয়ে এলো। অপরজন আরেকটি নিয়ে এলো। আর এভাবেই তাদের রুটি ছেঁকা সম্পন্ন হল। এবং ছোটো গুনাহের কারণে যদি কাউকে পাকড়াও করা হয় তবে তা তার ধ্বংসের কারণ হবে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন :
إِنَّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنَّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنَّ الفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرَّ عَلَى أَنْفِهِ
“ঈমানদার ব্যক্তি পাপকে এমন মনে করে যে, সে পাহাড়ের পাদদেশে বসে আছে। ভয় করছে, যে কোনো সময় পাহাড়টি তার ওপর ভেঙে পড়বে। আর পাপী ব্যক্তি পাপকে মাছির মতো মনে করে। যা তার নাগের ডগা স্পর্শ করে চলে গেছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৯৭)
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন :
إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا، هِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعَرِ، إِنْ كُنَّا لَنَعُدُّهَا عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ المُوبِقَاتِ
“এমন অনেক কাজ তোমরা কর, যা তোমাদের নজরে চুলের চেয়েও সরু; অথচ আমরা রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক পাপ বলে জ্ঞান করতাম।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৯২)
ইবনুল মুতায [ابْنُ الْمُعْتَزّ] বলেছেন :
خَلِّ الذُّنُوبَ صَغِيرَهَا … وَكَبِيرَهَا فَهُوَ التُّقَى
كُنْ مِثْلَ مَاشٍ فَوْقَ أَرْضِ … الشَّوْكِ يَحْذَرُ مَا يَرَى
لا تُحَقِّرَنَّ صَغِيرَةً … إِنَّ الْجِبَالَ مِنَ الْحَصَى
ছেড়ে দাও পাপ ছোটো বড় সব; এটাই পরহেযগারি। কণ্টকাকীর্ণ জমিনে পথচলা ব্যক্তির ন্যায় সতর্ক দৃষ্টি সক্রিয় করো। তোমাদের পাপের মধ্যে যেগুলো ছোটো, তুচ্ছ জ্ঞান করো না সেগুলোকেও ছোটো ছোটো পাথর দিয়েই তো গঠিত হয়েছে সুবিশাল পর্বত।
কবিরা গুনাহের তালিকা :
কুরআন ও হাদিসে কয়েকটি গুনাহকে কবিরা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন চুরি, হত্যা, যিনা, সুদ, ঘুষ, পিতা-মাতার অবাধ্যতা ইত্যাদি। এছাড়া মূলনীতির আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম অনেক গুনাহকে কবিরা গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা যাহাবি রহ. এর কিতাব থেকে কবিরা গুনাহের একটি তালিকা দেওয়া হল।
- ১. শিরক এবং এমন সকল বিশ্বাস ও কর্ম যা দ্বারা কুফরি অনিবার্য হয়ে পড়ে।
- ২. ইচ্ছাকৃত কাউকে হত্যা করা।
- ৩. জাদু করা।
- ৪. ফরয নামায ত্যাগ করা বা ওয়াক্তের পূর্বে নামায আদায় করা।
- ৫. যাকাত প্রদান না করা।
- ৬. শরিয়ত অনুমোদিত কোনো ছাড় ব্যতীত রমযানের রোযা ত্যাগ করা অথবা রমযানের রোযা রেখে ভেঙ্গে ফেলা।
- ৭. হজ ফরয হওয়া সত্তেও আদায় না করেই মৃত্যুবরণ করা।
- ৮. পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়া এবং যে সকল বিষয়ে তাদের বাধ্য ও অনুগত হওয়া জরুরি সে সকল বিষয়ে তাদের অবাধ্য হওয়া।
- ৯. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা।
- ১০. যিনা-ব্যভিচার করা।
- ১১. অস্বাভাবিক পন্থায় স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়া।
- ১২. সুদের লেনদেন করা অথবা সুদের কারবারের লিখক বা সাক্ষী হওয়া।
- ১৩. অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করা।
- ১৪. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা।
- ১৫. জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা।
- ১৬. রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক প্রজাদেরকে ধোঁকা দেয়া ও খিয়ানত তথা দুর্নীতি করা।
- ১৭. অহংকার করা।
- ১৮. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া বা কারো হক নষ্ট হতে দেখেও সাক্ষ্য প্রদান না করা।
- ১৯. মদ বা নেশাকর অন্য কোনো বস্তু পান করা।
- ২০. জুয়া খেলা।
- ২১. সচ্চরিত্র কোনো নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া।
- ২২. গনিমতের মালের খিয়ানত করা।
- ২৩. চুরি করা।
- ২৪. ডাকাতি করা।
- ২৫. মিথ্যা শপথ করা।
- ২৬. কারো প্রতি যে কোনোভাবে জুলুম করা।
- ২৭. অন্যায় ট্যাক্স আদায় করা।
- ২৮. হারাম সম্পদ ভক্ষণ করা, পান করা বা পরিধান করা অথবা ব্যয় করা।
- ২৯. আত্মহত্যা করা বা নিজের কোনো অঙ্গ কর্তন করা।
- ৩০. মিথ্যা কথা বলা।
- ৩১. শরিয়তের আইনের বিপরীতে বিচার পরিচালনা করা।
- ৩২. ঘুষ নেয়া।
- ৩৩. নারীদের পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করা বা পুরুষের নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা।
- ৩৪. নিজের পরিবার-পরিজনের মধ্যে অশ্লীল কর্ম হতে জেনেও তা বাধা না দেয়া।
- ৩৫. তিন তালাকপ্রাপ্তা নারীকে তার পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল করার উদ্দেশ্যে তাকে বিবাহ করে তালাক প্রদান করা।
- ৩৬. শরীর বা কাপড়ে পেশাব লাগা থেকে বেঁচে না থাকা।
- ৩৭. মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো আমল করা।
- ৩৮. দুনিয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে ইলমেদীন হাসিল করা এবং ইলমেদীনকে গোপন করা।
- ৩৯. খিয়ানত করা।
- ৪০. কারো প্রতি অনুগ্রহ করে খোঁটা দেয়া।
- ৪১. তাকদির তথা ভাগ্যের লিখনকে মিথ্যা মনে করা।
- ৪২. মানুষের গোপন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, গোয়েন্দাগিরী করা।
- ৪৩. চোগলখুরী করা।
- ৪৪. অভিশাপ করা।
- ৪৫. ধোঁকা দেয়া ও অঙ্গিকার ভঙ্গ করা।
- ৪৬. গণক ও জ্যোতিষীকে সত্যায়ন করা।
- ৪৭. স্বামীর নাফারমানী করা।
- ৪৮. ছবি আঁকা বা ঘরে ছবি টানানো।
- ৪৯. কারো মৃত্যুতে বিলাপ করা, মুখ থাপড়ানো, কাপড় ছেড়া, মাথা মুÐানো বা নিজের ধ্বংসের দুআ করা।
- ৫০. আল্লাহদ্রোহী হওয়া, মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া।
- ৫১. আল্লাহর মাখলুককে নির্যাতন করা।
- ৫২. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া।
- ৫৩. মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া ও তাদেরকে মন্দ বলা।
- ৫৪. বিশেষ করে আল্লাহ নেক বান্দাদেরকে কষ্ট দেয়া।
- ৫৫. টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা।
- ৫৬. পুরুষের রেশম ও স্বর্ণ পরিধান করা।
- ৫৭. গোলাম মনিবের থেকে পলায়ন করা।
- ৫৮. আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে কোনো প্রাণী জবাই করা।
- ৫৯. জেনে-বুঝে নিজের পিতা ব্যতীত অন্য কাউকে পিতা বলে স্বীকার করা। অর্থাৎ এরূপ দাবী করা, অমুক ব্যক্তি আমার পিতা অথচ সে তার পিতা নয়।
- ৬০. বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করা।
- ৬১. কারো প্রয়োজন সত্তে¡ও অতিরিক্ত পানি তাকে না দেয়া।
- ৬২. ওজনে কম দেয়া।
- ৬৩. আল্লাহ তাআলার গ্রেফতার সম্পর্কে নির্ভীক হওয়া।
- ৬৪. আল্লাহর অলীদের কষ্ট দেয়া।
- ৬৫. জামাআতের নামায আদায় করার ব্যাপারে গুরুত্ব না দেয়া।
- ৬৬. কোনো শরয়ি ওযর ছাড়াই জুমার নামায ত্যাগ করা।
- ৬৭. কোনো ওয়ারিছের ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে ওছিয়ত করা।
- ৬৮. ধোঁকা দেয়া ও প্রতারণতা করা।
- ৬৯. মুসলমানদের গোপন বিষয় প্রকাশ করা।
- ৭০. কোনো সাহাবিকে গালিগালাজ করা।
গুনাহ ও কবিরা গুনাহ সংক্রান্ত কিতাবের তালিকা :
আরবি ভাষায় গুনাহ ও কবিরা গুনাহ সংক্রান্ত বিবরণ দিয়ে অনেক কিতাব রচিত হয়েছে। এ সংক্রান্ত কিতাব ছাড়াও চরিত্র ও আত্মউন্নয়নমূলক কিতাবপত্রেও গুনাহের বিবরণ উল্লেখ হয়েছে। যেমন ইমাম গাযালি রহ. এর এহয়াউ উলুমুদ্দিন, ইবনুল কাইয়িম রহ. এর মাদারেজুস সালেকিন ইত্যাদি। কয়েকটি কিতাবের নাম নিচে দেওয়া হল। তন্মধ্যে আমাদের জানামতে কেবল ইমাম যাহাবি রহ. এর রচিত কিতাবটির অনুবাদ হয়েছে; আর কোনো কিতাবের বঙ্গানুবাদ হয়নি। আরবি কিতাবগুলো পড়তে চাইলে গুগলে সার্চ দিলে পিডিএফ পাওয়া যাবে। আর মাকতাবা শামেলাতেও রয়েছে।
- লেখাটি মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমী কর্তৃক প্রকাশিতব্য খুতুবাতে আরও বিস্তারিত পাওয়া যাবে।