

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা স. এর মেরাজে গমনের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা পবিত্র শবে মে’রাজ কাল।
দেশব্যাপী বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) দিবাগত রাতে ১৪৪২ হিজরির পবিত্র শবে মেরাজ উদযাপন হবে।
মূলত হিজরি তথা আরবি মাস হিসেবে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে শবে মি’রাজ পালিত হয়। আগামী ২২ মার্চ রজব মাসের ২৬ তারিখ হয়। সে হিসেবেই ২২ মার্চ দিবাগত রাতে মেরাজের রাত হিসেবে গণনা হবে
লাইলাতুল মিরাজ বা মিরাজের রাতকে আমাদের দেশে সাধারণত শবে মিরাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামের আলোচনামতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত প্রাপ্তির একাদশ বছরের (৬২০ খ্রিস্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) এর সঙ্গে বোরাকে চড়ে পবিত্র কাবা থেকে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে সপ্তম আকাশের ওপর আরশে আজিমে আল্লাহর দিদার লাভ করেন।
মুসলমানরা এবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে এ রাতটি পালন করেন। তবে কিছু ইসলামী স্কলারদের মধ্যে এই দিবস পালনের ক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে। তারা ইসলামে কোন দিবস পালনকে সঠিক মনে করেন না।
তবে বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরামদের মতে, ইসলামে মিরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে, কেননা এ মিরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক (ফরজ) করা হয় এবং এ রাতেই দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের জন্য নিয়ে আসেন নবী মুহাম্মদ (সা.)।
এ রাতে প্রত্যেক মুসলমানদের নফল নামাজ আদায় করা, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা, দান খয়রাত করা,অধিক পরিমানে তাসবিহ তাহলিল, যিকির আযকার করার পাশাপাশি তাওবা ইস্তেগফার ও কান্নাকাটি করে ইসলাম বহির্ভূত কাজে লিপ্ত না হয়ে ফযিলতপুর্ন এই রাতকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অতিবাহিত করা ই বাঞ্ছনীয়।
শবে মে’রাজ উপলক্ষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারর মসজিদ আলোচনা সভা দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করবে বলে এক বিজ্ঞপ্তি জানিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে গত বছর (১৪৪১ হিজরি) শবে মেরাজের কোনো আয়োজন করেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এ বছর যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা ও দোয়া-মোনাজাত।
বৃহস্পতিবার বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ‘মিরাজুন্নবী (সা.)’-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মুশফিকুর রহমান। আলোচনা করবেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা রফিক আহমাদ ও জামেয়া ইসলামিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ।
উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ১৪৪২ হিজরির জমাদিউল উখরা মাস ৩০ পূর্ণ হয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি রোববার রজব মাস গণনা শরু হয়েছে। সে হিসাবে ২৬ রজব দিবাগত রাতে অনুষ্ঠিত হবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিবিজড়িত মিরাজ উপলক্ষে আয়োজিত দোয়া-মাহফিল ও মোনাজাত শীর্ষক পবিত্র শবে মেরাজ।
- শবে মি’রাজ নিয়ে বিশেষভাবে লিখেছেন তরুণ আলোচক ও জনপ্রিয় ইসলামিস্ট মুফতী রেজাউল করীম আবরার।
শবে মেরাজ উপলক্ষে আমাদের সমাজে কিছু নামায এবং রোযা প্রসিদ্ধ রয়েছে। বিশেষত মেরাজের রাতে মসজিদের মিম্বরে মিম্বরে কিছু হাদীস এ রাতের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে শুনানো হয়। ‘মকসুদুল মুমীনীন’ এবং ‘বারো চান্দের ফযীলত’ নামক অনির্ভরযোগ্য কিতাবাদির কারণে এ ধরণের বেদয়াত আমল সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে।
প্রথমে ‘বারো চান্দের ফযীলত’ থেকে বর্ণনাগুলো শুনি। সেখানে বলা হয়েছে- “এক বর্ণনায় রয়েছে: শবে মি’রাজের রাত্রিতে দুই রাকায়াতের সূরা ফাতিহার পরে তিনবার করিয়া সূরা ইখলাস পাঠ করিবে। এবং দুই রাকায়াতের পর ২০০ বার দরুদ শরীফ পাঠ করিবে এবং হাত তুলিয়া আল্লাহর কাছে মুনাজাত করিবে। এই নামাযী ব্যক্তি অসংখ্য সওয়াব লাভ করিবে, তাহার ঈমান মুজবুত হইবে এবং আল্লাহর রহ,ত বর্ষিত হইতে থাকিবে।
অন্য এক বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে, শবে মি’রাজের রজনীতে দুই রাকয়াতের নিয়তে মোট চার রাকয়াত নামায আদায় করিবে। এই নামাযের প্রত্যেক রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পরে যে কোনো সূরা মিলাইয়া পাঠ করিবে। নামায শেষ করতঃ কালেমায়ে তামজীদ, দরুদ শরীফ ও তওবায়ে ইস্তিগফার প্রত্যেকটি ১০০ বার করিয়া পাঠ করিবে। অতঃপর সিজদায় যাইয়া আল্লাহ তায়ালার দরবারে যেই সমস্ত বিষয় নেক আকাংখা করিবে, তিনি তাহা কবুল করিবেন”। ( বার চান্দের ফযীলত, পৃষ্টা নং ২৩)
এ ধরণের কোন নামাযের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। সবগুলো মানুষের বানানো এবং বানোয়াট। প্রথমত শবে মেরাজ কোনোদিন? সেটা নির্ধারিত নয়। বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। শবে মেরাজের নামায সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো সম্পর্কে কিছু মুহাদ্দিসদের বক্তব্য নকল করছি।
প্রথমেই বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন –
لم يرد في فضل شهر رجب، ولا في صيامه، ولا في صيام شيء منه، – معين، ولا في قيام ليلة مخصوصة فيه – حديث صحيح يصلح للحجة، وقد سبقني إلى الجزم بذلك الإمام أبو إسماعيل الهروي الحافظ، رويناه عنه بإسناد صحيح، وكذلك رويناه عن غيره،
অর্থাৎ রজব মাসের মর্যাদা, সে মাসে রোযা রাখা এবং সে মাসের বিশেষ কোনো রাতের নামাযের ফযীলত সম্পর্কে দলীলযোগ্য কোনো সহীহ হাদীস নেই। আমার পূর্বে দৃঢ়তার সাথে এমনটা বলেছেন হাফেজ ইমাম আবু ইসমাইল আল হারাওয়ী। আমরা তাঁর থেকে সহীহ সনদে এমনটা বর্ণনা করেছি। এমনভাবে অন্য থেকেও এমনটা বর্ণিত হয়েছে। ( তাবয়িনুল আািব বিমা ওয়ারাদা ফি শরহি রজব, পৃষ্টা নং ২, মাকতাবাতুশ শামেলা।)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী এখানে স্পষ্ট বলেছেন যে, রজব কোনো রাতের বিশেষ নামাযের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। শবে মেরাজ যেহেতু আমাদের দেশে সাতাশ তারিখে পালন করা হয়, সুতরাং এ রাতের বিশেষ নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
আল্লামা ইববে রজব হাম্ভলী রহ. বলেন –
ومن أحكام رجب ما ورد فيه من الصلاة والزكاة والصيام والإعتمار فأما الصلاة فلم يصح في شهر رجب صلاة مخصوصة تختص به
অর্থাৎ রজব মাসের বিশেষ কোনো নামায সহীহভাবে প্রমাণিত নয়। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্টা নং ১৬৪, দারুল হাদীস কাহেরা।) শবে মেরাজের বিশেষ নামাযের যে বর্ণনা পূর্বে ‘বার চান্দের ফযীলত’ এর হাওয়ালায় উল্লেখ করা হয়েছে, তার আরবী পাঠ হলো নিম্নরুপ:
من صلى فيه اثنتي عشرة ركعة يقرأ في كل ركعة فاتحة
لكتاب وسورة ويتشهد في كل ركعتين ويسلم في آخرهن ثم يقول سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر مائة مرة ويستغفر مائة مرة ويصلي على النبي مائة مرة ويدعو لنفسه ما شاء ويصبح صائما فإن الله يستجيب دعاءه كله إلا أن يدعو في معصية
বর্ণনাটি সম্পর্কে আল্লামা আবদুল হাই লাভনভী রহ. বলেন –
أخرجه البيهقي من طريق عيسى غنجار عن محمد بن الفضل بن عطية وهو من المتهمين بالكذب عن أبان وهو أيضا متهم عن أنس مرفوعا وأدخله ابن حجر في تبين العجب في الموضوعات
অর্থাৎ বর্ণানাটি ইমাম বায়হাকী মুহাম্মাদ বিন ফাযল বিন আতীয়া এর ও সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি মিথ্যার অভিযোগে অভিযোক্ত। মুহাম্মাদ বিন ফাযল বর্ণনা করেন আবান থেকে। তিনিও মিথ্যার অভিযোগে অভিযোক্ত। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ‘তাবয়িনুল আযাব’- এ হাদীসটিকে জাল বলেছেন। ( দেখুন, তাবয়িনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফি শাহরি রাজাব, পৃষ্টা নং ২১. মাকতাবাতুশ শামেলা। আল আছারুল মারফুআ, পৃষ্টা নং ৪৮) এ ধরণের আরেকটি বর্ণনা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. উল্লেখ করেছেন এবং জাল বলেছেন।
মোটকথা হলো, শবে মেরাজ উপলক্ষে কোনো বিশেষ নামায বা রোযা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের এ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের নির্দেশ দেননি। এজন্য শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো ইবাদত করা বেদয়াত।
- এ ছাড়াও শবে মে’রাজ নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের একটি ফতোয়া রয়েছে। ফতোয়াটি এখানে উল্যেখ করা হলো –
২৭ই রজব মেরাজের রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে নামায পড়া এবং অতিরিক্ত ছাওয়াবের আশায় পরের দিন রোযা রাখার কোনো ভিত্তি নেই
প্রশ্ন: ২৭ই রজব তথা মেরাজের রাতে নফল ইবাদত করা এবং ওই দিনে রোযা রাখা কি বিদআত? (পাকিস্তান থেকে)
উত্তর: ২৭ই রজবের রজনীই যে মেরাজের রাত এটা নিয়েই তো মুহাদ্দিসীন ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাছাড়া হাদীসের গ্রন্থগুলোতে এই রাতে গুরুত্বের সাথে ইবাদত করার কথা পাওয়া যায় না। এই রাতে বিশেষভাবে ইবাদতের সম্পর্কে যে বর্ণনাগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো দলীলের উপযোগী নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি অন্যান্য রাতের মতো এই রাতেও স্বাভাবিকভাবে ইবাদত করে এতে কোনো সমস্যা নেই। এমনিভাবে এই রাতের পরের দিন রোযা রাখার ব্যাপারেও কোনো সহীহ হাদীস নেই। আর লোকমুখে যে প্রসিদ্ধ আছে—‘এই দিনের রোযা এক হাজার রোযার সমান’, এই কথার কোনো ভিত্তি নেই।
দারুল ইফতা দারুল উলূম দেওবন্দ, সাহারানপুর, উত্তর প্রদেশ, ভারত। ফতোয়া নং- ৩৩৪৫১
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ‘সহীহ বুখারী’র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারীতে’ বলেন, ‘মেরাজ একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে। কিছু স্বপ্নে, আর কিছু সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। অসংখ্য সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, কুরআনে বর্ণিত মেরাজ নবুওয়তের পর সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে। আর এটাই আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাআতের অভিমত।
তবে এ মেরাজটি মদীনায় হিজরতের কতদিন পূর্বে হয়েছে? এ নিয়ে ওলামায়ে কেরামের প্রায় ১০টি মতামত পাওয়া যায়:
১. হিজরতের ৬ মাস পূর্বে।
২. ৮ মাস পূর্বে।
৩. ১১ মাস পূর্বে।
৪. ১২ মাস পূর্বে।
৫. ১৪ মাস পূর্বে।
৬. ১৫ মাস পূর্বে।
৭. ১ বছর ৫ মাস পূর্বে।
৮. ১ বছর ৬ মাস পূর্বে।
৯. হিজরতের ৩ বছর পূর্বে।
১০. ৫ বছর পূর্বে।’
(খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২৩৭-২৪৩)।
দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস হযরতুল উস্তায মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী (দা.বা.) বলেছেন, ‘মেরাজের মাস সম্পর্কেও ৫টি অভিমত রয়েছে-
১. রবিউল আওয়াল।
২. রবিউল আখার।
৩. রজব।
৪. রমযান।
৫. শাওয়াল।
আর লোকমুখে প্রসিদ্ধ হলো, মেরাজ হিজরতের ১ বছর পূর্বে ২৭ই রজব সংঘটিত হয়েছে।’ (তুহফাতুল কারী : খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৪৭)।
আবার কেউ কেউ ৩ বছরের এবং দেড় বছরের বর্ণনাকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে কোনো একটি রাতকে নির্দিষ্টভাবে মেরাজের রজনী বলা দুষ্কর। কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্টভাবে দিন-তারিখের কথা উল্লেখ না থাকার কারণে আলেমগণ স্ব স্ব গবেষণা অনুযায়ী নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর যদি ধরেও নিই যে, ২৭ই রজব মেরাজের রাত, তাহলেও তো এই রাতের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং তাবয়ে তাবেয়ীন থেকে বিশেষ কোনো আমল বর্ণিত নেই। তাই কাউকে শবে মেরাজের শুভেচ্ছা জানানো, মেরাজের রাতে বিশেষ পদ্ধতিতে ইবাদত করা এবং পরের দিন বেশি ছাওয়াবের আশায় রোযা রাখা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে।
উর্দূ ফতোয়াটির ভাষান্তর করেছেন- কবির আহমদ কাসেমি।
শবে মি’রাজ নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা রয়েছে এখানে। লিখেছেন, মুফতী মোহাম্মদ এনামুল হাসান :
মি’রাজ আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ হল উর্ধবালোকেগমন বা আহরণ। নবুওয়তের একাদশ মতান্তর দ্বাদশ বছরে রজব মাসের ২৬ তারিখে দিবাগত রাতে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা:) এর পবিত্র শ’বে মি’রাজ সংঘটিত হয়।
পবিত্র মি’রাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আলকোরআনে এরশাদ করেন,’ সুবহানাল্লাজি আসরা বি আবদিহী লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারামে ইলাল মাসজিদিল আকসা’।
অর্থাৎ পবিত্র সেই মহান স্রষ্টা যিনি নিজ প্রিয় বান্দাহকে বোরাকে আরোহণ করিয়ে কাবা ঘর থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নৈশ ভ্রমণ করিয়েছিলেন।
এই মি’রাজ সম্পর্কে আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য ছিল তার প্রিয় বান্দাহকে সৃষ্টিজগৎ আরশে মুয়াল্লাহর কিছু নিদর্শন দেখানো। এবং তার সান্নিধ্য লাভ করানো।
এমন এক সময় রাসুল সা. কে মি’রাজ করানো হয়েছিল যখন মক্কা জুড়ে ইসলামের নবজাগরণ কে স্তব্দ করার জন্য পুরোপুরি ষড়যন্ত্র চলছিল।
মক্কার কাফের সম্প্রদায় রাসুল সা. এর সংস্পর্শে এসে দলেদলে ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে ছিল ঠিক তখনি কাফেরদের সরদারগণ চিন্তা করতে লাগলেন যে এভাবে চলতে থাকলে মক্কার সকল মানুষ তাদের বাপদাদার পৌত্তলিক ধর্ম মক্কার জমিন থেকে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হবে।তাই তারা ইসলামের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
সকল ষড়যন্ত্রে ব্যার্থ হয়ে মুসলমানদের সাথে বয়কট করা ছাড়া আর কোন পথ না দেখে সম্মিলিতভাবে তারা মুসলমানদেরকে শিয়াবে আবু তালিব( আবু তালিবের সত্যাধিকারী পাহাড়ের পাদদেশে)আবদ্ধ করে ফেলে।
মুসলমানদের সাথে মক্কার সকল গোত্র সর্বপ্রকার যোগাযোগ, লেনদেন, বিয়ে শাদী এমনকি দেখাসাক্ষাৎ ও বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ আড়াই বা তিন বৎসর মুসলমানরা তথায় বন্দি অবস্থায় দিনযাপন করেছিলেন।
কাফেরদের এই দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে মুসলমানরা একমাত্র ইসলাম ও মোহাম্মদ সা এর খাতিরে এমন কোন কষ্ট নেই যা তারা সহ্য করেনি। খাদ্যাভাবে মুসলমানদের বৃক্ষলতা খেতে হত।এসব নিঃশেষ হয়ে গেলে মুসলমানরা তৃন খড় পর্যন্ত খেতে হয়ে ছিল।
চারদিক থেকে যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবরোধ চলছিল তখনি রাসুল সা. এর পিতৃব্য আবুতালিব ইন্তেকাল করেন।বয়কট পরিসমাপ্তির কাছাকাছি সময়ে হুজুর সা এর সকল বিপদআপদের সাথী এবং সাহায্যকারী উম্মাহাতুল মুমিনীন হজরত খাদিজা(রা:)ও ইহজগৎ ত্যাগ করেন।
হুজুর সা. এর অতি আপনজন এই দুই ব্যক্তির ইন্তেকালে হুজুর সা. মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন তখন ই রাসুল সা. কে আল্লাহ তায়ালা শান্তনা দেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা রাসুল সা. কে তার সান্নিধ্য লাভ করিয়েছেন।
রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহানবী সা. এশার নামাজ সম্পন্ন করে চাচাতো বোন উম্মেহানীর ঘরে নিদ্রায় নিমগ্ন ছিলেন।এমন সময় জিব্রাইল আ. উপস্থিত হয়ে প্রিয় নবী সা. কে বললেন,হে আল্লাহর নবী, আপনি জাগ্রত হোন।আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার জন্য দ্রুতগামী বাহন ‘বোরাক ‘নিয়ে এসেছি।পূর্ববর্তী সকল নবী রাসুলগণ ও সকল ফেরেশতাগণ আপনাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
মোহাম্মদ সা. জাগ্রত হয়ে প্রথমে অজু করত:দুরাকাত নফল নামাজ আদায়করে আল্লাহর নির্দেশক্রমে পবিত্র বোরাকে আরোহণ করে প্রথমে বায়তুল মুকাদ্দাস এসে পূর্ববর্তী সকল নবীগনের উপস্থিতিতে দু রাকাত নামাজের ইমামতি করেন।
পুনরায় বোরাকে আরোহণ করে উর্ধবলোকে গমন করেন।প্রথম আকাশে হজরত আদম আ. বিশ্বনবী মোহাম্মদ সা. কে অভ্যর্থনা জানান। তারপর দ্বিতীয় আকাশে ঈসা আ: ও ইয়াহিয়া আ:, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ আ: ,চতুর্থ আকাশে ইদ্রিস আ.,পঞ্চম আকাশে হারুন আ.,ষষ্ঠ আকাশে মুসা আ. এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইব্রাহীম আ: এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন।
তারপর বায়তুল মামুর নামক স্থানে ফেরেশতাদের নিয়ে পুনরায় দু রাকাত নামাজ আদায় করেন।এখানে এসে বোরাক থেমে যায়,এবং জিব্রাইল(আ:) বললেন,হে আল্লাহর রাসুল, এ পর্যন্ত ই আমার সীমানা। এরপর এক কদম অগ্রসর হওয়ার শক্তি আমার নেই।
এখান থেকে রফরফ নামক আরেকটি কুদরতি বাহন রাসুল সা. কে আল্লাহতায়ালার আরশে মুয়াল্লাহয় নিয়ে যান।সেথায় আল্লাহতায়ালার সাথে সালাম বিনিময়ের পর কথোপকথন হয়।
আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সেখানে প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ও পরবর্তীতে পাচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতের জন্য হাদিয়া স্বরুপ দেওয়া হয়।তারপর হুজুর(সা:) জান্নাত জাহান্নাম অবলোকন করেন।
আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে অসংখ্য নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন।কিন্তু অসংখ্য নবী রাসুলের মধ্যে কেবলমাত্র আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ সা: ই সকল মাখলুকাতের মধ্যে স্ব-শরীরে মহান আল্লাহ তায়ালার দিদার লাভে সক্ষম হয়েছেন।
পবিত্র শ’বে মি’রাজ আশ্চর্য ও অলৌকিক ঘটনা অবশ্যই। শবে মিরাজ রাতটি সকল উম্মতে মোহাম্মদীর নিকট অত্যন্ত মহিমান্বিত ও ফযিলতপূর্ণ।