হিজাব বিরোধিতা নয়; ঢাবির খরচে টিএসসিতে সীরাত মাহফিলের দাবি

প্রকাশিত: ৮:১৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২১

ইসমাঈল আযহার : পাবলিক ভয়েস

১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবসে টিএসসি চত্বরে নারীর কিছু অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে ব্যানার টাঙায় ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। ছাত্রলীগের কিছু প্রভাবশালী নেতাকর্মী ব্যানার ভেঙ্গে ফেলে। পরে ব্যানার রক্ষা করতে গেলে ইশা ছাত্র আন্দোলনের একাধিক নেতাকর্মীর ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ।

বিশ্ব হিজাব দিবস উপলক্ষে পাবলিক ভয়েসের বিশেষ একটি প্রতিবেদন পড়ুন : 

– বিশ্ব হিজাব দিবস : পর্দা পালনে হিজাব ও বোরকার বিধান

এ ঘটনাকে ন্যাক্কারজনক আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ইসলামী স্কলার, লেখক ও আলোচক মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ। মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে নিজের ফেসবুক পেজে আপলোডকৃত এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে নিন্দা জানানোসহ কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেন।

[মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ।]

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ বলেছেন,

১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব হিজাব দিবসে টিএসসি চত্বরে বাংলাদেশের একটি ছাত্র সংগঠনের (ইশা ছাত্র আন্দোলন) পক্ষ থেকে একটি ব্যানার টাঙানো হয়। সেখানে হিজাব পরিহিত নারীর বিভিন্ন অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে কিছু দাবি জানায় সংগঠনটি। হিজাব পরিহিত নারীরা যেন ক্লাসে পরীক্ষার হলে ক্যাম্পাসে, যেকোনো জায়গায় যেকোনো  ক্ষেত্রে যেন তার প্রতি অবমাননাকর আচরণের শিকার না হয় সেসব দাবি নিয়ে টাঙানো ব্যানারটি ভেঙ্গে ফেলে সেকুলার বলে পরিচয় দেওয়া একটি ছাত্র সংগঠন। যাদের ক্ষমতাশীন সরকারের সম্পর্কও রয়েছে।

ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে  শরীফ মুহাম্মাদ বলেন, যাদের সঙ্গে ক্ষমতার অংশগ্রহণ রয়েছে, সেই ছাত্র সংগঠনের কিছু প্রভাবশালী কর্মী ওই ব্যানারটি ছিঁড়ে ফেলে এবং ব্যানারটি বাঁচাতে গেলে ইসলামী সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে। আমি এই ঘটনাকে  ষড়যন্ত্রমূলক, বাকস্বাধীনতার বিরোধিতামূলক ও সাংঘাতিকভাবে মানবধিতার বিরোধিতামূলক বলে মনে করি।

পূঁজার সময়, হোলি উৎসবের সময়সহ বিভিন্ন সময় নানা রকম উৎসবের একটি আমেজ তারা তৈরি করে। যেখানে হিন্দুদের পূঁজার উৎসব হতে পারে, খ্রিস্টানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে পারে, সেখানে রবিউল আওয়াল মাসে বা অন্য কোনো ইসলামী অনুষ্ঠান টিএসসি চত্বরে অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মাঠে কেন অনুষ্ঠিত হবে না আমি এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখছি।

তিনি বলেন আমরা বাড়তি কিছু চাই না। ইসলাম ধর্ম পালনের অধিকারটুকু চাই। নারীর জন্য ও পুরুষের জন্য। যদি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূঁজার অনুষ্ঠান হতে পারে তাহলে সেখানে তাফসীর ও  সীরাত মাহফিলের দাবি জানাই।  বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচেই সেই অনুষ্ঠান করা হোক, এই দাবিও আমরা তুলি।

তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি- এটা নৈতিক দাবি, এটা মানবতার দাবি, এটা ন্যায্য দাবি। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক বিবেচনা করলেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে এই দাবি বাস্তবায়ন করার প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

প্রসঙ্গত, সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) বেলা তিনটার দিকে বিশ্ব হিজাব দিবস উপলক্ষে ইশা ছাত্র আন্দোলন ঢাবি শাখার টানানো ব্যানার ভাঙচুর করে সার্জেন্ট জহুরুল হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ব্যানার ভাঙচুর করার প্রতিবাদ জানাতে গেলে উগ্র ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। হামলার সময় দুটি স্মার্ট মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মাহমুদুল হাসান, সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল আহসান মারজান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক আবু বকর।

এ বিষয়ে ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম এম শুয়াইব বলেন,  বিনা উস্কানিতে আমাদের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আদর্শকে হামলা দিয়ে নয় আদর্শ দিয়ে মোকাবিলা করুন। সন্ত্রাসী দিয়ে রাজনীতি হয় না বরং চৌকিদারী হয়। চৌকিদারী বন্ধ করে আসুন শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি করি।

এ হামলার বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সংগঠনের নেতাকর্মীরাসহ অনেকেই এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

এ ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার রাতে সাহবাগে বিক্ষোভ মিছিল করে সংগঠনটি। মিছিলে  ‘নেতা নয় নীতি চাই, পীর সাহেব চরমোনাই, জেগেছে রে জেগেছে, ইশা ছাত্র জেগেছে, ভাইয়ের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই, বয়কট বয়কট, ছাত্রলীগ বয়কট, এ ধরণের স্লোগান দিতে শোনা যায়।

মিছিল শেষে ইশা ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শরিফুল ইসলাম রিয়াদ বলেন, বেলা সাড়ে তিনটার দিগে ছাত্রলীগের কর্মীরা ইশা ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ভাঙচুর করে। এর প্রতিবাদ জানাতে গেলে সংগঠনটির নেতাদের ওপর হামলা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ইশা ছাত্র আন্দোলন দেশ ও মানবতাকে ধারণ করে রাজনীতি করে। আমরা সন্ত্রাসীতে বিশ্বাস করি না। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড পশুত্বকেও হার মানায়। বিশ্ব হিজাব দিবস শুধু বাংলাদেশে পারিত হয়নি। হিজাব দিবস পুরো বিশ্বের ১৫০ টি দেশে পালিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি ক্যামপাসে সবাই সবার স্বাধীনতা ও মত প্রকাশ করবে।

ছাত্রলীগের এ হামলাকে ন্যাক্কারজনক আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, এ ছাত্রলীগের এ ঘটনা সংবিধান বিরোধী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি বিরোধী। ইসলামের সংস্কৃতি বিরোধী। তাই প্রশাসনকে বলতে চাই,  অতি দ্রুত হামলাকারীদের চিহ্নত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।

এখানেই শেষ নয়, বিশ্ব হিজাব দিবস উপলক্ষে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের হিজাবের অধিকার রক্ষায় ‘৭ দফা দাবি সম্বলিত কয়েকটি ব্যানার’ সরিয়ে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাত্র মিলনায়তন (টিএসসি) কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ব হিজাব দিবস পালন উপলক্ষে ইশা ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যানারগুলো বসান। বিশেষ করে রাজু ভাস্কর্যসহ টিএসসি ও কয়েকটি জায়গায় ব্যানার বসান তারা। সকাল থেকে ব্যানারগুলো সেখানে থাকলেও কর্তৃপক্ষ দুপুর সাড়ে এগারোটার দিকে ব্যানারগুলো সরিয়ে ফেলে।

ব্যানার সরিয়ে ফেলার বিষয়টি জানিয়ে ইশা ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন – ‘টিএসসি থেকে বের করে দিলো আমাদের ব্যানার। রাজুতেও (রাজু ভাস্কর্য) নাকি সমস্যা! সমস্যা কি? তাদের কি ক্ষতি করে এই ব্যানারগুলো? যেখানে ছাত্রলীগের কয়েকটা ব্যানার ঝুলছে! শুধু কি একটা সমস্যা যে আমাদের নামের সাথে ইসলামী যুক্ত?’

তবে এ বিষয়ে টিএসসির পরিচালক আলী আকবর পাবলিক ভয়েসকে বলেন, আজ পহেলা ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস শুরু হয়েছে এবং টিএসসির সামনে ভাষার মাস নিয়ে কিছু প্রোগ্রাম রয়েছে। তবে ব্যানার অপসারন করা হয়নি বরং সামনে রাস্তায় নিয়ে রাখা হয়েছে যাতে বেশি মানুষ দেখতে পারে। এবং টিএসটি গেট থেকে ব্যানার সরানোর কাজও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর করেছেন।

দিবসটি উপলক্ষে তারা বলেন, হিজাব নারীর স্বাধীন ইচ্ছা ও মৌলিক অধিকারের। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিজাবের উপর অযাচিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নারীর পোষাক পরিধানের ব্যাক্তিগত ও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিজাব পরিহিতা নারীরা নানাভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ ও অসৌজন্যমূলক ব্যবহারের শিকার হচ্ছে। যা অন্যায়ই শুধু নয়, মানবাধিকারেরও মারাত্মক লংঘন।

২০১৩ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকে হিজাব দিবস  উদযাপিত হয়ে আসছে। নানা প্রতিকূলতা ও বিতর্কের মোকাবিলায় বাংলাদেশী বাংশোদ্ভূত নিউইয়র্ক বাসিন্দা নাজমা খান প্রথম বিশ্ব হিজাব দিবস উদযাপনের ডাক দিয়ে বিশ্বের মুসলিম- অমুসলিম সকল নারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যা বর্তমানে প্রতিবছর ১৯০টিরও বেশী দেশের মুসলিম-অমুসলিম নারীরা ঘটা করে পালন করছে।

তারা আরও বলেন, হিজাবের প্রতি বৈষম্য বন্ধে সামাজিক সচেতনা ও আইনগত পদক্ষেপের বিকল্প নেই। তাই সরকারি-বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় সকলকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

মন্তব্য করুন