আ. রহিম রহ : বাংলায় ইসলা‌মি রাজনী‌তির অগ্রনায়ক ও প‌থিকৃত

প্রকাশিত: ১২:১০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২০

মুফতী মনোয়ার হোসাইন :

মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) একজন ক্ষণজন্মা মহা ম‌নীষী। ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন এ বাংলা‌দে‌শের প্র‌তি‌নি‌ধিত্ব ক‌রেছিলেন।

এছাড়াও ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন ও একই বছর করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয় ইসলামী মহাসম্মেলনে ছিলেন বাংলাদেশর প্রতিনিধি।

১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারি সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত শীআ‌দের ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবেও উপস্থিত ছিলেন তিনি।

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহিম (রহ.) বাংলা ভাষায় দ্বীন উপস্থাপনার অসামান্য অবদান রে‌খে‌ গে‌ছেন। বাংলায় ইসলা‌মি রাজনী‌তির অগ্রনায়ক ও প‌থিকৃত বলা চ‌লে তাকে।

তবে শেষ জীব‌নে গণতা‌ন্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্র‌তিষ্ঠার ব্যাপা‌রে তি‌নি দ্বীমত পোষণ ক‌রেন এবং প্র‌চলিত রাজনীতি থে‌কে দূ‌রে সরে দাঁড়ান। ইসলাম বুঝার ক্ষে‌ত্রে মাওলানার রচনাগু‌লো একজন সত্যা‌ন্বেষী মানু‌ষের অপ‌রিহার্য্য বিষয়।

অনা‌লো‌চিত ও আমাদের স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে যাওয়া সময়ের এই শ্রেষ্ঠ মানুষটি চ‌লে যাবার দি‌নে তা‌কে স্মরণ ক‌রা উচিত।

  • আজকের এ দি‌নেই ( ১ অক্টোবর ১৯৮৭) মহান এ মানুষ‌টি চলে যান রফিকে আ‘লার ডাকে।

মাওলানা আবদুর রহিমের জন্ম :

আবদুর রহিম বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার শিয়ালকাঠি গ্রামে ১৯ জানুয়ারি ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজি খবিরউদ্দিন ও মা আকলিমুন্নেসা। পরিবারের ১২ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ।

শিক্ষাজীবন :
নিজ গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী মসজিদে চার বছর শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ১৯৩৪ সালে তিনি শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষাগ্রহণ করেন।

১৯৩৮ সালে তিনি এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তির্ণ হন। এরপর তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন (বর্তমান আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)। এখান থেকে তিনি ১৯৪০ সালে ‘ফাজিল’ ও ১৯৪২ সালে ‘কামিল’ পাশ করেন।

রাজনীতেতে অংশগ্রহণ:
আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র থাকাবস্থায় মাওলানা আবদুর রহিম সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী কর্তৃক সম্পাদিত ম্যাগাজিন ‘তরজমানুল কুরআন’ নিয়মিত পড়তেন। এই ম্যাগাজিন ও সাইয়েদ মওদুদির অন্যান্য রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১৯৪৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিখিল ভারত সম্মেলনে অংশ নেন। এখানে তিনি জামায়াতের অন্যান্য নেতাদের সাথে পরিচিত হন। ১৯৪৬-৪৭ সালের সাংগঠনাক পর্বে তিনি এ সংগঠনে যোগ দেন।

মাওলানা আবদুর রহিম বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা চারজন ব্যক্তির অন্যতম। ১৯৫৫ সালে মাওলানা আবদুর রহিম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচিত হন

তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রথম নেতাদের অন্যতম হ‌লেও শেষ পর্যন্ত তি‌নি এ সংগঠ‌নে ছি‌লেন না। জামায়াতে ইসলামীকে তিনি ঘোষণা দিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তি‌নি ছিলেন একজন বাংলাদেশি ইসলামি পন্ডিত ও খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ।

পরবর্তীতে জামাআত ত্যাগ করে তিনি সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. এর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন) প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন। (উইকিপিডিয়া) চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করীমের সাথে তার সম্পর্কও ভালো ছিলো। তার ইন্তেকালের পর জানাযার নামাজের ইমামতি করেছিলেন সৈয়দ ফজলুল করীম রহ.।

মাওলানা আবদুর রহিম রহ.বেশ কিছু মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থ লিখেছেন তন্মধ্যে কিছু বই হলো-

১. আল কুরআনের আলোকে উন্নত জীবনের আদর্শ (১৯৮০)
২. আজকের চিন্তাধারা (১৯৮০)
৩. পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি (১৯৮৪)
৪. আল কুরআনের নবুয়ত ও রিসালাত (১৯৮৪)
৫. আল কুরআনের আলোকে শিরক ও তাওহিদ (১৯৮৩)
৬. আল কুরআনের রাষ্ট্র ও সরকার (১৯৮৮)
৭. ইসলামের জাকাত বিধান (১৯৮২-১৯৮৬) – ইউসূফ আল-কারযাভীর বইয়ের অনুবাদ
৮. বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত (১৯৮২-১৯৮৬) – সাইয়েদ কুতুবের বইয়ের অনুবাদ
৯. তাফহিমুল কুরআন, ১৯ খন্ড – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর বইয়ের অনুবাদ
১০. ইসলামে হালাল-হারামের বিধান – ইউসূফ আল-কারযাভী। ইউসূফ আল-কারযাভীর বইয়ের অনুবাদ
১১. ইসলামে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ৭০ অধিক গ্রন্থ

কালোত্তির্ণ এই অসামান্য মানুষটি সারা জীবন সত্যের পেছনে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরেছেন। দ্বীন বিজয় করার জন্য তার ছিল বুক ভরা স্বপ্ন। সময়ের ব্যবধানে এ জন্য সিদ্ধান্তও পরিবর্তন করেছেন। বাংলা ভাষায় যে সময় অন্যরা কলম চিনতো না সে সময় তিনি রাত-দিন লিখে গেছেন। দ্বীনি বিষয়গুলো সহজবোধ্য করেছ‌েন। মাওলানা বাংলাদেশের হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন।

এ প্রজন্মও তার সাহিত্য ও দ্বীনি বইগুলো থেকে যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছেন, তবে দল চর্চার এ দেশে তিনি কম চর্চিত ও মূল্যায়িত একজন স্কলার কারণ এ দেশে দলের ঊর্ধে উঠে ভাবার মত উদার পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয় নি।

মৃত্যু :

১৯৮৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ পহেলা অক্টোবর, এই তারিখের দুপুর ১২টার দিকে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। রফিকে আ‘লার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাই‌হি র‌াযেউন।

সফলতা ব্যার্থতার সংমিশ্রণেই এই দুনিয়া। তিনি চলে গেছেন চ‌লে যে‌য়েও র‌য়ে গে‌ছেন বই‌য়ের, খেদ‌মতের পাতায় পাতায়। বাংলা ভাষায় ইসলামের অসামান্য খেদমতমূলক অবদান যেন তার নাজাতের উসিলা হয় সে জন্য দুআ করছি, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করুন ও কবুল করুন। আল্লাহুম্মা আমীন।

লেখক : গবেষক আলেম, ইসলাম বিশ্লেষক, সমাজসেবক ও আলোচক।

মন্তব্য করুন