বিজাতীদের অনুকরণ: হুমকির মুখে উম্মাহ

প্রকাশিত: ২:৩৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০১৯

ফাহাদ আব্দুল্লাহ

যতদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ নিজেদের যাপিত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করতে থাকবে— নিজেদের জীবনে তার প্রত্যেকটা বিধান বাস্তবায়ন করে যাবে, নবিজি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করতে পেরে গর্ব করবে; ততদিন উম্মাহ উন্নতি ও সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে থাকবে। মুসলিমরা নিজেদের সভ্যতা-ভব্যতা ও সংস্কৃতির অনুসৃত রীতিনীতির মাধ্যমেই সুদীর্ঘ এক হাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ও সুবিশাল এক অংশ শাসন করেছে।

পারতপক্ষে সময়টা মুসলিম উম্মাহর অনুকূলে ছিলো— তখন উম্মাহ আভিজাত্য ও মার্জিত চালচলনের ফলে অন্যান্য গোত্র ও গোষ্ঠী মুসলিমদের অনুসরণকে নিজেদের জন্য গৌরব মনে করতো। তদানীন্তন সময়ে অবস্থা ছিলো এমন যে, মুসলিমদের সবকিছুতে অন্যান্য গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়ে যেতো। মুসলিমরা প্রভাব বিস্তাকারী ছিলো আর অন্যরা প্রভাবিত ছিলো মুসলিম উম্মাহ ইসলামের মহান আদর্শের আলোকবর্তিকা নিয়ে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যেও গিয়েছে, সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও মার্জিত সভ্যতার দাবিদার জাতিগোষ্ঠীর সভ্যতা ও ভব্যতার আসল রূপ কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। বেশি সময় গত হয়নি, তারা সেসব প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নগরীগুলো বিজয়ও করেছে— যারা নিজেদের প্রাচীনত্বের ব্যাপারে দম্ভ করতো। ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করতো।

কিন্তু সর্বকালের চির ভাস্বর সত্য তো এই— যাদের চোখ সিরাতে নববির উজ্জ্বল আভায় দীপ্ত হয়েছে এবং যাদের হৃদয় মুহাম্মাদি আদর্শের সমুজ্জ্বল প্রভায় প্রদীপ্ত হয়েছে; পৃথিবীর তাবৎ আদর্শ এবং ফ্যাশন দ্বারা না কখনো তারা প্রভাবিত হবে— আর না বিধর্মীদের বাহ্যিক জাঁকজমক তাদের নববি আদর্শ থেকে বিচ্যুত করে পারবে… কিন্তু কালের আবর্তনে— যুগের বিবর্তনে যখন থেকে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের স্বকীয়তা এবং আদর্শ থেকে দূরে সরতে শুরু করেছে এবং নিজেদের মৌলিক ধ্যান-ধারণা ও চারিত্রিক বিষয়ে অন্য জাতিগোষ্ঠীর অনুসরণ ও অনুকরণ শুরু করতে শুরু করেছে— তখন থেকেই উম্মাহ পৃথিবীর নেতৃত্বের যোগ্যতা হারিয়ে নিঃস্ব হতে শুরু করেছে।

তারপর মানসিক শৃঙ্খলতা এবং লজ্জাজনক সেই সময়ও আসলো— উম্মাহ বিজাতীয় সংস্কৃতির রীতি অনুসরণ করে গর্ববোধ করতে লাগলো। নববি আদর্শের রীতিনীতি অনুকরণে লজ্জা অনুভব করা শুরু করলো। অবক্ষয় এবং অধঃপতনের এই যুগে মুসলমানের মধ্যেই এমন চিন্তাশীল ও জ্ঞানীগুণী তৈরী হয়েছে—যারা বিধর্মীদের কিছু কিছু রীতি অনুসরণকেও আবশ্যক বলেও ব্যক্ত করেছে। আর তার সাথে সাথে পুরো মুসলিম উম্মাহকে মানসিকভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে দিয়েছে।

আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে—আজ আমরা এমন এক অবক্ষয়ের যুগে এসে উপনীত হয়েছি, যে যুগে নববি আদর্শের আমল, রীতি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পর্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা-তদবির চালানো হচ্ছে। নিদেনপক্ষে এই প্রশ্ন তো অবশ্যই করতে হবে— “আচ্ছা! এতে কি উপকারিতা রয়েছে?” যে যুগে শরিয়াহর প্রত্যেকটা বিধানকেই বিবেক-বুদ্ধির পাল্লা দিয়ে মাপতে হচ্ছে…পরখ করতে হচ্ছে বুঝের চাবিকাঠি দিয়ে…আর যখনই বুঝের দুর্বলতার কারণে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারছে না, অমনি অতীতের চৌদ্দশ বছরের উম্মাহর পূর্বসূরিদের ভুল সাব্যস্ত করে বসছে। কিন্তু বিপরীত দিকে পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা প্রত্যেকটা বিষয়কেই ‘কালিমায়ে তাইয়্যেবা’র মতো চোখ বুজে কবুল করে নিচ্ছে।

পাশ্চাত্যের অহেতুক কর্মকাণ্ড এবং অসভ্য রীতিনীতিও গ্রহণ করে নিতে জড়তা বা সামান্য লজ্জাও অনুভব করছে না। সবকিছু এভাবে চলতে থাকলে এই উম্মাহর অধঃপতনের ষোলকলা যেমন পূর্ণ হবে, ঠিক তেমনিভাবে মুসলিম উম্মাহর অনাগত প্রজন্মও এক গুরুতর আশঙ্কার মুখে নিপতিত হবে। তাদের মন ও মনন থেকে তখন ইসলামি মূল্যবোধ তিরোহিত হয়ে যাবে।

মগজ ধোলাই হয়ে যাবে পশ্চিমা সভ্যতার নগ্ন সংস্কৃতি এবং রীতিনীতিতে। ধীরে ধীরে তাদের ভেতর প্রথমে ইসলাম স্রেফ একটা কালচারে পরিণত হবে। তারপর যখন পাশ্চাত্যের ময়লা-আবর্জনা গায়ে মাখা পরিপূর্ণ হবে, তখনই ইসলামকে নিজেদের ভেতরই দাফন করে দিবে। আদতে মুসলিম দাবিদার থাকবে কি না তাতেও ঘোর সন্দেহ রয়েছে। তাই ইসলামি মূল্যবোধ এবং তাহজিব-তামাদ্দুন ও সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে…উম্মাহর বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের মন ও মননে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অটুট রাখতে হলে…তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ ইমানদার হিসেবে দেখতে চাইলে— তাদের হৃদয়ে ইসলামি চেতনাবোধ জাগ্রত করতে হবে। কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণকে তাদের জন্য অনায়াস ও সহজ করে তুলতে হবে।

উম্মাহর জন্য ইসলাম যেন হয় চেতনার বাতিঘর এবং শরিয়াহ যেন হয় প্রেরণার সূতিকাগার— সেজন্য প্রার্থনা করতে হবে। যা আল্লামা ইকবালের চির ভাস্বর কবিতার চরণে ফুটে উঠেছে— ইয়া রাব্ব! দিলে মুসলিম কো… ওয়ে জিন্দা তামান্না দে… জু কলব কো গরমা দে… জু রুহোঁ কো তড়পা দে…

লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী সম্পাদক : আঙিনা

মন্তব্য করুন