ইসরাইলের বর্বরতা : চোখ হারানো কিছু ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ

প্রকাশিত: ৮:৪৬ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০
ইসরাইলের বর্বরতা : চোখ হারানো কিছু ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ

বিশেষ প্রতিবেদন-

গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনের বিক্ষোভ চলাকালীন যখন ইসরাইল বাহিনী কর্তৃক জ্যাকলিন শাহাদার এক চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি কখনও ভাবেননি যে এই চোখ হারানোর কারণে তিনি তার স্বামী ও সন্তানদেরও হারাবেন।

এটি নভেম্বর ২০১৮ সালের কথা। যখন প্রতি শুক্রবারের মতো ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি গাজা-ইসরাইল সীমান্তে জড়ো হয়ে তাদের অধিকারের জন্য বিক্ষোভ করছিলো এবং ১৯৪৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলি বর্বরতার প্রতিবাদ করছিলো।

বিক্ষোভকারীরা দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর প্রতি বড়জোর পাথর নিক্ষেপ এবং টায়ার জ্বালানোর মত প্রতিবাদ করছিলো বিনিময়ে ইসরাইলি বাহিনী গুলি করে জবাব দিচ্ছিলো।

এমন এক সময়েই কয়েক হাজার মিছিলকারীদের মধ্যে ছিলেন ৩০ বছর বয়সি জ্যাকুলিন। যিনিও অংশ নিয়েছিলেন এই বিক্ষোভে। যদিও বিক্ষোভে বেশিরভাগই পুরুষরা ছিলেন কিন্তু তিনি এখানে মহিলাদের অংশগ্রহণকেও সঠিক মনে করতেন।

জ্যাকুলিন শাহাদা যে জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এএফপিকে বলেছেন, ‘আমাকে অন্ধ না করে দিয়ে যদি হত্যা করা হত, তবে আমার জন্য ভালো হত। ছবি : এএফপি।

জ্যাকুলিনের চোখ হারানোর ঘটনা :

তিনি বলেন – বিক্ষোভের মধ্যেই মনে হলো – “হঠাৎ আমার চোখ জ্বলতে লাগল এবং আমি চেতনা হারিয়ে ফেললাম” আমি একটি রাবার বুলেট দ্বারা আঘাত পেয়েছিলাম এবং আমার বাম চোখ হারালাম।

বর্তমানে তার আঘাত এখন খুব কমই দৃশ্যমান – চোখেন আইরিশে একটি টিয়ার সেল আঘাত করেছিলো। এখন সে কিছুটা সুস্থ হলেও দখলদারদের নির্যাতনে গাজায় তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, “আমার ইচ্ছা যদি আমাকে হত্যা করা হত, তবে আরও সহজ হত।”

জ্যাকুলিনের স্বামী সন্তান হারানো ও ভেঙ্গে পড়া :

গণিতে অধ্যয়নরত জ্যাকুলিন এই ঘটনার পর নিজে নিজে ভেতরে ভেঙ্গে পড়েছিলো। তার বাচ্চাদের তাদের প্রতিবন্ধী মা সম্পর্কে স্কুলে টিজ করা হতো এবং তার স্বামী তার উপর বিতৃঞ্চ হয়ে উঠলেন। এমনকি “সমাজের অনেক লোকেরা তাকে দোষ দেয়, তারা বলে: ‘(নারী হিসাবে) আপনি কেন প্রতিবাদে গিয়েছিলেন?'”

তিনি গাজায় এএফপিকে বলেছেন, “আমি আশা করেছিলাম যে আমার (প্রতিবাদে অংশ নেওয়ায়) পরিবার এবং স্বামী আমার জন্য গর্বিত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি কারণ “আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে এবং আমি আমার বাচ্চাদের হারিয়েছি।”

তিনি দুঃখ নিয়েই বলেন – “আমি যদি একটি হাত হারিয়ে ফেলি তবে তা হয়ত ঠিক হয়ে যাবে, তবে চোখ না থাকলে কীভাবে আপনি আপনার জীবন চালিয়ে যেতে পারেন? তবে তিনি বলেন – “আমি পুরো বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাই, শক্তিশালী থাকতে চাই, তবে ভিতরে আমি ভেঙে পড়েছি”।

  • জ্যাকুলিনের মতই এমন ১০ জন চোখ হারানো ফিলিস্তিনিদের সাথে দেখা করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এএফপি। তাদের মধ্য থেকে আরও দুজনের বর্তমান অবস্থা উল্যেখ করা হলো –

“আমি আমার চোখ ফিরে চাই” : একজন কিশোরের আর্তনাদ

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্যাকুলিনের মতই মালেক ইসা নামের এক কিশোরের এক চোখ নষ্ট করে দিয়েছে ইসরাইল বাহিনী। মালেক ইসা জেরুজালেমের একটি দোকানে স্যান্ডউইচ কিনতে যাওয়ার সময় দখলদার বাহানীর রাবার বুলেটের আঘাত পেয়েছিলো।

মালেক ইসা। জেরুজালেমের একটি দোকানে স্যান্ডউইচ কেনার পরে রাবার বুলেটের আঘাতে চোখ হারানো মালেক ইশাকে যেখানে গুলি করা হয়েছিল সেখানে (নীচে) দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ছবি : এএফপি।

তখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মালেক ইসার বাবা ওয়ায়েল ইসাকে খবর দেয়া হয়েছিলো যে, মালেকের কপালে গুলি লেগেছে।

তখনকার স্মৃতিচারণ করে তাঁর বাবা বলেন – “আমি তাতক্ষণিকভাবে ভেবেছিলাম যে, তাকে অবশ্যই চোখে গুলি করা হয়েছে। এরপর “আমি সেখানে কয়েক মিনিটের জন্য চুপচাপ হয়ে বসে পড়েছিলাম।”

এরপর মালেককে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তার বাবা-মা তাকে খুঁজে পান এবং দেখতে পান যে – তার চোখে গুলি লেগেছে এবং এক চোখ অন্ধ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃ ২০ বছরে ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি কিশোরকে বন্দি করেছে ইসরাইল

তারা বাবা বলেন – “আমার ছেলে ভদ্র, নম্র এবং স্কুলে ভাল নাম্বার পাওয়া মেধাবী ছেলে। কিন্তু ইসরাইলি সৈনিক এসে কোন দোষ ছাড়াই তাকে গুলি করে। ওই সৈনিক কেবল আমার ছেলেকেই গুলি করেননি, সে আমার পুরো পরিবারকে গুলি করেছে এবং আমাদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেন – “রাতে মালেক প্রায়ই চিৎকার করে বলে‘ আমি আমার চোখ চাই, আমার চোখ আবার ফেরত চাই”

চোখ হারানো এক সাংবাদিকের ঘটনা :

কয়েক বছর ধরে ফ্রিল্যান্স ক্যামেরাম্যান মুয়াথ আমারনেহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে অসংখ্য বিক্ষোভের মুথোমুখি হয়েছিলো।

গত বছরের (২০১৯) ১৫ নভেম্বর, তিনি তার ভিডিও ক্যামেরাটি ধরেন এবং তার হেলমেট পরে ছুটে আসেন দক্ষিণের সুরিফ গ্রামে ফিলিস্তিনি একটি বিক্ষোভের দিকে।

তখন “মাটিতে একজন ইসরাইলি স্নাইপার বসে ছিল এবং যার অস্ত্র পাশে পড়ে ছিল। তিনি বলেন – “আমি তখন অনুভব করেছি যে আমাদের একজনের সাথে কিছু ঘটতে চলেছে। দখলদার ইসরাইলি সৈন্যরা আমাদের সাংবাদিকদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছিলো তখন।

এরই মধ্যে “তখন আমি অনুভব করলাম কিছু একটা আমার মুখে লেগে গেছে, আমি ভেবেছিলাম আমার মাথা ছিটকে গেছে”। “আমি দেখলাম আমার মুখে রক্ত ​​ছিল। আমি হাঁটুতে পড়ে গেলাম।” এরপর দেখা গেলো আমি আমার বামচোখ হারিয়ে ফেলেছি।

বাম চোখ হারানো মুয়াথ অমরনেহ দখলকৃত পশ্চিম তীরে হিব্রানের উত্তরে সুরিফ গ্রামে যেখানে তাকে গুলি করা হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘একজন ক্যামেরাম্যান হিসাবে এক চোখ দিয়ে কাজ করা অসম্ভব আমার জন্য। ছবি : এএফপি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তার চোখে একটি রাবার বুলেট ছোড়া হয়েছিল যার ভিতরে বারুদ ছিল। এমনকি এখনও তাঁর চোখে স্ক্যান করলে দেখা যায় চোখের গহ্বরের অভ্যন্তরে কিছু ধাতব অংশ রয়েছে।

এ বিষয়ে মুয়াথ বলেন – “আমার আঘাতটি একটি বার্তা প্রেরণ করে যে আমাদের (সাংবাদিকদের) তোলা ছবিগুলির উপর ইসরাইল সৈন্যদের ভাবমূর্তি নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে তারা বুঝাতে চায় ‘হয় আপনি আমাদের পছন্দ মতো কাজ করবেন বা আপনি মারা যেতে পারেন’।

এভাবেই ইসরাইলের হামলায় চোখ হারানো প্রত্যকের অবস্থাই এমন দুর্বিসহ। এএফপির ১০ জনের মতামত ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে – কেউ কেউ ইসরাইলের সাথে সংঘর্ষে অংশ নিতে গিয়ে চোখ হারিয়েছে। তবে বেশিরভাগই কোন সংঘর্ষে অংশ না নিয়েও ইসরাইল বাহিনী কর্তৃক চোখে আঘাতের সম্মুখিন হয়েছে।

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ইসরাইলিদের প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয় হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে বিভিন্ন লড়াইয়ে গাজা অঞ্চলের প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে ইসরাইলের সাথে তিনটি যুদ্ধের পরে এমন আঘাতজনিত ক্ষতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এমনকি যখন কোনও স্বাভাবিক বিরোধ নেই, তখনও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। কোন কারণ ছাড়াই হামলে পড়ে ইসরাইলিরা। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মার্চ ২০১৮ সালের মার্চ থেকে চলমান বিভিন্ন সহিংসতায় বিশেষ তরে “মার্চ অব রিটার্ন” শ্লোগানে বিক্ষোভ চলাকালীন ৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি ইসরাইলের বুলেটের আগুনে আক্রান্ত হয়েছিল।

সাধারণত গাজা উপত্যকার সীমান্তে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী স্নাইপার ব্যবহার করে যারা নির্দেশনা পেলেই ফিলিস্তিনিদের উপর গুলি চালায়।

জ্যাকুলিনের মামলার পাশাপাশি এভাবে সরাসরি অন্যদোর উপর গুলির ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলে তারা নাকি নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় এমন গুলি চালিয়ে থাকে।

সূত্র : এএফপি, কুদস নিউজ, এপি।

আরও পড়ুনঃ

ইসরাইলের কারাগারে কঠিন রোগেরও চিকিৎসা নেই ফিলিস্তিনিদের

‘আল-আকসায় ফিলিস্তিনি পতাকা না উড়ানো পর্যন্ত মুসলিমরা থামবে না’

১৩ বছরের লকডাউনেও শেষরক্ষা হয়নি ফিলিস্তিনি মুসলিমদের

হাছিব আর রহমান। নির্বাহী সম্পাদক : পাবলিক ভয়েস।

মন্তব্য করুন