যেভাবে রমজান কাটাতেন প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান রহ.

প্রকাশিত: ৪:৩০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৩, ২০২০

শাহ মমশাদ আহমদ –

সিলেটের বরেণ্য আলেম, বাংলাদেশের পরিচিত মুখ আলেমে দ্বীন প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান রহ. ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এক বিরল ব্যাক্তিত্ব। মসজিদের ইমাম। খতিব। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। শিক্ষক। লেখক। অনলবর্ষী বক্তা। ওয়ায়েজ। কামেল বুজুর্গ। রাজনীতিবিদ। সমাজ সেবক। হাদীস বিশারদ। গবেষকসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনুকরণীয় গুনের অধিকারী।

বাতিল রোধে প্রতিবাদ ছিল তার জন্মগত স্বভাব। ইসলাম ও দেশ-জাতি বিরুধী কোন কর্মকান্ড ক্ষনিকের তরে ও বরদাশত করতে পারতেন না। এব্যাপারে হযরতের কঠোরতা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু এ মহান মানুষটির মন ছিল খুবই কোমল। এবাদতের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক মহান বুজুর্গ। রাতের বেলা তিনি থাকতেন মহান রবের দরবারের এক ভিক্ষুক। এদিকটা আমাদের অনেকেরই অজানা।

সাহাবায়ে কেরামের রাযি. গুণ ছিল – তাঁরা ছিলেন দিনের বেলা এক একজন অশ্বারোহী মুজাহিদ। লড়াকু সৈনিক। রাতের বেলা আল্লাহর দরবারে রোদনকারী এক একজন আবেদ। হযরত প্রিন্সিপাল রহ. এর মধ্যে ছিল এ দু’গুনের আজীব সমন্বয়।

সারা বছর কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষী, ছাত্র, আলেম উলামা পরিবেষ্টিত মানুষটিই রমজানে হয়ে যেতেন ব্যতিক্রম। মানুষের সাথে সম্পর্ক কমিয়ে ব্যাকুল থাকতেন এবাদতের স্বাদে। প্রিন্সিপাল রহ. ছাত্র কাল থেকেই রমজানে রাতজাগরন ছিল পারিবারিক অভ্যাস। মাহে রমজানে কখনো রাতে ঘুমাতেন না। সারারাত এবাদতে মগ্ন থাকতেন। ফজর-ইশরাক আদায় করে সকাল দশটা অবধি বিশ্রাম নিতেন। প্রশান্তির সাথে ওজু গোসল সেরে দুপুর পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। জামেয়ায় এসে কিছু সময় শুয়ে শুয়ে পত্রিকায় চোখ বুলাতেন। ভাল আতর ও মিসওয়াক ব্যবহার তার খুবই পছন্দের ছিল। রমজানে অধিক ব্যবহার করতেন। জোহরের আজানের পূর্বেই মসজিদে তাহইয়াতুল মাসজিদ আদায় করে জামাত শুরু হওয়া পর্যন্ত সুন্নাত নামাজ ও জিকিরে মগ্ন থাকতেন। নামাজ শেষে আছরের ত্রিশ মিনিট পূর্ব পর্যন্ত তেলাওয়াত করতেন। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আছর নামাজ আদায়ান্তে মসজিদে তেলাওয়াত শুনতেন। ইফতার পর্যন্ত সন্ধ্যাকালীন আযকার আদায় করতেন। জামেয়াতেই ইফতারের আয়োজন করতেন। বড় বড় থালে ইফতারির আয়োজন হত। নিজেই তদারকি করতেন। সামান্য ইফতার গ্রহণ করে অন্যদের দিকে নজর দিতেন।

আমার উস্তাদদের মধ্যে হযরত মাওলানা নেজাম উদ্দিন রহ., হযরতের সহোদর, সদাহাস্যজ্বল হাফিজ মাওলানা আতিকুর রহমান রহ., হযরত মাওলানা আবুস সুবহান দা:বা:, জনাব মাস্টার সুয়েজ আফযাল খান রহ.সহ অনেকেই প্রিন্সিপাল রহ. এর সাথে এক থালে ইফতার করছেন। সে মনোরম দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। আল্লাহ মরহুমদের জান্নাত দান করুন। সুপারিন্টেন্ডেন্ট হুজুরকে নেক হায়াত দিন। আমীন

প্রিন্সিপাল রহ. ইফতারের পুর্বে অনুচ্চ কন্ঠে يا واسع الفضل اغفر لي বেশী বেশি পড়তেন। নিজ সন্তানদের বাসায় ইফতার না করে মাদ্রাসায় সবার সাথে ইফতার করতে তাগিদ দিতেন। জামেয়ার বর্তমান প্রিন্সিপাল মাওলানা ছামিউর রাহমান মুসা, মুফতি আব্দুর রাহমান ইউসুফ, ইসলামি ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রিয় সভাপতি তারেক বিন হাবিব ও মাওলানা ফজলুর রাহমান তায়েফকে ইফতার আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন।

মাগরিবের নামাজ, সুন্নাত, আওয়াবিন আদায়ের পর তারাবিহ পর্যন্ত হালকা বিশ্রাম নিতেন।সালাতুল এশা, তারাবীহ, বিতির ধীরস্থিরভাবে সমাপ্তির পর সমবেত মুসল্লিদের নিয়ে ফাজায়েলে আমাল কিতাব থেকে তালিম দিতেন। সমসাময়িক মাসআলা মাসাইল ও আলোচনা করতেন। সংক্ষিপ্ত মোনাজাত শেষে নিজ দফতরে আগত মেহমানদের সাক্ষাৎপর্ব সমাপ্ত করে বাসায় যেতেন।

তারপর রাত একটা অবধি বই লেখা, অনুবাদ, প্রবন্ধ রচনা ও বিভিন্ন তাফসিরের কিতাব মুতালায়া (অধ্যয়ন) করতেন। রাত দেড়টা থেকে তাহাজ্জুদের জামাতে নামাজ পড়ে সমবেত মুসল্লিদের নিয়ে জিকির আযকার করে দির্ঘ মোনাজাত করতেন। হৃদয়গ্রাহী মোনাজাতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন অংশ নিতেন। হযরতের মোনাজাতে মুসল্লিদের মনের বাসনা ফুটে উঠত। দূর থেকে শুনা যেত সমন্বিত কান্নাজড়িত কন্ঠে আল্লাহর দরবারে আকুতির আওয়াজ।

প্রিন্সিপাল রহ. রমযানের শেষদশকে নিয়মিত ইতেকাফ করতেন। ইতেকাফে অংশ নেয়া মুসল্লিদের সময় সুযোগমত খোজ খবর নিতেন। ইন্তেকালের পূর্বে দু’বছর শারিরীক অসুস্থতার কারণে ইতেকাফে অংশ নিতে না পেরে খুবই অস্থির ছিলেন। মর্মবেদনায় শিশুদের মত কাঁদতেন। এ দৃশ্য স্মরণ হলে আজও অশ্রু সংবরণ করতে পারিনা।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রাসুল সা. ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমযানে দানশীলতা আরো বেড়ে যেত, (সহীহ মুসলিম)। এ হাদিসের আলোকে প্রিন্সিপাল রহ. রমযানে বেশি দান করতেন। সংগোপনে দানের খবর হুজুরের জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।ইন্তেকালের পর সাহায্যপ্রাপ্তদের বিলাপে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রিন্সিপাল রহ কখনও কারো গীবত করতেন না। পরনিন্দা শুনলে বিরক্ত হতেন। রমজানে পরনিন্দার কুফল বর্ণনা করে ব্যাপক আলোচনা করতেন। প্রত্যেক দোয়া-মোনাজাতে প্রিন্সিপাল রহ. আমাদের আকাবির আসলাফদের স্মরণ করতেন। নিকট অতিতের বুজুর্গদের মধ্যে হযরত শায়খে কৌড়িয়া রহ., হুজুরের মুর্শিদ হযরত শায়খে বদরপুরী রহ., হযরত শায়খে বর্ণভী রহ., হযরত শায়খে বাঘা রহ., হযরত শায়খে মামরখানী রহ., শায়খে ফুলবাড়ী রহ., হযরত গহরপুরী রহ., শায়খুল হাদিস রহ. প্রমুখ উলামায়ে কেরামের জন্য বিশেষ দোয়া করতেন। মাহে রমযানের দোয়ায় তাদের দরজা বুলন্দি কামনা করে চিৎকার করে কাঁদতেন। এমনি ছিল প্রিন্সিপাল রহ. এর আকাবিরদের প্রতি ভালবাসা।

প্রিন্সিপাল রহ. রমযানের মধ্যদশকে আত্মীয়স্বজন, উস্তাদ ও ঘনিষ্ঠদের বাড়িতে ইফতারী পাঠাতেন। আমাদের সামাজিক রেওয়াজের বিপরীত স্বশুর বাড়িতে ও ইফতারী দিতেন। নিজের তত্বাবধানে ইফতারির আইটেম তৈরি করাতেন।

রমযান পর ঈদুল ফিতরের নামাজের ক্ষেত্রে প্রিন্সিপাল রহ. সুন্নাহ অনুযায়ী খুব ভোরে নামাজ আদায় করতেন। কাজির বাজার মাদ্রাসা মাঠে সকাল সাতটায় স্বাভাবিকত ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হত। আলহামদুলিল্লাহ এখনো এ ধারা অব্যাহত আছে। মোটকথা, রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস। প্রিন্সিপাল রহ. এর রমযান ছিল কোরআনময়। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে তাঁর এ প্রিয় বান্দার অনুসরণে মাহে রমযান অতিবাহিত করার তাওফিক দান করেন। আমীন।

[ফেসবুক থেকে নেওয়া]

মন্তব্য করুন