

রাজশাহীর পদ্মায় বর-কনেবাহী দুটি নৌকাডুবিতে নিখোঁজ থাকা নববধূ সুইটি খাতুন পূর্ণির (১৬) মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৯ জনে দাঁড়িয়েছে।
সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে পদ্মার শ্যামনগর এলাকা থেকে তার মৃরদেহ উদ্ধার করা হয়। গতকাল বিকেলে যখন সুইটির খালা আঁখি খাতুনের লাশ উদ্ধার হয় তখন পর্যন্ত সুইটিই একমাত্র বাকী ছিলেন খোঁজ না পাওয়াদের মধ্যে। বেঁচে থাকার আশা না থাকলে বরসহ অন্যান্য স্বজনরা নদীর পাড়েই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিলেন সুইটিকে পাওয়ার আশায়। সব আশা নিরাশা শেষ হলো আজ তার লাশ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে।
রাজশাহীর পদ্মায় বিয়েবাড়ির নৌকাডুবিতে শনিবার পর্যন্ত ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় সর্বশেষ নববধূসহ তিনজন নিখোঁজ ছিলো।
রোববার দুপুরে কনের ফুফাত বোন রুবাইয়া আক্তারের (১৩) লাশ পাওয়া জেলেদের জালে। ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে রাজশাহীর লালন শাহ্ মুক্তমঞ্চের সামনে পদ্মা নদীতে জেলেদের জালে তার লাশ উঠে আসে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লাশটি উদ্ধার করে।
এরপর বিকেল তিনটার দিকে কনে সুইটি খাতুনের খালা আঁখি খাতুনের (২৫) লাশ পাওয়া যায়। রাজশাহী নগরের শ্রীরামপুর এলাকায় যেখানে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে সেখান থেকে নদীর ভাটিতে চারঘাট উপজেলার টাঙ্গন এলাকায় তাঁর লাশ ভেসে ওঠে।
এর আগে এই ঘটনায় শনিবার বিকেলে কনের চাচা শামীম (৪৮) ও তার ৭ বছর বয়সি মেয়ের লাশ উদ্ধারের পর একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রাণপণে মেয়েকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন শামীম। বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন আপন মমতায়। এক মুহুর্তের জন্য মেয়েকে হারাতে চাননি। শেষপর্যন্ত মেয়েকে বুকে জড়িয়েই লাশ হয়ে উঠে আসেন তিনি।
শনিবার বিকালে দুর্ঘটনাস্থলের পাশ থেকে শামীম (৪৮) ও তার মেয়ে মদিনা ওরফে রোসনির (৭) লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। উদ্ধারের সময় শামীমের লাশটি মেয়ে রশ্মিকে বুকে জড়িয়ে রাখা অবস্থায় পাওয়া যায় বলে।
এর আগে নৌকাডুবিতে শামীমের স্ত্রী মনিকার (৪০) লাশও উদ্ধার করা হয়। শামীম কনে সুইটির সম্পর্কে চাচা। এ নিয়ে শামীমের পরিবারের আর কেউ বাকী রইলো না জীনব নিয়ে ফিরে আসার জন্য।
নিহত অন্যরা হলেন- রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ হড়গ্রাম ইউনিয়নের বসুয়া এলাকার আবদুল গাজীর ছেলে রতন আলী (৪০) ও তার মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৬) এবং হড়গ্রাম ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের আসলাম উদ্দিনের ছেলে এখলাক হোসেন (২৪)।
নিখোঁজদের অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে গঠিত কমিটির সমন্বয়কারী আবু আসলাম জানান, নিখোঁজ তিনজনের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। উদ্ধারকাজ চলছে।
এ ঘটনায় রাজশাহী জেলা প্রশাসন সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। দুই কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে।
কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম প্রাথমিকভাবে নৌকাডুবির তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, নৌকা দুটি ছিল ডিঙি। অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে বিপদ ঘটেছে। এ ছাড়া মাঝিরা ছিল অদক্ষ। আর এদের একজন ছিল কিশোর। পাশাপাশি ঝড়ো হাওয়ায় নৌকা দুটি পানিতে তলিয়ে যায়।
রাজশাহীর পবা নৌপুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মেহেদী মাসুদ জানান, ডুবে যাওয়া নৌকা দুটিই উদ্ধার করা হয়েছে। এখন কনে নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের সন্ধানে উদ্ধার তৎপরতা চলছে। বিআইডব্লিউটিএ, নৌ-পুলিশ এবং বিজিবিও উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে।
নৌকাডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহাদাত হোসেন জানান, দুটি নৌকাই ছিল মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকা। এতে পাঁচজন করে জেলে মাছ ধরার জন্য বসে থাকে। সর্বোচ্চ ১০জন যাত্রী এতে কোনোমতে বসতে পারে। সেই জায়গায় তারা ২০-২১জন করে যাত্রী একেকটি নৌকায় উঠেছিলেন। সেই সময় একটু বাতাস উঠেছিল। ঢেউয়ে নৌকায় পানি উঠে যাচ্ছিল। নৌকা বদল করার জন্য যাত্রী দাঁড়িয়েছিলেন। এই সময় দুলনিতে নৌকায় আরও পানি উঠে যায়। এতে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। মাঝি ইঞ্জিন ঠিক করার চেষ্টা করতে করতেই নৌকা ডুবে যায়। দুটি নৌকা একইভাবে ডুবে যায়। তিনি বলেন, তারা এই প্রতিবেদনে সুপারিশ করছেন যে, জেলেদের নৌকা ও যাত্রীবাহী নৌকা আলাদা হতে হবে। যাত্রীদের লাইফজ্যাকেট থাকতে হবে।
প্রসঙ্গত দেড় মাস আগে পদ্মার ওপারে একই উপজেলার চরখিদিরপুর গ্রামের ইনসার আলীর ছেলে আসাদুজ্জামান রুমনের সঙ্গে পবা উপজেলার কর্ণহার থানার শাহীনের মেয়ে সুইটি খাতুন পূর্ণির বিয়ে হয়। কিন্তু তখন বউভাতের অনুষ্ঠান করা হয়নি।
দেড়মাস পর গত বৃহস্পতিবার বরের বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বরপক্ষ কনেকে সেদিন চরখিদিরপুরে নিয়ে যায়। প্রথা অনুযায়ী, পরদিন শুক্রবার কনেপক্ষের লোকজন বর এবং কনেকে আবার কনের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য যায়। ফেরার পথে তাদের দুটি নৌকাই ডুবে যায়।
নৌকা দুটিতে ৪১জন যাত্রী ছিল। এরমধ্যে সর্বশেষ রোববার বিকেল পর্যন্ত কনে সুইটি ছাড়া ৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়। বাকীদের জীবিত উদ্ধার হয়। কেউ ঘটনার সাথে সাথে সাঁতরে তীড়ে উঠে কাউকে উদ্ধারকর্মীরা এবং স্থানীয়রা উদ্ধার করে। এখন কনে সুইটিই একমাত্র নিখোঁজ রয়েছেন।
নিহতরা হলেন: রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ হড়গ্রাম ইউনিয়নের বসুয়া এলাকার আবদুল গাজীর ছেলে রতন আলী (৪০) ও তার মেয়ে মরিয়ম খাতুন (৬), হড়গ্রাম ইউনিয়নের গোবিন্দপুরের আসলাম উদ্দিনের ছেলে এখলাক হোসেন (২৪), কনের চাচা শামীম (৪৮) মেয়ে মদিনা ওরফে রোসনি (৭) ও তার স্ত্রী মনিকার (৪০), ফুফাত বোন রুবাইয়া আক্তার (১৩) এবং খালা আঁখি খাতুন (২৫)। সবশেষে এই মিছিলে যোগ হলো কনে সুইটি খাতুন পূর্ণি (১৬)।
বিয়েবাড়ির নৌকাডুবি: পানির নিচেও মেয়েকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন বাবা!
/এসএস/পাবলিক ভয়েস/